ন্যাভিগেশন মেনু

করোনা মোকাবেলায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশে ডিপ্লোমা ডাক্তারগণ


১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে স্বভাবতই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।অনেক গরীব, দুস্থ, অসহায় মানুষের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দেয়া সরকারের পক্ষে কষ্টকর হয়ে পড়ে।

তখন সামান্য কলেরা রোগে গ্রামের পর গ্রাম জনশূন্য হয়ে যেত। যা জনবান্ধব বঙ্গবন্ধু’র সরকারকে ভাবিয়ে তোলে। সেজন্য স্বল্প সময়ে সবার জন্য চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার ত্বরিৎ পদক্ষে গ্রহণ করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ১৯৭৩-১৯৭৮ মোতাবেক ব্রিটিশ- পাকিস্তান আমলের লাইসেন্সশিয়েট অব মেডিকেল ফ্যাকাল্টি এলএমএফ, মেম্বার অব মেডিকেল ফ্যাকাল্টি এমএমএফ ডিপ্লোমা সমমান চিকিৎসকদের কোর্স কারিকুলাম অনুসারে চিকিৎসা বিদ্যায় ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল ফ্যাকাল্টি ‘ডিএমএফ’ কোর্স আন্তর্জাতিক ভাবে অনুমোদন করান।

১৯৭৬ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় অনুমোদিত, রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ কর্তৃক অধিভুক্ত, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল স্বীকৃত মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল ( ম্যাটস্ ) এর মাধ্যমে ‘ডিএমএফ’ কোর্সটি প্রথম যাত্রা শুরু করে।

D.M.F কোর্সটি ৩ বছর একাডেমিক এবং ১ বছরের (৯মাস জেলা সদর হাসপাতাল এবং ৩ মাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স) ইন্টার্ণশীপ সহ মোট ৪ বছরের, যেটি A-Z ইংরেজি ভার্সন। ভর্তির যোগ্যতা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে SSC এবং জীববিজ্ঞান বাধ্যতামূলক। বর্তমানে দেশে ৯টি সরকারি ম্যাটস্ এবং ২০০+ বেসরকারি ম্যাটস্ রয়েছে।

MATS থেকে পাশ করার পর Bangladesh Medical & Dental Council (BMDC) এসব D.M.F দের ডি (D) ক্যাটাগরির মেডিকেল প্র্যাক্টিশনার (মেডিকেল এ্যাসিস্ট্যান্ট প্র্যাক্টিশনার) হিসেবে প্র্যাকটিসের অনুমতি দেয়।

MATS থেকে পাশ করা ডিএমএফগণ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে ‘উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার বা এস. এ. সি. এম. ও (S.A.C.M.O)’ পদে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

সরকারি-বেসরকারি ম্যাটস্ থেকে প্রতিবছর ১০০০০+ ডিএমএফ পাশ করে বের হয়। সরকারী নিয়োগ বন্ধ থাকায় বিভিন্ন বেসরকারী হাসপাতাল/ক্লিনিকে, ন্যাশনাল এবং ইন্টারন্যাশনাল এনজিও তে বিশেষ করে কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে, গার্মেন্টস এবং ইন্ডাস্ট্রি গুলোর মেডিকেল সেক্টরে, বিভিন্ন স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রমে নিয়োজিত রয়েছেন।

এছাড়াও বিভিন্ন আধাসরকারী/কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠান; রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কোল পাওয়ার জেনারেশন, জিটিসিএল এর মেডিকেল সেক্টরের পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চল সহ আমাদের দেশে যে সব প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে মেডিকেল সেবা চালু আছে সেখানে মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা দানে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন।

বর্তমানে COVID-19 এর কারণে নিজের জীবনবাজি রেখে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীরা স্ব স্ব অবস্থান থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। চাকরি জীবনের শুরু হত 'মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট' হিসেবে কিন্তু অন্যান্য ডিপ্লোমাধারীদের ন্যায় 'উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার - এস,এ,সি,এম,ও' পদবী করণ হয় ১৯৯৬ সালে। এটা কার্যকর করতে সময় লেগেছে ১৬ বছর।

বাংলাদেশের ডিপ্লোমা MATS সরকারি প্রতিষ্ঠানে চান্স পেতে হলে ভর্তি পরীক্ষায় ২০০ এর মধ্যে ১৬০+ নাম্বার পেতে হয়। সুযোগ পাওয়া বেশির ভাগ গরীব এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থী।

