ন্যাভিগেশন মেনু

করোনাভাইরাস, সাংবাদিকতা ও টেন্স এর ব্যবহার


১২০ ন্যানোমিটার ব্যাসের একটি অনুজীব। নাম কোভিড-১৯, বা নভেল করোনাভাইরাস। ১২ হাজার ৮৭২ কিলোমিটার ব্যাসের বিশাল পৃথিবীকে স্থবির করে দিয়েছে এই অদৃশ্য অনুজীবটি। ভাইরাসটির থাবায় এখন পর্যন্ত না ফেরার দেশে পারি জমিয়েছেন ২ লাখ ৭০ হাজার ৪২৬ জন (৮ মে, শুক্রবার, সকাল ৯টা)। গোটা বিশ্ব দেখছে এক অণুজীবের নিষ্ঠুর ক্ষমতাকে। শেষতক পার্থিব জগতের প্রতাপশালী গোষ্ঠীও হিমশিমই খাচ্ছে এই দুর্যোগ মোকাবেলায়।

ভয়ানক এই ভাইরাসের দাপটে ধরাতলে চলছে মহামারী। ঠেঁকাতে চলছে যুদ্ধ। কিন্তু এ যুদ্ধে কোনো আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নেই। তাই যুদ্ধের ময়দানে সৃষ্টির সৃষ্ট জীবের শরীরের এক ফোঁটা রক্তও ঝরছেনা। তবে এ যুদ্ধে জয়ী হতে আছে কৌশল, রয়েছে ঢাল। যে ঢাল শক্ত করে ধরে আছেন সেবা কর্মীরা। তাই উপাধিও জুটেছে ‘সম্মুখ যোদ্ধা' হিসাবে। প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকাও কোনো অংশে কম নয়।

এদেরকে ঢাল হিসাবে ব্যাবহার করেও অতি-আণুবীক্ষণিক এবং অকোষীয় অণুজীবটির সংক্রমণ রোধ করা যাচ্ছেনা। তবে মানব দেহকোষে ভাইরাসটি যেনো বাসা বাসা বাঁধতে না পারে সে জন্য কিছু নীতি অবলম্বন করছে প্রতিটি দেশ। ধরিত্রীর বুকে সবচেয়ে দরিদ্রতম রাষ্ট্র পূর্ব আফ্রিকার বুরুন্ডির জন্য যে নীতি, মার্কিন মুল্লুুকদের জন্যও তাই। যাক, অন্তত একটা ইস্যুতে ইজরায়েল এর মত রাষ্ট্রও এক হয়েছে।

অপরদিকে নভেল করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারে লোকচক্ষুর অন্তরালে কাজ করছেন একদল আবিষ্কারক। যারা বিজ্ঞানের উৎকর্ষকে কাজে লাগিয়ে বুঁদ হয়ে আছেন আরোগ্যকর ওষধ বানানোর কাজে। নি:সন্দেহে তারাও যোদ্ধা। তাদের বীরত্বকাব্য ধরাধাম জানবে উদ্ভাবন হবার পর। হয়তো জুটবে 'নোবেল লরিয়েট'। কিন্তু সফলতার দেখা যারা পাবেননা তাদেরকেও ব্যর্থ বলা যাবেনা। কারণ তাদের যাত্রাটাও শুরু হয়েছিল ৭৭৯ কোটি মানুষের কথা ভেবেই।

বোধকরি এমনসব খবরের জন্য চেতনাশূন্য অথবা ডাহা মূর্খরাও গণমাধ্যমগুলো বার্তার অপেক্ষায় থাকেন। আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত আছে দুর্ভিক্ষ, মহামারি ও অন্যান্য জাতীয় দুর্যোগে তথ্যপ্রবাহের গুরুত্ব। সে হিসাবে গণমাধ্যম কর্মীরা প্রণোদনার দাবিদার না হলেও রাষ্ট্রের শীর্ষ মহল থেকে বন্দনাগীতির আশাটুকু করা যেতেই পারে।

তবে গেলো তিন তারিখ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস বলেছেন, 'একদিকে যখন বিশ্বে ভাইরাসের মহামারী চলছে, তখন ভুল তথ্য, ক্ষতিকর স্বাস্থ্য পরামর্শ এবং উদ্ভট ষড়যন্ত্র তত্ত্বের এক দ্বিতীয় ঢেউ ‘মহামারীর মত’ ছড়িয়ে পড়ছে। সেই মহামারীর বিরুদ্ধে প্রতিষেধক হল মুক্ত সংবাদমাধ্যম, যারা যাচাই করে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও বিশ্লেষণ তুলে ধরছেন।'

আর গত ৬ এপ্রিল কানাডা, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, লাটভিয়া, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র এক যৌথ বিবৃতিতে করোনার সংকটকে কেন্দ্র করে কিছু দেশে স্বাধীন ও মুক্ত সংবাদপ্রবাহে অন্যায় বিধিনিষেধ আরোপের উদ্যোগে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।

জাতিসংঘের মহাসচিবের সেই কথা যখন বিশ্ব দরবারের গণমাধ্যমে স্থান পাচ্ছে, তখনই লাল সবুজের দেশের গণমাধ্যম গুলোতে দেখা মিলেছে সাংবাদিক কাজলের পিঠমোড়া দিয়ে হ্যান্ডকাফ পড়ানোর ছবি। হাজত খানায় লোহার শিকে বন্দী বাবার পাশে ছেলের ছবি। উনার অপরাধটাও আজগুবি, সাংবাদিক কাজল নাকি নিজ দেশেই অনুপ্রবেশকারী!

