ন্যাভিগেশন মেনু

জাতির পিতাকে হারানোর মহাশোকের দিন ১৫ আগস্ট


আজ বাঙালী জাতির জীবনে মহাশোকাবহ দিন ১৫  আগস্ট। ১৯৭৫ সালের এই দিনে পাকিস্তানপন্থী কিছু সেনা সদস্যের হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন জামার্নিতে স্বামী পরমাণুবিজ্ঞানী ড: ওয়াজেদ মিয়ার কাছে ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে ছিলেন আজকে সোনারবাংলা গড়ার কারিগর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কপাল জোরে দেশে না থাকায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। পরে দুইবোন ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী  ইন্দিরা গান্ধীর উদ্যোগে ভারতে গিয়ে নিশ্চিতে অবস্থান করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের দিল্লিতে কড়া নিরাপত্তায় থাকার ব্যবস্থা করে দেন।

পাকা ছয় বছর অবস্থানের পর জীবনের ঝুঁকি বুঝেও দলের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে ১৯৮১ সালে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পেছনে ছিল সুগভীর ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ১৯৭১ সালে তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে।

১৫ আগস্ট বাঙালী জাতির জীবনে সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়।  সাড়ে তিন বছর বয়সী সদ্যস্বাধীন দেশটিকে পুনরায় পাকিস্তান বানাতে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এ দিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১২ বছরের পুত্র শেখ রাসেলসহ পরিবারের ১২ সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। 

প্রশ্ন আসে- ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দেশের সামরিক সদস্য বাদে বেসামরিক ব্যক্তি বিদেশের কারা জড়িত ছিল । প্রথমেই চলে নাম চলে আসে পাকিস্তানের। তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে সাহস পায়নি। কিন্তু এদেশের কুলাঙ্গার সন্তানদের দিয়ে হত্যা করিয়েছে। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কিছু সময়ের মধ্যে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এর একদিন পর অর্থাৎ সাড়ে তিন বছর পর চিন বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে চিন-যুক্তরাস্ট্রসহ ইসলামি কয়েকটি দেশ পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। বাংলাদেশে স্বাধীনতা অপরদিকে ভারত তাঁর মিত্রদের নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। এক কোটি বাঙালী উদ্বাস্তুকে ভারতে আশ্রয় ও খাদ্য সংস্থান করে। যুদ্ধে ভারতের সাড়ে ১৭ হাজার সৈন্য শহীদ হন। যা শেখ হাসিনা সরকার সব সময় কৃতঙ্গতা ভরে স্মরণ করেন।      

ব্ঙ্গবন্ধুকে হত্যার বেনিফিসারি হয়েছিল তাঁর সরকারে ঘাপটি মেরে থাকা পাকিস্তানপন্থী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, উপ সেনা প্রধান জেনারেল  জিয়াউর রহমানসহ স্বাধীনতা বিরোধী চক্র। প্রশ্নে আসে বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয় তারই সরকারের মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক কি তখন ঘুমিয়ে ছিলেন, না কি জেগে ছিলেন? জেগেই ছিলেন। তিনিই নাটের গুরু। কেননা ঘটনার পরেই তিনি রেডিও অফিসে যান ও বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন।

অর্থাৎ তিনি প্রস্তুতই ছিলেন। যদি এই প্রস্তুতি তার থেকেই থাকে তাহলে তিনি জানতেন কি ঘটতে যাচ্ছে ও এর পরে তার করণীয় কি হবে। মোশতাক যে সেই পরিকল্পনামাফিক কাজ করেছে। ১৫ আগস্টের দিনভর তার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করলেই তা স্পষ্ট হয়।

