ন্যাভিগেশন মেনু

কাশ্মীরে পাকিস্তান হামলায় ১৪ হাজার নিহত স্মরণে পালিত হলো কালো দিবস


১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও  দেশটির আদিবাসি জঙ্গিদের  বর্বরতার শিকার হন রাজা শাসিত কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ।  পাকিস্তানের ওই হামলায় নিহত হন ১৪ হাজার মানুষ।

পাকিস্তান   আক্রমণ চালিয়ে বেশ কিছু এলাকা দখল করে নেয়।  শুধু দখলই নয়, রাজ্যটির কয়েক হাজার হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ এবং মুসলমান নাগরিকও প্রাণ হারান।

পাকিস্তানের হামলার খবর শুনে ভারতীয় সেনারা ২৬ অক্টোবর কাশ্মীরে গিয়ে  রাজ্যটির  লোকজনকে প্রাণ বাঁচিয়ে রক্ষা করেন। স্থানীয়রা ভারতীয় বাহিনীকে সাদরে অভিনন্দন জানায়।

তবে তার আগেই হাজার হাজার  হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও মুসলমান প্রাণ হারান এবং লাখ লাখ  কাশ্মীরবাসির সম্পদ  লুটপাট হয়ে যায়।

ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং যারা  জীবন দিয়ে পাকিস্তান হানাদারদের পরাজিত করেছেন, তাদের স্মরণে আজ বৃহস্পতিবার ( ২২ অক্টোবর) জম্মু ও কাশ্মীরে ‘কালো দিবস’ পালন করা হয়।

এই কালো দিবস উপলক্ষে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ১৯৪৭ সালের পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরার জন্য জম্মু কাশ্মীরে একটি বিশেষ প্রদর্শনী আয়োজিত হয়।

বিশেষ প্রদর্শনী ছাড়াও ২০ জন প্রখ্যাত সাংবাদিক, সেনা কর্মকর্তা, গবেষক, লেখক, সাংবাদিকদের নিয়ে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান  করা হয়।

অপরদিকে কাশ্মীরবাসির প্রাণ রক্ষার দিনটিকে লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে নিরলজ্জভাবে  পাকিস্তান ২৬ অক্টোবর 'ব্ল্যাক ডে' বা কালো দিবস  পালন করে।

পাকিস্তানের ইতিহাসে  আসল ঘটনা বিকৃতি নতুন কিছু নয়। কিন্তু সত্য কখনো চাপা থাকে না। এটাও ইতিহাসেরই শিক্ষা। প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হবেই। ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের তরুণদের দিকে তাকালে এটা যে কত জরুরি সেটা বোঝা যায়। দশকের পর দশক ধরে ভুল তথ্য আর মিথ্যা প্রচার করে পাকিস্তান কাশ্মীরী তরুণদের মন বিষিয়ে দিয়েছে।

এখনও অনেকের কাছেই গোপন রয়েছে কাশ্মীরের আসল ইতিহাস। এখন সময় এসেছে জম্মু ও কাশ্মীরের তরুণদরে সামনে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার। ইতিহাসের আলোকে দাঁড়িয়ে তারাই পারবে নিজেদের ভবিষ্যত ঠিক করতে। আসল সত্য জানলে নিজেরা সমৃদ্ধ হবে নিজেদের মাতৃভূমি সম্পর্কে। ভাঙবে ভুল ধারণা।  

প্রতি বছর পাকিস্তান ২৬ অক্টোবর 'ব্ল্যাক ডে' বা কালো দিবস হিসেবে পালন করে। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে আট মাসের যুদ্ধে ভারতের কাছে পরাজয়ের স্মৃতি আগলে তারা আজও পালন করে চলেছে কালো দিবস।

১৯৪৭-৪৮-এর সেই যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়েছিল পাকিস্তান।সেনা সদস্যদের পাশাপাশি তাদের সাহায্য করতে গিয়ে বহু উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ, পাকিস্তান-সন্ত্রাসবাদীরাও সেই যুদ্ধে প্রাণ হারায়। সেইসঙ্গে নিজেদের ব্যর্থতার কথাটিও সকলকে মনে করিয়ে দিতে চায়। বড় বেদনার তাদের এই পরাজয়ও।

