ন্যাভিগেশন মেনু

চিনে বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত বাণিজ্যিক সুবিধাঃ বর্তমান সরকারের বিশাল এক কূটনৈতিক সফলতা


তরুণ কান্তি দাস (কান্তি)

১ জুলাই থেকে বাংলাদেশের শুল্ক পণ্যের ৯৭ শতাংশে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিল চিন সরকার।“চিনের স্টেট কাউন্সিলের কাস্টমস ট্যারিফ কমিশন সম্প্রতি এ সুবিধা প্রদান করে নোটিস জারি করেছে।” যদিও আগে থেকেই এশিয়া প্যাসিফিক ট্রেড এগ্রিমেন্টের (এপটিএ) আওতায় ৩০৯৫ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করে আসছিলো বাংলাদেশ,তারই ধারাবাহিকতায় এবারকার চুক্তিতে সব মিলিয়ে ৮২৫৬ বাংলাদেশী পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিল চিন সরকার।

উল্লেখ্য,স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে দীর্ঘ পরিক্ষীত বন্ধু প্রতিম রাষ্ট্র হিসেবে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহযোগিতার চলমান ধারা হিসেবে নতুন এ সুবিধা প্রদান, বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক ও কূটনীতির প্রজ্ঞার এক বিশাল সফলতার অংশ হিসেবে দেখছেন দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরা। চিনের ওপর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন-নির্ভরতা অনেক বেশি। চিন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। “ফ্রেন্ডস অফ সিল্ক রোড” বাংলাদেশ (এফওএসআর) ও বাংলাদেশ-চায়না বিজনেস এ্যাসোসিয়েশন (বিসিবিএ)-এর বিশেষজ্ঞদের মতে, এফটিএ চুক্তি এবং প্রস্তাবিত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’বাস্তবায়িত হলে ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে ঐক্য আরো জোরালো হওয়ার পাশাপাশি এ অঞ্চলের সাবিক অর্থনীতি আরো অনেক বেশি শক্তিশালী হবে।

গণচিনের মাননীয় প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং বলেন, ‘আমরা বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প বাস্তবায়নকে এ অঞ্চলে শান্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করছি। উন্মুক্ত উন্নয়নকে উৎসাহিত করা এবং সুষ্ঠু, যৌক্তিক ও স্বচ্ছ বিশ্ববাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিধিব্যবস্থা গড়ে তোলার এখনই উপযুক্ত সময়। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা কিংবা আমেরিকা—যেখানকার দেশই হোক না কেন, বেল্ট অ্যান্ড রোড পরিকল্পনায় তাদের সবারই সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব থাকবে।’এশিয়ার অর্থনীতি পাল্টে দিতে পারে, ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্প। চিন দুটি ‘ইকোনমিক করিডর’ সৃষ্টি করছে। একটি খুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক ও রেলপথ। দ্বিতীয়টি চিনের শিন্জিয়াং থেকে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গাওদার সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত রেল ও সড়কপথ।

‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’—অর্থাৎ এক অঞ্চল এক পথ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর চিন। চিনের সঙ্গে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের অন্তত ৭০টি দেশের জলে ও স্থলে সংযোগ স্থাপনের (কানেকটিভিটি) পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এসব অঞ্চলের অবকাঠামো নির্মাণ, ভাষা ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক উন্নয়ন, শিক্ষা ও চিকিৎসাখাতের উন্নয়ন বিনিময়, প্রধান প্রধান শহরগুলির মধ্যে ‘সিস্টার সিটি’পারস্পারিক সম্পর্ক স্থাপন ও বাণিজ্য বৃদ্ধি করনের নানা পরিকল্পনাও রয়েছে। স্থলভিত্তিক সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট এবং সমুদ্রগামী মেরিটাইম সিল্ক রোড এই উদ্যোগের অন্তর্ভুক্ত। ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডকে সংক্ষেপে ‘ওবর’ অথবা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ ইনিশিয়েটিভও বলা হচ্ছে। প্রকল্পটিতে অর্থায়নের জন্য এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এ.আই.আই.বি) নামে চিনের নেতৃত্বে ১০ হাজার কোটি ডলারের মূলধনে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ ছাড়া চার হাজার কোটি ডলারের সিল্ক রোড তহবিল গঠন করেছে চিন। সম্প্রতি সীমান্তে উত্তেজনার মধ্যেই ভারতকে ৫৭০০ কোটি রূপি ঋণ দিবে এআইআইবি (চিনা ব্যাংক)। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাচ্ছে দেশটি। প্রকল্পটির ব্যাপারে চিনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয়েছে ৪৪টি দেশের সমঝোতা স্মারক। চিনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত দেশগুলোকে আগ্রহী করে তোলার জন্য এর মধ্যে ২০টিরও বেশি দেশ সফর করেছেন। এই নতুন রুটের চিনা স্বপ্নদ্রষ্টা তিনিই। ২০১৩ সালের অক্টোবরে বিশ্বের সামনে তিনি এই পরিকল্পনা তুলে ধরেন। বর্তমানে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড বা ‘ওবিওআর’ বিশ্বের একটি আলোচিত বিষয়।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র তৈরি ও বিশ্বায়নে অবদানের জন্য চিনের ভূয়সী প্রশংসা করেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