প্রস্তুতি নিয়েই ছিল মোশতাক, হত্যাকান্ডের পরিকল্পনাও জানত। নিশ্চিত ছিল ঘটনার পরে তাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। মোশতাক বরাবরই পাকিস্তান ঘেসা ছিল। ঘাপটি মেরে ছিল বঙ্গবন্ধুর সহচর হয়ে। সুযোগ বুঝে দাও মেরে ফায়দা লুটেছে। এখন  প্রশ্ন দেখা দিয়েছে  কিছু সামরিক সদস্য ছাড়াও এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে বেসামরিক ব্যক্তি কারা জড়িত আছে।

মোশতাক ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে ভারত যান। তবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েও তার রহস্যজনক ভূমিকার কারণে ভারতের গোয়েন্দা বিভাগ প্রবাসী সরকারকে তার সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়।

মোশতাক প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের বিদেশমন্ত্রী হয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গড়তে উদ্যোগী হয়েছিল।  মোস্তাক গংদের উদ্যোগই মার্কিন বিদেশমন্ত্রী কিসিঞ্জারকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের বদলে কনফেডারেশনের খোরাক যুগিয়েছিল? মোশতাকের সহযোগী ছিল- তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, মাহবুব আলম চাষী ও কামাল সিদ্দিকী। তাদের ভূমিকা বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে মিলছে।

মাহবুব আলম চাষীর ভূমিকা ব্যাপক আলোচিত হলেও কামাল সিদ্দিকীর ভূমিকা এই আলোচনার বাইরে রয়ে গেছে। তিনি পরে খালেদা জিয়ার আমলে মুখ্য সচিব ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কূটকৌশল করে মোশতাকের পর ক্ষমতায় এসেছে- স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট/জেনারেল জিয়াউর রহমান, সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার থেকে রক্ষার জন্য মোশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে ও স্বাধীনতা বিরোধী জামাত নেতা গোলাম আজম গংদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়েছে।

ক্ষমতায় এসে সুবিধাভোগী এরশাদও এ বিষয়ে নিশ্চুপ ছিলেন।   ১৯৭১ সালে প্রবাসী সরকারের সময়  মোশতাকের চারপাশে কিছু অসামরিক শক্তির সমর্থন ছিল। যা  ৭৫ সালে মধ্যে অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে।

যাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য অনুসন্ধান করে ১৯৭২ সাল থেকে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনার আভাস মিলছে। ১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকায় পাকিস্তানের প্রথম স্বাধীনতা দিবসকে উৎসবের দিন হিসেবে নয়, উৎপীড়নের নিগড় ছিন্ন করার সঙ্কল্প নেয়ার দিন  হিসেবে পালনের ঘোষণা দিলেন।

সেইদিন থেকে বঙ্গবন্ধু ২৩ বছর দৃঢ়চিত্তে বাংলার মানুষকে নিয়ে স্বাধীকার অর্জনের জন্য সামনে এগিয়ে গেলেন।  যতকাল বাংলাদেশ থাকবে ততকাল বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আদর্শকে লালন করে দেশবাসী নিজেদের অস্তিত্ব অটুট রাখবেন। শোকসন্তপ্ত জাতি আজ নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধুকে বিশেষভাবে স্মরণ করছেন।

যাঁর গৌরবময় নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সেই মহান নেতাকে সপরিবারে হত্যা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক ঘটনা। ঘাতক দল ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁর নাম ইতিহাস থেকে চিরতরে মুছে ফেলবে। কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন সফল হয়নি।

ঢাকার যে বাড়িতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শহীদ হয়েছেন সেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি এখন জাতির অন্যতম আবেগময় স্মৃতিচিহ্নে পরিণত হয়েছে। আর তিনি বাঙালী জাতির প্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। ঘাতকরা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার যে পথ সৃষ্টি হয়েছিল সেখান থেকে দেশকে সরিয়ে বিপরীতমুখী করার উদ্দেশ্য ছিল তাদের বড় একটি লক্ষ্য। তাদের লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলিয়ে দেয়া।

মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো করা এবং যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্যে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল সেটা নস্যাত করে দেয়া। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে শুরু হয় ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র।