১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর কাশ্মীর আক্রমণের পরিণতি যে ভালো হয়নি সেটা ভালোই বোঝেন পাকিস্তানের সর্বস্তরের মানুষ। তবু সেই পরাজয়ের স্মৃতিকে উস্কে দিয়ে আজও চলছে ভারত-বিদ্বেষ বাড়ানোর চেষ্টা। চলছে মিথ্যা প্রচারও।

কালো দিবসের নামে  পাকিস্তান শোক প্রকাশ করে নিজেদের দেশের নিহত সেনা ও অন্যদের প্রতি। কিন্তু ভুলেও কাশ্মীর উপত্যকায় নিহত হাজারো মানুষের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা কখনও জানায়নি তারা। আসলে কাশ্মীরের প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা তাদের নেই।

রয়েছে শুধু অশান্তি বাধানোর বিষ। তাই পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে হাজার হাজার কাশ্মীরী সেদিন প্রাণ হারালেও আজও নিরব ইসলামাবাদ। সে দিনের নিহতদের মধ্যে বহু মুসলিম থাকলেও তাদের নিয়ে পাকিস্তানি সরকার বা জঙ্গি সংগঠনগুলো আজও কোনও মন্তব্য করেনি।

বরং এখনও কাশ্মীরি মুসলিমদের হত্যা করতে জঙ্গিদের মদদ দিয়ে চলেছে পাকিস্তানি-সেনারা। মুসলিমদের প্রতি পাকিস্তানের কোনও দরদই প্রকাশ পায়নি। হিন্দু-মুসলিম-শিখসহ সকল সম্প্রদায়ের মানুষকেই সেদিন কোতল করেছিল পাকিস্তানিরা।

বারামুলা শহরেই পাকিস্তানি-হানাদারদের হাতে প্রাণ হারান ১৪ হাজার মানুষ। ধর্ষিতা হয়েছিলেন বহু কাশ্মীরী নারী।

বর্বরতার চরম সীমায় পৌঁছেছিল সেদিন পাকিস্তানি-হানাদারদের আক্রমণে। অথচ আজও পাকিস্তান সেই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেনি। হাজার হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করার পরও পাকিস্তানি-নাগরিকেরা কখনও দুঃখ প্রকাশ করেনি। এমনকী, বহু নারী ধর্ষিতা হলেও নিরব পাকিস্তানের তথাকথিত মানবতাবাদীরাও।

নিজেদের ব্যর্থতা নিয়েই তাদের যতো মাথাব্যাথা। অথচ তাদের কারণে কাশ্মীরের বহু মানুষ প্রাণ হারালেন, পাকিস্তানি আদিবাসীদের বর্বরতার শিকার হলেন বহু কাশ্মীরি মুসলিম। বহু নারী হারালেন তাদের সম্ভ্রম, তাদের ইজ্জত।

অথচ পাকিস্তানিরা সে বিষয়ে আজও নিরব। কাশ্মীর নিয়ে এতো কথা বললেও পাকিস্তানি হামলাবাজদের সেদিনের নৃশংসতাকে নিয়ে টুঁ শব্দটিও করতে নারাজ ইসলামাবাদ।

কিন্তু সত্য কখনও ধামাচাপা থাকে না। পাকিস্তানি ফৌজি কর্তার বয়ানেই উঠে এলো প্রকৃত সত্য। গোটা দুনিয়ার সামনে আজ স্পষ্ট, সেদিন বর্বরতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছিল পাকিস্তান। কাশ্মীরেও যে তারা গণহত্যা চালিয়েছে তা সেই ঘটনার স্বাক্ষী, খোদ পাকিস্তানি সেনাকর্তাই তারই বইতে তুলে ধরেছেন। পাকিস্তান-সেনার অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আকবর খান তার লেখা বইতে বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেছেন কাশ্মীর আক্রমণের যাবতীয় কৌশল ও ঘটনা প্রবাহ। আর এই আক্রমণ যে পাকিস্তানি রাষ্ট্রনায়কদের নির্দেশেই সেনাবাহিনী করেছিল, সেটাও জেনারেল সাহেবের বর্ণনায় স্পষ্ট।