২০১৮ সালে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের ১৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ হয়েছে চিনের সঙ্গে। বাংলাদেশের আমদানির বৃহত্তম উৎস হচ্ছে চিন। বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক খাত, তার কাঁচামালের জন্য চিনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে। চামড়াজাত পণ্য এবং ওষুধ উৎপাদনের জন্যও চিন থেকে বাংলাদেশ কাঁচামাল আমদানি করে থাকে।

বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের যে প্রবৃদ্ধি, তা’অনেকাংশেই চিনা বিনিয়োগের কারণে বেড়েছে। চিন বর্তমানে বাংলাদেশের পরিবহন ও জ্বালানি খাতসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। চিনা অবকাঠামো নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে। যদিও বৈশ্বিক মহামারী কভিড-১৯-এর কারণে ইদানিং এগুলোর কার্যক্রম অনেকটা মন্থর গতিতে চলছে, পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘কারো সাথে বৈরিতা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্ব’জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর এই পররাষ্ট্র নীতি মেনে চিন ও বাংলাদেশ এই বৈশ্বিক মহামারীতে একে-অপরের মানবিক সহযোগিতার পরিপূরক হিসেবে সম্পর্ক আরো বেশি সুদৃঢ় রেখে চলেছেন। চিন সরকার এই দুর্দিনে স্পেশাল চ্যাটার্ট উড়োজাহাজে চিনের সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসা সামগ্রী, সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে ডাক্তার ও বিশেষজ্ঞ দল পাঠিয়ে আমাদের পাশে দাড়িয়েছে। ইতোমধ্যে চিনা দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন মিঃ হুয়া ইয়েন লোং সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন,“করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য সফলভাবে কোনো ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারলে বাংলাদেশকে যাবতীয় সহযোগিতা ও সহায়তার অগ্রাধিকার দিবে চিন”। যদিও কভিড-১৯ চলাকালীন সময়ে চলমান প্রকল্পগুলির নির্মাণসামগ্রীর সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে নিযুক্ত অনেক চিনা শ্রমিকও তাদের দেশে আটকা পড়েছেন। ফলে প্রকল্পগুলো শেষ হতে নির্ধারিত সময় বৃদ্ধি ও কিছুটা ব্যয় বৃদ্ধিও পেতে পারে। একারণে বাংলাদেশ সরকারের আরো অর্থ নেয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে, যার অর্থ হচ্ছে, ঋণের বোঝা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পাওয়া।

বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি চিনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে এবং বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণও অনেক বেশি। বর্তমানে চিনে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশী পণ্যের মধ্যে তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া, মাছ ও কাঁকড়া, প্লাষ্টিক বর্জ্য, ফুল, সব্জি ও ফল, মসলা এবং তামাক ইত্যাদি। এর মধ্যে বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রক্রিয়াজাত চামড়ার ৬০%-এরও বেশি রপ্তানি হয় চিনে। এছাড়া অপ্রক্রিয়াজাত চামড়ারও একটি বড় অংশ রপ্তানি হয় চিনে।

আর সেক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেলে চামড়াজাত অন্যান্য পণ্যদ্রব্য যেমন জুতা, ব্যাগ এবং আনুষাঙ্গিক পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের।

অন্যদিকে, বর্তমানে বাংলাদেশী তৈরি পোশাক উৎপাদকেরা সারা পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ২১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে থাকেন। আর এর মধ্যে মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয় চিনে। বিশ্বে তৈরী পোশাকের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ চিন, আর দেশটি প্রতিবছর ৩৩৮ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করে থাকে। চিনের মোট চাহিদার একটি অংশ যদি বাংলাদেশ পূরণ করতে পারে, সেটি বাংলাদেশের রপ্তানি আয়কে বহুগুন বাড়িয়ে দেবে।

চিনের বাজারে ৯৭% বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার ঘোষণাটিকে কাজে লাগানোর জন্য এখুনি সরকারের দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া উচিত। আর সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে দুই দেশের মধ্যে বানিজ্য ঘাটতির পরিমানও অনেকটাই কমে যাবে।