একটা পর্যায় দেশে এসেছিল যখন বঙ্গবন্ধুর নামটাও জাতীয় প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হতে পারত না। ইতিহাস থেকে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কের নাম মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। তরুণদের দীর্ঘকাল জানতে দেয়া হয়নি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস।

বঙ্গবন্ধুকে শুধু অস্বীকার করাই নয়, নানাভাবে তাঁর সম্পর্কে মিথ্যা বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে।  তাঁর অবদানকে নানাভাবে খাটো করা, এমনকি অস্বীকারও করা হয়েছে। কিন্তু কুচক্রীদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে।

এ দেশের ইতিহাসের সঙ্গে যাঁর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত- দেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় যাঁর স্থান, কোন হুকুম বা ফরমান দিয়ে তাঁর নাম মুছে ফেলা যায় না। তাঁর অবদানকে খাটো করা যায় না।

দেশকে তিনি ভালবেসেছেন অকৃত্রিমভাবে, দেশের মানুষও তাঁকে দিয়েছে হৃদয় উজাড় করা ভালবাসা। তাই খুনী, ঘাতকচক্র ও তাদের পৃষ্ঠপোষকের সব চক্রান্ত, চেষ্টা, তৎপরতা ব্যর্থ হয়ে গেছে।

বঙ্গবন্ধু শারীরিকভাবে আজ না থাকলেও মানুষের হৃদয়জুড়ে তাঁর অবস্থান। তাঁর হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। ঘাতকদের দন্ডাদেশ কার্যকর হয়েছে। তবে এখনও কয়েক ঘাতক পালিয়ে রয়েছে নানা দেশে।  তাদের অতিদ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে দন্ডাদেশ কার্যকরের ব্যবস্থা নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন সোনার বাংলা গড়ার।

সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার মাধ্যমেই তাঁর প্রতি সর্বোৎকৃষ্ট শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব। সে কাজটাই এখন করতে হবে। আর চাই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত ঘটনা বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনা যেন আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের ও একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের ইতিহাসকে কলঙ্কের দায় থেকে মুক্তি দেয়। জাতি এখন প্রহর গুনছে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনাকারীদের বিচার। তা হলেই জাতি শাপমোচনের সুযোগ পাবে। 

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করছেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার। শেখ হাসিনার দৃঢ় পদক্ষেপের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাকারীদের বিচার ও রায় কার্যকর হলেও এখনও হত্যার পরিকল্পনাকারীদের বিচার হয়নি।

এখন এই বিষয়টি আলোচনায় আসছে কারা এই ঘটনার পেছনে ছিল, তাদের পরিচয় কি? ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ড সংঘটনকালের তদন্ত ও বিচারের ফলে সংঘটনকারীদের সম্পর্কে জানা গেলেও এই কাজের মূল হোতারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।

পনেরো আগস্টের কালভোরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িসহ তিনটি বাড়িতে খুনীরা হত্যা মিশনে নামে। বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ কামাল, শিশু রাসেল, শেখ মনিসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের অনেককে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, খুনীদের বিচারের রায়ও কার্যকর করা হয়েছে।

খুনীদের মধ্যে যারা বিদেশে পালিয়ে রয়েছে তাদের দেশে এনে অবশ্যই ফাঁসি কার্যকর করা হবে।আগস্ট বাঙালী জাতির অশ্রু বির্সজনের মাস, শ্রদ্ধা সিক্ত বেদনার মাস। পনেরই আগস্টের সকল শহীদদের উদ্দেশ্যে অশ্রু এবং বেদনা নিয়ে মাথা নত করে হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা জানায় বাঙালী জাতি। বাংলাদেশ আজ রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। 

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অসম্ভবকে সম্ভব করেছে।  বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনাকারীদের চেহারা উন্মোচনে মোশতাকের সূত্র ধরে এগুনো গুরুত্বপূর্ণ।

এস এস