পাকিস্তানের হতাশা ও ষড়যন্ত্র সবই উঠে এসেছে বইটিতে। কাশ্মীর পেতে মরিয়া দেশটি অত্যাচার ও বর্বরতার সমস্ত রাস্তাই সেদিন ব্যবহার করেছিল। মহারাজা হরিসিং-এর কাছ থেকে কাশ্মীর ছিনিয়ে নিতে সেখানকার বাসিন্দাদের ওপর শুরু হয়েছিল ভয়ঙ্কর অত্যাচার। পাকিস্তানি হানাদারেরাই মহারাজ হরি সিংকে বাধ্য করেছিল ভারতীয় সেনা সাহায্য নিতে।

কাশ্মীরের মানুষকে বাঁচাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তা ছাড়া সেদিন আর কোনও পথই ছিল না তার সামনে। এরপরই তো কাশ্মীর ভারতভুক্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। আন্তর্জাতিকভাবেই সেই চুক্তি স্বীকৃত।

তারপর থেকেই কাশ্মীর ভারতের অংশ হিসেবে গোটা দুনিয়াতেই স্বীকৃত। কারণ এই অন্তর্ভুক্তি প্রক্রিয়াটিতে অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয় ভারতের স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭। মেজর জেনারেল (অব.) আকবর খান তার বইটিতে এসব বিষয়ও অবতারনা করেছেন। বহু প্রকৃত সত্য উঠে এসেছে পাকিস্তানি সেনাকর্তার কলামে।

'রেইডার্স ইন কাশ্মীর' বা 'কাশ্মীরের হামলাকারী' বইটিতে আকবর তুলে ধরেছেন পাকিস্তানি জন নেতারা কীভাবে সেনাকে ব্যবহার করেছিল সেদিন। তাদের একটাই লক্ষ্য ছিল, কাশ্মীর দখল। তারজন্য সেখানকার মানুষদের খুন বা ধর্ষণ করতেও পিছপা হয়নি সেনারা।

ওপর মহলের নির্দেশই ছিল, কাশ্মীর চাইই। তারজন্য যা খুশি তাই করো। মহারাজার ওপর চাপ বাড়াতে পাকিস্তানি-বাহিনীর যাবতীয় কৌশল উঠে এসেছে বইটিতে। মহারাজ বাধ্য হয়েছিলেন ভারতের সাহায্য নিতে।

অবশ্য মহারাজা হরি সিং প্রথম   থেকেই চেয়েছিলেন স্বাধীন কাশ্মীর অথবা ভারতে যোগদান। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে কখনই য়েতে চাননি তিনি। কিন্তু  পাকিস্তানি রাজনৈতিক শক্তি সেনাকে কাজে লাগিয়ে দখল করতে চেয়েছে কাশ্মীর।

কাশ্মীরে পাকিস্তানি হানার ইতিহাস অবশ্য সকলেরই জানা। এর স্বপক্ষে বহু তার প্রমাণও রয়েছে। ঐতিহাসিকরা আগেও বহুবার তুলে ধরেছেন সেই তথ্য।

কিন্তু পাকিস্তানি রাজনৈতিক জগতের সঙ্গে সেনাদের সম্মিলিত এই আক্রমণের ছক এবং নরসংহারের বিস্তারিত তথ্য সে দেশেরই একজন সেনাকর্তার লেখায় এর আগে সেভাবে উঠে আসেনি। কাশ্মীরি জনগণের ওপর নেতাদের নির্দেশে পাকিস্তান-সেনা ও তাদের মদদকারী পাঠান বা অন্যান্য জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ যে বর্বরতার পরিচয় সেদিন দিয়েছে, সেটিও উঠে এসেছে বইটিতে।

আর পুরোটাই হয়েছে, পাকিস্তানি রাষ্ট্রনায়কদের ইচ্ছায়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ পাকিস্তানের নেতারা সকলেই জানতেন কাশ্মীরের সেই ভয়ঙ্কর সেনা-সন্ত্রাসের ঘটনা। আকবরের বই থেকে স্পষ্ট, তাদের মদদেই হয়েছে সেনা-সন্ত্রাস।