চিনের বাজারে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এখন প্রায় ৮২৫৬ টি পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। আর সেই সঙ্গে দেশটিতে বাংলাদেশী পণ্যের রপ্তানির পরিমানও প্রতিবছর নিঃসন্দেহে অনেক বেশি বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশে ইতোমধ্যে এপটিএ (এশিয়া-প্যাসিফিক বাণিজ্য চুক্তি) এবং চিন স্বল্পোন্নত দেশগুলির জন্য একতরফা শুল্ক উদারীকরণের অধীনে চিন থেকে অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা আচরণ উপভোগ করছে। বাংলাদেশ চিন থেকে মূলত মেশিনারি, তুলা, ভোক্তা পণ্য এবং রাসায়নিক পণ্য আমদানি করে ও পাট, পাটজাত পণ্য, তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত চামড়া ইত্যাদি রফতানি করে আসছে।

চিন ২০১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের সাথে একটি এফটিএ প্রস্তাব করেছিল। তবে চিনের শুল্কমুক্ত বাজারে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশ আরও বাণিজ্য সুবিধা এবং পোশাক আইটেম রফতানি করতে চিনকে অনুসরণ করেছে। চিন থেকে স্বল্পমূল্যের পণ্য আমদানিও ভোক্তাদের পাশাপাশি নির্মাতাদের জন্যও উপকারে আসবে। এটি বাংলাদেশকে আরও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সহায়তা করতে পারে। চিনের সাথে একটি এফটিএ থেকে সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী দেশের কৃষক খাদ্য, চামড়া ও টেক্সটাইল, জনশক্তি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে যুক্ত বাংলাদেশী শিল্প ও সেবা খাতগুলি সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে।

দু'দেশের মধ্যে বিদ্যমান সহযোগিতার লক্ষ্য অর্থনৈতিক বিনিময় ও বাণিজ্য বৃদ্ধি, অবকাঠামো, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, পরিবহন, তথ্য, টেলিযোগাযোগ এবং কৃষির মতো ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প গড়ে তোলা এবং বাংলাদেশ-চিন এর মধ্যে ‘বিসিআইএম’ অর্থনৈতিক করিডোরের অধীনে বাস্তব সহযোগিতা জোরদার করা। ভারত, মায়ানমার ও চিন এখন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। তবে চিন তার বাণিজ্য লক্ষ্য হিসাবে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত চায় না। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে আরও প্রতিযোগিতামূলক পণ্য আমদানি করাই চিনের প্রধান লক্ষ্য। চিন ও বাংলাদেশের মধ্যে এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে বাংলাদেশের পক্ষে চিনকে আরও বেশি পছন্দসই পণ্য, পরিসেবা এবং বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া সম্ভব হবে।

আমার মতে, বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের বিশেষজ্ঞরাও বাংলাদেশ ও চিন এবং কিছু অন্যান্য দেশের মধ্যে এফটিএ চুক্তি স্বাক্ষরকে স্বাগত জানাবেন। সাধারণত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের জন্য দেশগুলির 'প্রাকৃতিক অংশীদার' বিবেচনায় উভয় পক্ষের পারস্পরিক স্বার্থের উপরেই নির্ভর করে। বাংলাদেশের পক্ষে এফটিএর সম্ভাব্য অংশীদার হবেন আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, চিলি, চিন, চিনা থাইপেই, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, কোরিয়া, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইউক্রেন।

শীর্ষ দশটি রফতানিকারক পণ্যের তালিকায় ভারত, চিন এবং বাংলাদেশের সাধারণ পণ্য নেই বললেই চলে। এছাড়াও পারস্পারিক প্রতিযোগিতার মাত্রাও খুব কম। বাংলাদেশ ও চিনের মধ্যে প্রস্তাবিত এফটিএ স্বাক্ষর নিয়ে প্রতিবেশি রাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য প্রতিযোগিতা বিবেচনায় কিছুটা উদ্বেগ থাকলেও থাকতে পারে। এই চুক্তির কারণে বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশি বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ঐতিহ্যগত সম্পর্কের কোনো ব্যাত্যয় বা প্রত্যয় ঘটারও কথা নয়। যদিও দীর্ঘমেয়াদে সর্বমোট বাণিজ্যের একটি বিশেষ অংশ চিনের দখলে যেতে পারে। তদুপরি, ভবিষ্যতে চিন থেকে বস্ত্র ও অন্যান্য পণ্যগুলির আমদানির চাহিদা, যার বেশিরভাগই তৈরীজাত করে বাংলাদেশ বৃহৎ আকারে রফতানি করে আসছে,পরবর্তিতে চিনা বাজারে একই জাতীয় অন্য রাষ্ট্রের পণ্যগুলির চাহিদা কিছুটা হ্রাস পেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলির উচিত হবে উদ্বেগ কমিয়ে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রচারকে আরও শক্তিশালী করে বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্যে সুসম্পর্ক জোরদার করা। উল্লেখ্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া মুক্ত বাণিজ্য (সাফটা) চুক্তির মাধ্যমে ইতোমধ্যে একটি এফটিএ চুক্তিও রয়েছে।

