ন্যাভিগেশন মেনু

ইলেকট্রিক গাড়ি: পরিবেশের জন্য আশীর্বাদ নাকি হুমকি!


তানজিল রহমান

পৃথিবীতে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যানবাহনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। মানুষের মৌলিক চাহিদা সাধারণত ৫-টি। কিন্তু, মনের অজান্তেই কখন যে ট্রান্সপোর্টেশন বা যানবাহন আপনার ৬নং মৌলিক চাহিদা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে, সেটা অর্থনীতি পণ্ডিতদের বই এ  না থাকলেও আপনার না জানার কথা না। যানবাহন, সেটা এক বিশাল যান্ত্রিক আয়োজন । কেউ চলে ডাঙ্গায় আবার কেউ ভাসে জলে , কেউবা আপনাকে উরিয়ে নিয়ে যায় সাত সমুদ্রের ওপারে। তবে এবার আসা যাক গাড়ি প্রসঙ্গে। গাড়ি একটি জনপ্রিয় বাহন। কারসগাইড অস্ট্রেলিয়া এর মতে, বর্তমানে পৃথিবীতে গাড়ির সংখ্যা প্রায় ১.৪ বিলিয়ন। সাধারণত অন্যান্য যানবাহনের ন্যায় গাড়িতেও জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যাবহার করা হয়। তবে আজকাল কিছু হাইব্রিড গাড়ি বাজারে দেখা যায়। এর পিছনে যে কারণটি রয়েছে সেটি হল , জীবাশ্ম জ্বালানী সংকট। পৃথিবীতে জীবাশ্ম জ্বালানী একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে মজুদ রয়েছে। 

বিজ্ঞানীদের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর বেশিরভাগ খনিই তেল শূন্য হয়ে পরবে এবং ২০৫০ সালে আমরা একটি খনিজ তেল বিহীন গ্রহে বাস করব (সূত্রঃ বিপি ২০১৩ এর বার্ষিক প্রতিবেদন)। আর এ কারণেই বিকল্প জ্বালানী হিসেবে প্রযুক্তিবিদরা বৈদ্যুতিক শক্তি ব্যাবহার করার কথা ভাবছেন। ভবিষ্যৎ এর কথা মাথায় রেখে গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর মধ্যে ইতিমধ্যে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। আর এ প্রতিযোগীয়তায় এগিয়ে আছে আমেরিকান ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলা মোটরস। 

২০০৮ সালে ৩৪৯ কি.মি. গতির রোডস্টার মডেলের একটি গাড়ি দিয়ে গোটা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দেয় এলন মাস্ক এর এই প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে টেসলার মডেল এস, ওয়াই সহ বিভিন্ন মডেলের ইলেকট্রিক গাড়ি বাজারে রয়েছে। তাদের ভাষ্য মতে, নিত্যনতুন সব প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব বিষয়টি মাথায় রাখা হচ্ছে। সাধারণ গাড়িতে যে জ্বালানী ব্যাবহার করা হয়, তা বাতাসে কার্বন ও ধোঁয়া নির্গমন করে পৃথিবীকে উত্তপ্ত করে। কিন্তু বৈদ্যুতিক গাড়িতে বিদ্যুৎ ছাড়া অন্য কোন জ্বালানীর প্রয়োজন হয় না। এখন প্রশ্ন আসে, বৈদ্যুতিক গাড়ি কি আসলেই পরিবেশ বান্ধব?

টেসলা কে বর্তমান ইলেকট্রিক গাড়ির মার্কেট লিডার হিসেবে ধরা হয়। বিপণন এর প্রসার ও প্রচারের অংশ হিসেবে টেসলা তাদের প্রস্তুতকৃত বৈদ্যুতিক গাড়িগুলোকে গ্রিন এনার্জি বা পরিবেশবান্ধব হিসেবে দাবি করে। তাদের ভাষ্য মতে তারা সৌরশক্তি ব্যাবহার করে পরিবেশ দূষণের উপর চাপ কমায়। কিন্তু বাস্তবে মার্সিডিজ-বেঞ্জের একটি ডিজেল ইঞ্জিনের গাড়ি থেকেও অনেক বেশি পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ করে টেসলা। 

মার্কিন সরকারের নিয়ম অনুযায়ী, টেসলা’র কার্বন নিঃসরণ এর পরিমাণ “শূন্য” থাকার কথা থাকলেও আসল সত্য হল, তাদের গাড়ি প্রতি কিলোমিটারে প্রায় ১৫৬ থেকে ১৮১ গ্রাম কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন করে (তথ্যসূত্রঃ কার্বনব্রিফ ইউকে)। বিদ্যুৎচালিত গাড়িতে একটি পেট্রোলচালিত গাড়ির থেকেও কম শক্তি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এই শক্তি-ই বা আসে কোথা থেকে? বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে টেসলা’র ১,৯৪২টি নিজস্ব সুপারচারজিং ষ্টেশন রয়েছে। যেখানে মাত্র ২০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে গাড়ির ব্যাটারি সম্পূর্ণ চার্জ করা সম্ভব। যে বিদ্যুৎতের মাধ্যমে সুপারচারজিং ষ্টেশনে গ্রাহকদের গাড়ি চার্জ করা হয় সেটা কি পরিবেশবান্ধব নাকি সৌরশক্তি থেকে উৎপন্ন? আসলে এটির উৎস হল সাধারণ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, যেখানে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়। ফলাফলস্বরূপ, এই ধরণের বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতাসে প্রচুর পরিমাণে কার্বন নির্গমন করে পরিবেশের ক্ষতি সাধন করে (তথ্যসূত্রঃ স্লেট সেপ্টেম্বর ২০১৩)। শুধু তাই নয়, বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি তৈরি করতে বিশেষ একধরনের বিরল ধাতুর প্রয়োজন হয়। যেটি সংগ্রহ করতে প্রচুর পরিমাণে খননের প্রয়োজন পড়ে (তথ্যসূত্রঃ অয়ার্ড মার্চ ২০১৬)। 

এছাড়া, টেসলা ফ্যাক্টরি তাদের গাড়ি উৎপাদনের মাধ্যমে বাতাসে প্রচুর পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস ছড়ায়। এখন আমরা সবাই যদি আমাদের চিরাচরিত গাড়ি বদলে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাবহার শুরু করি, তাহলে দেখা যাবে পৃথিবীর গ্রিনহাউস এফেক্টের প্রভাব আরও বেশি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।

লেখক: তানজিল রহমান, চংচিং জিয়াওতং বিশ্ববিদ্যালয়, চংচিং, চিন ।