মহারাজা হরি সিং ও কাশ্মীরের বাসিন্দাদের আতঙ্কিত করে তোলাই ছিল পাকিস্তানের কৌশল। রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশেই পাকিস্তানি সেনারা বেআইনিভাবে কাশ্মীর আক্রমণ করে।  আসলে জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তানি নেতাদের আরও ক্ষমতা, আরও এলাকা এবং আরও প্রভাব-প্রতিপত্তির নেশা গ্রাস করেছিল।

১৯৪৭-এর ৮ মাস যুদ্ধে কাশ্মীরের মাটিতে মানবাধিকারকে লুন্ঠিত করেছে পাকিস্তানি-সেনারা। উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল মানুষ খুনে। নির্বিচারে কাশ্মীরিদের হত্যা করে।আজও সেই ধারাই চলছে উপত্যকায়। ফলে আকবরের বইটি অত্যন্ত সময়োপযোগী।  

কাশ্মীরের তরুণদের অনেক ভুল ধারণাই লোপ পেতে পারে।  দেরিতে হলেও পাকিস্তানি সেনাকর্তার লেখা 'রেইডার্স ইন কাশ্মীর' হামলাকারীদের চিনতে অনেককেই সাহায্য করবে। বইটি অনলাইনে পিডিএফ ফরম্যাটেও পাওয়া যাচ্ছে।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য ফুলভিও মার্টোসসিলো আহবানঃ

এদিকে কাশ্মীরের একটি অংশ দখল এবং এর শাসক মহারাজা হরি সিংহকে সিংহাসনচ্যুত করার ক্ষেত্রে ইসলামাবাদের ভূমিকা নিয়ে বলতে গিয়ে উপত্যকার চলমান অশান্তির জন্য পাকিস্তানের জবাবদিহিতা নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানিয়েছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য ফুলভিও মার্টোসসিলো।

১৯৪৭-৪৮ সালের কাশ্মীর যুদ্ধের স্মরণে ২৬ অক্টোবরকে ‘কালো দিবস’ পালন করে পাকিস্তানের ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টারও সমালোচনা করেন ফুলভিও মার্টোসসিলো। সম্প্রতি ইইউ ক্রনিকলে লেখা এক নিবন্ধে পাকিস্তানের কাশ্মীর আক্রমণ নিয়ে এই সমালোচনা করেন তিনি।

ইসলামাবাদের প্রতারণামূলক আগ্রাসনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, পাকিস্তান একদিকে কালো দিবস পালন করে দেশটির ক্ষয়ক্ষতির কথা স্মরণ করে। কিন্তু কাশ্মীরে আক্রমণ করে জাতিগত নির্মূল ও নির্যাতনের সময় যে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তা মনে করে না। বারমুলা শহরে ১৪ হাজার কাশ্মীরি হিন্দু, মুসলিম ও শিখকে জবাই করা হয়েছিল। 

তিনি বলেন, পাকিস্তান হলো এমন একটি দেশ, যা শুধু নিজের ব্যর্থতা নিয়ে আর্তনাদ করে।

নিবন্ধে তিনি আরো লেখেন, পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কাশ্মীরে আক্রমণ চালায়।

মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে কাশ্মীরকে সংযুক্ত করার জন্য অবৈধভাবে কাশ্মীর দখল করে এবং শাসক হরি সিংহকে ক্ষমতাচ্যুত করে। অঞ্চলটিতে শক্তি, ভূখণ্ড বৃদ্ধি এবং প্রভাব বাড়ানোর জন্য পাকিস্তানের করা দুর্দান্ত একটি নীলনকশার অংশ ছিল ওই সামরিক পদক্ষেপ। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দেশটির সামরিক বাহিনী তাতে ব্যর্থ হয়েছে। 

ফুলভিও মার্টোসসিলো কাশ্মীরে চলমান অশান্তির জন্য ইসলামাবাদকে দোষী সাব্যস্ত করে অবশ্যই তার জবাবদিহি করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন।

এস এস