বাংলাদেশের পক্ষে, চিনের সাথে এফটিএ চুক্তি একটি সুবর্ণ সুযোগের প্রতিনিধিত্ব করে,যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে প্রবেশাধিকার দিয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশী ব্যবসায়ের জন্য তাদের পাকিস্তানি, মালদ্বীপ, চিলিয়ান, কোস্টারিকান এবং পেরু প্রতিযোগিদের মধ্যে খেলার সমতল ক্ষেত্র তৈরিতে সহায়তা করবে।

যদিও একটি ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ রয়েছে যা বাংলাদেশ এবং চিনের মধ্যে এফটিএ সম্পর্কিত চুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের পক্ষ থেকে অনেকটা বাণিজ্য প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ মনে হতে পারে। বাংলাদেশ সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র দেশ যার বর্তমান আকার এবং অর্থনীতির স্তর অনুযায়ী এই সরকারের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশেষ সফলতার কারণে এতদিন পরে একক দ্বিপাক্ষিক এফটিএতে স্বাক্ষর করতে পারলো। চিন বা অন্য যে কোনও বৃহত্তর অর্থনীতির সাথে এফটিএ সই করানো বাংলাদেশের স্থানীয় শিল্পের আগ্রহকে ক্ষুন্ন করবে এমন যুক্তি মোটেও সময়োপযোগী নয় এবং যার কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই। যদি এই যুক্তিটি এখনও সঠিক হয়, বিশ্বের কোথাও কোনও স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রের সাথে এরকম এফটিএ স্বাক্ষরিত হতো না।

বাংলাদেশের রফতানি উন্নয়নে অর্থনীতির বাজারগুলিতে আপাতদৃষ্টে অন্য কোনো শুল্কমুক্ত ও কোটা-মুক্ত প্রবেশের প্রয়োজন পড়বে না। এই ধরনের সুবিধাগুলি এখন চিনের মতো ইচ্ছুক অংশীদারদের সাথে আলোচনা করাই শ্রেয়। চিন, বা ভারত সহ অন্য যে কোনও দেশের সাথে বাংলাদেশের সাথে বরাবরই সুদৃঢ় বাণিজ্য সুসম্পর্ক রয়েছে । এই দুটি বাজারে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলির সাথে প্রতিযোগিতা করার জন্য এখন থেকে বাংলাদেশেরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউর সাথে এফটিএর সন্ধান করা উচিত।

চিন যেহেতু ভোগ ভিত্তিক অর্থনীতির দিকে এগিয়ে চলেছে, তাই ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলস্বরূপ চিনের সাথে মুক্ত বাণিজ্য থেকে সম্ভাব্য সুবিধাভোগী হিসাবে বিভিন্ন ধরণের পরিসেবা থাকাটাই স্বাভাবিক। এটি বাংলাদেশকে বেকারত্বের হার হ্রাস করতে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি নতুন পথ খুলতে সহায়তা করতে পারে। এফটিএর সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী ও বিজয়ীদের মধ্যে কৃষি-খাদ্য, চামড়া, টেক্সটাইল, জনশক্তি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে যুক্ত বাংলাদেশী খাতগুলিকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে, যেহেতু এ জাতীয় পণ্যগুলির জন্য চিনা বাজারে আভ্যন্তরীণ চাহিদা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।

বাস্তবতা হলো‘‘ভারতের বাজারে আমাদের তৈরি পোশাক একটা জায়গা করে নিয়েছে৷ এটা আমাদের যেভাবেই হোক ধরে রাখতে হবে৷ শুধু শুল্ক-মুক্ত সুবিধাই নয় বা চিনের শুল্ক বাড়ানো নয়, আমাদের পোশাকের কোয়ালিটিও ভালো৷ সবকিছু মিলিয়েই ব্যবসায়ীরা যখন দেখেন কোথায় ব্যবসা করলে বেশি লাভ, তারা তো সেখানেই ব্যবসা করবেন এটাই স্বাভাবিক। সেই হিসেবে ভারতের মার্কেট যেমন বড় তেমনি নিকটতম প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় ‘পরিবহন খরচ’ অনেক কম। সেখানে মধ্যবিত্তের সংখ্যাও বাড়ছে, যারা বাজার থেকে পোশাক কিনেই গায়ে দিতে চায় এবং মূলত সেই ধরনের মানুষদের কাছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে রপ্তানি বাড়ছে অনেক গুন।’’