MATS থেকে পাশ করার পর ২০ বছর বয়সে থেমে যায় একটা শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন। কারণ তার উচ্চ শিক্ষার কোন সুযোগ নেই । মেডিকেল ডিপ্লোমার মত অন্যান্য ডিপ্লোমা যেমনঃ নার্সিং, মেডিকেল টেকনোলজি। এদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ আছে কিন্তু ম্যাটস্ থেকে পাশ করা ডিএমএফ দের জন্য কোন সুযোগ নেই। ৪ বছর মেডিসিন, সার্জারি এবং গাইনি পড়েও হয় না উচ্চ শিক্ষার কোন পথ! তারা  উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।

প্রত্যেকটা ডিপ্লোমা কোর্সে ৩-৬ মাস ইন্টার্নিশিপ পিরিয়ড থাকে, যে সময়টাতে শিক্ষার্থীরা হাতে কলমে শিক্ষা নেয়। ম্যাটস্ থেকে পাশ করা ডিএমএফ দের ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম যেখানে ৪ বছরের ডিপ্লোমা কোর্সের দ্বিতীয় বর্ষ থেকে সদর হাসপাতাল গুলোতে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের জন্য প্লেসমেন্ট দেওয়া থাকে যেটা একাডেমি ক্লাসের সমান সময়ের।

দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বর্ষ শেষে চতুর্থ বর্ষে ১ বছর মেয়াদি ইন্টার্নশিপ থাকে (বাধ্যতামূলক ৯মাস জেলা সদর হাসপাতাল এবং ৩ মাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স)।

অন্যান্য ডিপ্লোমা-  নার্সিং, ডিপ্লোমা ইন্জিনিয়ারিং সহ প্রত্যেকটা ডিপ্লোমা কোর্সে সরকার ইন্টার্নি ভাতা প্রদান করে যদিও তারা সর্বোচ্চ ৬ মাসের ইন্টার্নশিপ সম্পন্ন করে কিন্তু ডিএমএফ ইন্টার্নরা দ্বিতীয় বর্ষ থেকে হাসপাতালে কাজ করার পাশাপাশি ১ বছর সম্পূর্ণ অবৈতনিক ভাবে ইন্টার্নশিপ সম্পন্ন করলেও নিজের প্রাপ্য হিসেবে ইন্টার্নি ভাতা থেকে বঞ্চিত।

MATS থেকে পাশ করার পর Diploma in Medical Faculty (D.M.F) ডিগ্রি পেলেও দিন শেষে তার পরিচয় সে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট। ম্যাটস্ থেকে যারা পাশ করেন তারা বেসিক মেডিসিন, বেসিক কমিউনিটি মেডিসিন, বেসিক সার্জারী, বেসিক গাইনী & অবস্ পড়ে থাকে যেমনটা অন্যান্য ডিপ্লোমাধারীগণ পড়েন (বেসিক), কিন্তু একাডেমিক কোন সাবজেক্টের নাম মেডিকেল এ্যাসিস্ট্যান্সি থাকে না।

ডিএমএফ কোর্সের যাত্রা শুরু যখন MATS এ এডমিশনের মাধ্যমে, সেখানে একটা স্টুডেন্টের মেডিকেল ফিটনেস দেখে তাকে কোয়ালিফাইড/ ডিসকোয়ালিফাইড হিসেবে ঘোষণা করেন স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের মেডিকেল অফিসার (Govt. MATS), যিনি নিজে একজন এমবিবিএস পাশ।

পরবর্তীতে একাডেমিক প্রত্যেকটা বিষয়ের লেকচারার হিসেবে যাঁরা পাঠদান করেন তাঁরা সবাই এমবিবিএস পাশ করা, হাসপাতালে প্লেসমেন্ট + ইন্টার্নির সময় যারা হাতে ধরে ধরে শিক্ষা দেন তারাও এমবিবিএস পাশ। যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে জন্ম নেয় একজন ডিএমএফ তাঁদের মধ্যে ৯০-৯৫% অবদান এমবিবিএস দের (বাকি ৫-১০% অন্য স্টাফ)।

যেদিন Bangladesh Medical & Dental Council, D ক্যাটাগরির রেজিষ্ট্রেশন দিয়ে দেশের মানুষের প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিতের অধিকার দিয়ে দেন সেদিন সেই অনুমোদনকারীও একজন এমবিবিএস।

যেদিন সরকারী/বেসরকারী চাকরি জীবনের শুরু সেদিনও যার আন্ডারে যোগদান করে সেদিন সেই অফিসারও একজন এমবিবিএস, আবার যেদিন একজন উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার সময় হয় তখন যার আন্ডারে থেকে অবসরে যায় তিনিও একজন এমবিবিএস।

