ন্যাভিগেশন মেনু

একজন মহান নেতার জন্ম

ছিল সময়ের দাবি


শরীফ শাহাব উদ্দিন

নানা সময়ে বিদেশি বর্গিরা আমাদের এই শস্য-শ্যামল বাংলায় এসে ব্যাপকভাবে সম্পদ লুটপাট করে তাদের দেশে নিয়ে গিয়েছে। 

তাদের মধ্যে মারাঠা বর্গিরা-  তাদের বর্বরতার জন্য ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান পেয়েছে। আঠারো শতকের দিকে বর্গিরা যখন-তখন বাঙলার জনপদে লোকদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে অর্থকড়ি কেড়ে নিয়েছে এমনকি কি তাদের হামলা থেকে রেহাই পায়নি বাড়ী-ঘরের মূল্যবান সম্পদও।

এটি একটি নিয়মিত ঘটনা হিসাবে পরিগণিত হয়েছিল এই শান্ত-শ্যামল বাংলার জনপদে। বর্গিদের এই হামলা এমন ভয়াবহ এবং ভীতিজনক পরিস্থিতিতে পৌঁছেছিল যে মায়েরা তাদের সন্তানদের বর্গিদের নৃশংসতার গল্প শুনিয়ে কোন কথা না বলে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়তে বলতেন।

১৭৪০ থেকে ১৭৫০ অবধি  মারাঠা লুটেরারা প্রতিবছর এই বাংলায় এসে হামলা চালিয়েছে।   সেই থেকে এই অঞ্চলের লোকেরা, বিশেষত: মায়েরা প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা প্রদীপ জ্বালিয়ে লুটেরা  বর্গির হামলা থেকে রক্ষার জন্য কায়মনে ঈশ্বরের কাছে একজন ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের জন্য প্রার্থনা করতে থাকেন।

একশো বছর নিরলশ প্রার্থনার পর ঈশ্বর সদয় হয়ে মায়েদের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁদের প্রার্থনা  মঞ্জুর করেন। বাংলার ঘরে ত্রাণকর্তা হিসেবে জন্ম নেন একজন শিশু। সেই শিশু আর কেউ নন- তিনি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯২০ সালের ১৭  মার্চ মাসে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বাবা শেখ লুৎফর রহমান এবং মা সায়রা খাতুনের বাড়ি আলোকিত করে ত্রাণকর্তা শিশুটি জন্মগ্রহণ করেন।

স্নেহের ধন সন্তানকে বাবা-মা আদর করে ‘খোকা’ বলে ডাকতেন। সেই খোকা আর কেউ নন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি হাজার বছরের বাংলার প্রতিভাধর পুত্র এবং তাঁর জন্ম ছিল একেবারে  সময়ের প্রয়োজনে।

বাংলাদেশ, যা একসময় বঙ্গদেশ নামে পরিচিত ছিল। এখানে প্রচুর পরিমাণে শস্য ফলত। এবং ঠিক এ কারণেই বঙ্গদেশকে ভারতীয় উপ-মহাদেশের খাদ্যশস্যের ভাণ্ডার বলে পরিগণিত হয়েছিল।

বাংলাদেশ গত ৮০০ বছর ধরে বিদেশি হানাদার ও জলদস্যুদের লক্ষ্যবস্তু ছিল।

আসলে, এই অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ ছিল বহুমাত্রিক। যখন এই বাংলায় পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর নৃশংসতা চরম শিখরে পৌঁছেছিল এবং লোকেরা তাঁদের দুর্ভোগ নিরসনে একজন লৌহমানবের প্রয়োজন অনুভব করছিলেন, তখনই বঙ্গবন্ধু ত্রাণকর্তারূপে আবির্ভূত হন।

ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি দখলদার  বাহিনীর নৃশংসতা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে  জোরালোকণ্ঠে প্রতিবাদ শুরু করেন।

পাকিস্তানি শাসকরা দখলদারিত্বের অবসানের বিপদ আঁচ করতে পেরে বঙ্গবন্ধুসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষদের উপর প্রচণ্ড আক্রোশ নিয়ে দমন-পীড়নে নেমে পড়ে।

পাকিস্তানের নৃশংসতা বৃদ্ধির সাথে সাথে জনগণও বসে থাকেনি।তারাও  ক্রমবর্ধমান বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রতিবাদে নেমে পড়েন।

নিরবিচ্ছিন্ন আন্দোলনের একপর্যায়ে এসে বঙ্গবন্ধু বাঙলায় অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন এবং তাঁর প্রতিফলন ঘটে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে অভাবিত বিজয়ের মাধ্যমে।  

বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সাথে বিজয় লাভ করে।  ১৯৭০ সালের ওই  নির্বাচনে বিশাল জয়লাভের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এককভাবেই বাঙলা এবং বাঙ্গালীদের পক্ষে কথা বলার অধিকার লাভ করেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে এবং তৎকালীন পূর্ব  পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষের একমাত্র নেতা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। 

বঙ্গবন্ধু জেলে কিন্তু তাঁর নির্দেশেই অনুসারীদের প্রবল গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আইয়ুব খান ক্ষমতাচ্যুত হন। দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন নয়া সেনা প্রধান জেনারেল  ইয়াহিয়া খান।

নয়া সেনা প্রধান ও প্রেসিডেন্ট  ইয়াহিয়া খান লিগ্যাল ফ্রেম অর্ডারের (এলএফও) অধীনে একটি সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেন, যা তাকে যে কোনও সময় নির্বাচিত সংসদ বাতিল করার ক্ষমতা দেয়।

লিগ্যাল ফ্রেম অর্ডারের বিরোধিতা করে ন্যাপ নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঘোষণা করেন, তিনি এলএফও’র অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবেন না।

