ন্যাভিগেশন মেনু

ড: আনিসুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধকালে সীমান্তে যাতায়াতের জন্য কারটি দিয়েছিলেন


বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান না ফেরার দেশে চলে গেলেন। বৃহস্পতিবার বিকাল  ৪টা ৫৫ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তিনি মারা গিয়েছেন। আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তাঁর ছেলে আনন্দ জামান, আজ সকালে তাঁর জ্বর আসে। বুকে ব্যাথাও বাড়ে। চিকিৎসকরা তাকে সিসিসি (ক্রিটিকাল কেয়ার সেন্টার) এ স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেন। সকালেই এসব তথ্য দিয়েছিলেন তাঁর ছেলে। রক্তে সংক্রমণের সঙ্গে পূর্বের নানা জটিলতা নিয়ে গত ২৭ এপ্রিল ৮৩ বছর বয়সী এই অধ্যাপককে রাজধানীর ইউনিভার্সেল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান-এর মৃত্যুতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।  এক শোকবাণীতে উপাচার্য বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের এমিরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলা একাডেমির সভাপতি ড. আনিসুজ্জামান ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ, গবেষক, লেখক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী।

তিনি ছিলেন প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক চেতনার একজন অসাধারণ গুণী ব্যক্তি। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান অসাধারণ অবদান রেখে গেছেন। তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ড. কুদরাত-এ-খুদা জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বলেও উপাচার্য উল্লেখ করেন।

উপাচার্য আরও বলেন, জাতির যে কোন সংকটকালে ও দুর্যোগময় মুহুর্তে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের আন্দোলনে অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান ছিলেন সামনের সারির একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। জাতির বাতিঘর হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান-এর মৃত্যুতে দেশ ও জাতির যে ক্ষতি হল তা কখনই পুরনীয় নয়। দেশের শিক্ষা, শিল্প ও সাহিত্য অঙ্গনে অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান মরহুমের রূহের মাগফেরাত কামনা করেন এবং তাঁর পরিবারের শোক-সন্তপ্ত সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

গত  ৯ মে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত ২৭ এপ্রিল হৃদরোগ সমস্যার পাশাপাশি কিডনি ও ফুসফুসে জটিলতা, পারকিনসন্স, প্রোস্টেটের সমস্যা ও রক্তে সংক্রমণের সমস্যা নিয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে রাজধানী ঢাকার ইউনিভার্সেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেও একই ধরনের সমস্যার কারণে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।

এরপর গত শনিবার অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) স্থানান্তর করা হয়।  জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। পিতার বাড়ি বসিরহাটে। ভারত ভাগের পর তার পরিবার এপার বাংলায় চলে আসেন।

তিনি ছয় দশকেরও বেশি সময় শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার আগে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনসহ পরবর্তী প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। এছাড়া ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদবিরোধী নানা কর্মকাণ্ডে সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব আনিসুজ্জামানের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে।

আনিসুজ্জামানের শিক্ষাজীবনের শুরু হয়েছিল কলকাতার পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে। এদেশে চলে আসার পর অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন খুলনা জেলা স্কুলে। এক বছর পরই পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন ঢাকায়। ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। সেখান থেকে ১৯৫৩ সালে আইএ পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।

তারপর ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালে স্নাতক সম্মান এবং এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন আনিসুজ্জামান। অনার্সে পেয়েছিলেন সর্বোচ্চ নম্বর। সেই কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছিলেন 'নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক'। ১৯৬৫ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরেন।

ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্রসঙ্গীত উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী আন্দোলন এবং ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তখন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

কাছাকাছি সীমান্ত হওয়ায় তিনি আগরতলায় চলে যান। সঙ্গে নিয়ে যান তাঁর প্রাইভেট কারটি। মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর কারটি ব্যবহার করা হয়েছে। আগরতলা থেকে পরে তিনি কলকাতা চলে যান। ঘরছাড়া শিক্ষার্থীদের যেন পড়াশোনার ব্যাঘাত না বা বিপথে চালিত না হয় সেজন্য তিনি ভারতে শরনার্থী শিবিরগুলোতে শিক্ষাদানেরও ব্যবস্থা করেছিলেন।

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত গণআদালতে তার ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। ১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আনিসুজ্জামানের উল্লেখযোগ্য রচনাবলির মধ্যে রয়েছে- 'স্মৃতিপটে সিরাজউদ্দীন হোসেন', 'শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ স্মারকগ্রন্থ', 'নারীর কথা', 'মধুদা', 'ফতোয়া', 'ওগুস্তে ওসাঁর বাংলা-ফারসি শব্দসংগ্রহ', 'আইন-শব্দকোষ', 'আঠারো শতকের বাংলা চিঠি' ও 'কাল নিরবধি'। বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, অলক্ত পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রিতে ভূষিত হয়েছেন।

সাহিত্যের জন্য ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণে ভূষিত হয়েছেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব।

এস এস