চাকরির ক্ষেত্রেও উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার পদবী হয়েও সুযোগ বঞ্চিত।  কারণ বাংলাদেশের মোটামুটি সব ডিপ্লোমাধারীরা সরকারী চাকরিতে ১০ম গ্রেড দিয়ে শুরু করলেও এস,এ,সি,এম,ও রা ১১তম গ্রেড দিয়ে শুরু করতে হয়- তাও আজীবন ব্লক পোস্ট।

বর্তমানে দেশে প্রায় ৪০-৫০ হাজার ডিএমএফ বেকার, অনেকের বয়স শেষ অথচ নেই কোন নিয়োগ! বেকারত্ব যখন একটা জীবন্ত অভিশাপ তখন বেকারেরা নিরুপায় হয়ে অনেকে পেশা পরিবর্তনের যুদ্ধে ব্যস্ত। নীতিনির্ধারকেরা বারবার D.M.F তথা উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারদের নিয়োগের কথা উঠে তখনি এড়িয়ে যাচ্ছেন। 

এমবিবিএসদের হাতে গড়া ডিএমএফ দের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার হিসেবে কমিউনিটি ক্লিনিক এ নিয়োগ থেকে বঞ্চিত করে করে রাখা হয়েছে। দেশে M.B.B.S ডাক্তারদের Community Clinic গুলোতে পদায়ন করার ব্যবস্থা নেই তাই ডিএমএফ দের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার পদ সৃষ্টি এবং পদায়ন এখন সময়ের দাবী।

যদি কমিউনিটি ক্লিনিক গুলোতে বর্তমানে ডিএমএফ দের জন্য পদ থাকতো তাহলে COVID-19 এর উপসর্গের উপর ভিত্তি করে প্রথম সারির সৈনিক হিসেবে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (এস,এ,সি,এম,ও) দ্বারা গ্রামে বসেই প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো।

কারণ ডিএমএফ দের জন্য BMDC কর্তৃক নির্ধারিত ড্রাগ লিস্টের মাধ্যমে যথাযথ চিকিৎসা সহ কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে এই দূর্যোগের সময় গ্রামের মানুষকে Corona Virus এর ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করা অনেকাংশেই সহজ হত। এবং ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক থেকেই করোনা নির্মূলের সুর বেজে উঠতো।

দেশে হাজার হাজার বেকার D.M.F এর জন্য চাকরি রাস্তা বন্ধ থাকায় এবং বেসরকারী চাকরির যুদ্ধে হেরে গিয়ে BMDC এর রেজিষ্ট্রেশন নিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিসেও ভোগান্তিতে পড়েন।

COVID-19 এর ভয়াবহতা রোধে সারাদেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইমার্জেন্সি এবং বহিঃ বিভাগ, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (এস,এ,সি,এম,ও) গণ প্রথম সারির সৈনিক হিসেবে সেবা দানের মাধ্যমে দেশের মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করছেন। 

দেশের স্বাস্থ্য খাতকে আরো একধাপ এগিয়ে নিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারদের পদ বৃদ্ধি এবং পদায়ন এখন সময়ের দাবী কারণ দূর্যোগকালে দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দ্বারপ্রান্তে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিতে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারদের ভূমিকা অনন্য।

ডিএমএফ তথা উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারদের দুঃখের অবসান ঘটাতে বিভিন্ন সময় নীতিনির্ধারকদের স্মরণাপন্ন হয়েছে কিন্তু বিনিময়ে মৌখিক আশ্বাস ছাড়া বেশি কিছু এখনো কপালে জোটেনি। COVID-19 পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে সরকারী / বেসরকারী চাকরিজীবী, ডিপ্লোমা প্রাইভেট প্র্যাক্টিসনার, বেকার ডিএমএফ, ইন্টার্ন ডিএমএফ এবং ম্যাটস্ শিক্ষার্থীরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে হলেও মানুষের পাশে থাকতে প্রস্তুত।

এমতাবস্থায়, ডিএমএফদের সমস্যা নিরসনের জন্য  সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে।  ডিএমএফ গ্রামের মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের গুরুদায়িত্বটি পালন করে যাচ্ছেন। প্রতিনিয়ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মুখে হাঁসি ফুটিয়ে তাদের কেটে যাচ্ছে দিনের পর দিন। একদিন তাদের আশা পূরণ হবে সেই অপেক্ষায়  রয়েছেন। 

লেখকঃ নাছরুল্যাহ আনাছ

বিএমডিসি রেজিস্টার্ড, ডিএমএফ (রেজিষ্ট্রেশন নংঃ ডি-১৩২৬৫)

সরকারী ম্যাটস্, টাঙ্গাইল (৩১তম ব্যাচ)

এস এস