কিন্তু দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা ঘোষণা করেন।

এরআগে আইয়ুব খান তৎকালীন সাড়া পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল।

কেননা পূর্ব পাকিস্তানের ঐক্যবদ্ধ জনগণ তখন পুরোপুরি বঙ্গবন্ধুর সাথে রয়েছেন। বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষের অভিপ্রায় আঁচ করতে পেরে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন। তিনি বুঝেছিলেন এ নির্বাচণে তিনি বিপুলভোটে বিজয়ী হবেন।

বঙ্গবন্ধু এটাও বুঝেছিলেন এই বিজয়ের পর তিনি  বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্বীকৃত নেতার আসন লাভ করবেন এবং কালো আইন এলএফওকে আপনাআপনিভাবেই বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া যাবে।

ওই নির্বাচনের অপর দিকটি ছিল এমন যে- বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ যদি এলএফও’র অধীনে নির্বাচনে যদি অংশ না নেয়, তবে কিছু ছোট-খাটো দল তাতে অংশ নিয়ে কিছুটা আসন অর্জন করবে।

এবং সেই পরিস্থিতিতে গঠিত হবে একটি ঝুলন্ত সংসদ। নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগির ফলে সরকারের পতন ঘটবে। আর সামরিক বাহিনীর পক্ষে আরও একবার ক্ষমতা দখলের সুযোগ তৈরি হবে।

অর্থাৎ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর চরিত্র অনুযায়ী তারা নামসর্বস্ব ছোট দলগুলির নির্বাচিত নেতাদের সরকার গড়তে আমন্ত্রণ জানাত এবং তাদের পছন্দ অনুযায়ী ব্যক্তিকে মন্ত্রিসভায় আসন ভাগাভাগি করে পদ দিত।

আর বঙ্গবন্ধু যদি সামরিক বাহিনীর এই পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ জানাতেন এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করতেন। তবে ইয়াহিয়া খান অবশ্যই বঙ্গবন্ধুকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হুমকির জন্য দোষারোপ করে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ভাষণের মাধ্যমে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত।

আওয়ামী লীগ ব্যতীত কথিত চোটখাট রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিত এবং আওয়ামী লীগ রাস্তায় আন্দোলনের পথ বেছে নিত, তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করা হত।

এতে করে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পক্ষে বঙ্গবন্ধুকে শাস্তি দেওয়ার পথ করে দিত। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছেও কিছু বলার ছিল না।

বাঙলার মাটির একজন প্রতিভাশালী পুত্র হিসেবে শেখ মুজিব সহজেই বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ, বেদনা এবং পাকিস্তানি শাসকদের উদ্দেশ্য ও তাদের সম্পর্কে তিক্ত-অভিজ্ঞতা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।

তাই বিচক্ষণ জাতির পিতা পাকিস্তানের সামরিক শাসক গোষ্ঠির ষড়যন্ত্র  আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করার কোনও সুযোগ দেননি। তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন এবং বিশ্বকে দেখিয়েছিলেন যে তিনি অভূতপূর্ব জয় পেয়েছেন।

কিন্তু, পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা শেখ মুজিবকে সরকার গঠনের অনুমতি দেয়নি। অথচ নির্বাচনের ফলাফলে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানের প্রদানমন্ত্রীর হওযার সুযোগটি অস্বীকার করার জন্য সামরিক বুটের নিচে জনগণের অধিকারকে চেপে ধরে সামরিক জান্তা মানুষের মনে ভয় জাগাতে নিরীহ মানুষকে হত্যা শুরু করে।

তারা অবৈধভাবে একজন নির্বাচিত নেতাকে গ্রেপ্তার করেছিল যিনি মানুষের পছন্দের দ্বারা প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। তবে লায়লপুরের পাকিস্তানি কারাগারে বন্দী থাকাকালীন বঙ্গবন্ধুকে স্পর্শ করার সাহস পায়নি পাকিস্তানি কসাইরা।

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের চাপের মুখে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল।

বহু মহান পুত্র-কন্যার জন্ম দিয়েছে এই বাংলার মা। মাটির সেই মহান পুত্র-কন্যারা মাতৃভূমির জন্য কিছু ভাল করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। দীর্ঘ ২৩ বছরের লড়াইয়ের জন্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালীদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য চূড়ান্তভাবে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। স্বাধীনতার জন্য তিনি রক্তের শেষ বিন্দু  পর্যন্ত শত্রুদের সাথে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য আহবান  জানিয়েছেন।

তাঁর আহবানকে নির্দেশ হিসেবে গ্রহণ করে, এই মাটির দামাল ছেলেরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাস এক দুর্দান্ত যুদ্ধ করেছিল।  যুদ্ধের নয় মাস পর তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের মাটিতে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্যও করেছিল।

অত্যন্ত প্রত্যাশিতভাবেই নতুন দেশ- বাংলাদেশ  বিশ্ব মানচিত্রে উপস্থিত হয়েছিল।

সুতরাং, অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলা যেতে পারে যে, বঙ্গবন্ধু পৃথিবীতে না এলে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি কেবল স্বপ্নই থেকে যেত। অত্যন্ত  দৃঢ়তার সঙ্গেই বলা যায়- ঐতিহাসিকভাবে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্ম বাংলাদেশের মানুষ এবং বিশ্বের শান্তিকামী মানুষদের জন্যও মহান ঈশ্বরের দান।

লেখক:  শরীফ শাহাব উদ্দিন

প্রধান সম্পাদক,  বাংলাদেশ পোস্ট

সর্বশেষ সংবাদ পেতে ভিজিট করুন আজকের বাংলাদেশ পোস্ট