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সনাক্তের পর ৩রা মে পর্যন্ত২৬টি দিবস পালিত হয়েছে। তবে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে নিখোঁজ হওয়া এক সংবাদকর্মীর ফিরে আসা দিবসটিকে সত্যিই স্মরণীয় করে রেখেছে। এদিন আবার বিশ্ব হাসি দিবসও ছিল। এমন উদ্ভট কান্ডে মুচকি একটি হাসি দিয়ে অন্তত হাসি দিবসের মর্যাদাটাকে রেখেছি আমি।

হয়তোবা করোনা টেস্ট, রোগী শনাক্তকরণ, হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা, নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ) ও কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের (ভেন্টিলেটর) সংখ্যা, কিংবা, পোশাক কারখানা খোলা এবং বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে লিখালিখি, দেশব্যাপী চাল চুরি, রাতের ভোটে জনপ্রতিনিধি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারীরা আমাদের যে অভিশাপ দিয়েছেন সেই অভিশাপের গর্দান হয়তো কাজল ভাইয়ের উপর দিয়েই গিয়েছে। ওহ, ডিজিটাল নিরাপত্তার আইনেও নাকি উনার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা আছে। অনুপ্রবেশকারী হিসাবে জামিন পেলেও ৫৪ ধারায় লাল দেয়ালের মাঝে ঠিকই যেতে হয়েছে।

কিছুক্ষন আগেই বলেছিলাম জনপ্রতিনধিদের চুরির বিষয়ে। এবার একটি জ্যান্ত উদাহারণ দেই। জামালপুরে ত্রাণের স্লিপ তৈরি নিয়ে সরকারী দল দুটি গ্রুপে বিভক্তি হয়। আর এই বিভক্তি রূপ নেয় সংঘর্ষে। মারধর করা হয় গণমাধ্যম কর্মীদের। ক্ষত-বিক্ষত করা হয় সময় টিভি ও ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির ক্যামেরাকে। সাংবাদিক কাজলকে যে রাতে উদ্ধার করা হয় তার আগের সন্ধ্যার ঘটনা এটি।

ক্ষমতাধারীদের অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি প্রকাশ হবে বলেই হয়তো এমন নিয়তি মেনে নিতে হয় অসঙ্গতির বিপরীতে হাঁটা অবলা গণমাধ্যম কর্মীদের। অবশ্য এমন ঘটনা আমাদের কাছে এখন মামুলি বিষয়। সাগর-রুনীর শরীর থেকে বের করা রক্তের অদৃশ্য মানবকে যখন দৃশ্যমান করা যায়না তখন প্রতিনিয়ত নির্যাতিত এসব সাংবাদিকদের রক্ত নিয়ে হোলির উৎসব যে হচ্ছেনা সেটাই কম কী!

তবে একজন গণমাধ্যম কর্মী হিসাবে নয় রক্ত -মাংসের মানুষ হিসেবে নিজের বিবেকবোধ থেকে প্রশ্ন জাগে রাজধানী থেকে মফস্বল পর্যন্ত দলকানা সাংবাদিক নেতাদের ভূমিকা নিয়ে। আদর্শচ্যুতিও যে সৃষ্টিশীলতা তাদের কাছ থেকেই দেখছি। শিখছি। তাদের অনুপ্রেরণায় অথবা অনুকরণ করতে গিয়ে আমি কিংবা অনুজরা সেসব নেতাদের সৃষ্টিশীলতাকে শৈল্পিক রূপ দিতে গিয়ে ম্যুরাল অথবা পাঠ্যবইয়ে তাদের জীবনীর স্থান দেবার দাবিতে আন্দোলন করলেও অবাক হবার কিছু থাকবেনা।

তবে লজ্জায় মাথানত হয় এমন পরিসংখ্যানে।ফ্রান্সভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের ২০২০ সালের সমীক্ষা সূচকে জানায়, বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১। আগের বছরের তুলনায় আমরা আরো এক ধাপ পিছিয়েছি। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমরাই সবচেয়ে পিছিয়ে।

সব কিছুর শুরু যেমন আছে শেষও আছে। বিশ্বায়নের যুগে বিষাক্ত অণুজীবটি পঞ্চম বৃহত্তম গ্রহকে যেভাবে জাপটে ধরেছে সেটিও হয়তো বিদায় নিবে। ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে। ইংরেজী গ্রামারের ভাষায় Past Tense হবে এই মহামারী। আর যুগে যুগে সাংবাদিক নির্যাতন ও গণমাধ্যমের টুটি চেপে ধরাটা Present Indefinite Tense হয়েই থাকবে। কারণ, এটাই চিরন্তন সত্য।

আর তেলে ভাজা শব্দ অথবা ছবক শক্তি দিয়ে ক্ষমতাধরদের অনুকম্পন পাওয়া আমাদের সিংহভাগ নেতাদ্বয় সর্বদাই Present Tense এবং Present Continues Tense হয়েই থাকবেন। এ দুটি Tense-ই দলদাস কোটার জন্য আজীবন সংরক্ষিত।

লেখক: সৈয়দ মাহফুজুর রহমান নোমান, গণমাধ্যমকর্মী

এডিবি/