২০১৭ সালে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে আয় হয়েছে ২৮ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালের পূর্ণাঙ্গ-নিখুঁত হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি, তাতেও ৩০ বিলিয়ন ডলার পার হয়েছে নিশ্চিত। ২০২১ সাল নাগাদ এটা ৫০ বিলিয়নে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। ‘‘এভাবে প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকলে ২০২১ সালে না হলেও ২০২৪ সালের মধ্যে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা নিশ্চিত সম্ভব হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’’ কারণ সদ্য বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩,৪১৩ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এই আয় ছিলো আগের অর্থবছরের চেয়ে ১১ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানিতে আয় হয়েছিল ৩ হাজার ৬১ কোটি ডলার।

পোশাক রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে দেশের সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি আয় ৪০ বিলিয়ন বা ৪ হাজার কোটি ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। শেষ পর্যন্ত বিদায়ী অর্থবছরে রপ্তানি আয় ৪,০৫৩ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এই আয় আগের অর্থবছরের চেয়ে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩,৬৬৬ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় হয়েছিল।

ইপিবির তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে ১০১ কোটি ডলার আয় হয়েছে। যদিও এ ক্ষেত্রে রপ্তানি কমেছে ৬ শতাংশের বেশি। কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যে ৯০ কোটি ৮৯ লাখের বেশি ডলারের রপ্তানি আয় হয়েছে। এই আয় ২০১৭-১৮ অর্থবছরের চেয়ে ৩৪ দশমিক ৯২ শতাংশ বেশি ছিলো। এছাড়া পাট ও পাটপণ্য রপ্তানিতে ৮১ কোটি ডলার আয় হয়েছে, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের চেয়ে ২০ দশমিক ৪১ শতাংশ কম।

প্রতিবছর আমদানি শুল্ক থেকে আদায় করা মোট আয়ের বেশিরভাগই চিনা পণ্যগুলির থেকে আয় করে এই আমদানি শুল্ক ।

চিন থেকে আগত পণ্যগুলি ১৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি এবং প্রতি বছর বাংলাদেশ আমদানি শুল্ক হিসাবে সরকার ২৩,০০০ কোটি টাকা আয় করতো। এটাও সত্য যে, সরকার এখন এই আয়ের অংশটি পাবে না।


আগামী বছরের মধ্যে ৬০ বিলিয়ন ডলার রফতানির যে স্বপ্ন উদ্যোক্তারা বুকে ধারণ করেছেন তা পূরণ হবে নতুন মার্কেট সম্প্রসারণ ও এফটিএ করার মধ্য দিয়েই। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮ দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা হচ্ছে পোশাক রফতানির প্রচলিত মার্কেট। এই ২৯ মার্কেটের বাইরে এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি হচ্ছে। লাতিন আমেরিকার ব্রাজিল চিলি পেরু মেক্সিকো আর্জেন্টিনাসহ রাশিয়া দক্ষিণ আফ্রিকা অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড মধ্যপ্রাচ্য তুরস্ক চিন জাপান কোরিয়া ও ভারত অপ্রচলিত মার্কেটগুলোর অন্যতম। আশার কথা হলো প্রচলিত মার্কেটের রফতানি প্রবৃদ্ধি যখন কমছে তখন অপ্রচলিত এসব মার্কেটের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। অপ্রচলিত মার্কেটে পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি ভাল। এফটিএ-এর মাধ্যমে নতুন বাজার সম্প্রসারণসহ পোশাক রফতানি বাড়ানো সম্ভব হবে। এজন্য দ্রুত কয়েকটি দেশের সঙ্গে এফটিএ হওয়া অত্যন্ত আবশ্যকীয় ছিলো, যার প্রতিফলন হিসেবে চিনের সাথে বাংলাদেশের এই ৯৭% পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত-কোটামুক্ত বাণিজ্য চুক্তি অত্যন্ত সময়পযোগী যা’ নির্দ্বিধায় বলা চলে, বর্তমান সরকারের বিশাল এক অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সাফল্য।

লেখক: তরুণ কান্তি দাস (কান্তি), সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট,  বাংলাদেশ-চায়না বিজনেস্ এ্যাসোসিয়েশন্(বিসিবিএ), বাংলাদেশ,  সদস্য, আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।