ন্যাভিগেশন মেনু

দেশমাতৃকার সেবায় শেখ রেহানা


এম. নজরুল ইসলাম

রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান তিনি। বেড়ে ওঠা রাজনীতির আবহে। জন্মের পর থেকেই দেখে এসেছেন, বাড়িতে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের আসা-যাওয়া। স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক অঙ্গনের মানুষদের সঙ্গে তাঁর নিত্য ওঠাবসা। 

কিন্তু নিজে এড়িয়ে চলেন সব ধরণের রাজনৈতিক যোগাযোগ। নিজে সবসময় থাকেন আড়ালে। কিন্তু এই আড়ালটা তাঁর মাহাত্ম্যকে একটুও ম্লান করেনি। বরং পাদপ্রদীপের আলোয় না এসেও তিনি যে দেশ ও মানুষের কল্যাণে যে অবদান রেখে চলেছেন তা তুলনাহীন। 

কল্যাণমন্ত্রে দীক্ষা তাঁর পারিবারিক সূত্রেই। মিতবাক এই নারী নিজেকে উৎসর্গ করেছেন দেশমাতৃকার সেবায়। তাঁর সেই নিরব নিবেদন সাদা চোখে সবার গোচরে আসে না। 

কী পরিচয় তাঁর? তিনি জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। তিনি বাংলাদেশের চতুর্থবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোটবোন। তিনি শেখ রেহানা আপন বলয়ে যিনি নিজেকে গড়েছেন সম্পূর্ণ আলাদভাবে। 

প্রচার এড়িয়ে চলেন সযত্নে। স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকেই চিনি তাঁকে। আমি তখন ঢাকা মহানগর ছাত্র লীগের সহকারী সাধারণ সম্পাদক। শেখ কামাল ভাইয়ের নৈকট্যে সময় কাটে আমাদের। কার্যোপলক্ষে, কখনও নিছকই কোনো কারণ ছাড়াই যাওয়া হতো ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনে। দেখেছি সেখানে। তখন তিনি নিতান্তই আটপৌরে, ঘরোয়া। 

অপরিচয়ের গণ্ডি পেরিয়ে নৈকট্য লাভের সুযোগ অনেক পরে। তখন তাঁর প্রবাস জীবন। ভাগ্যান্বেষণে প্রবাসী আমিও। দেশে, স্বাধীনতা উত্তরকালে যে ঘরোয়া, আটপৌরে তরুণীকে দেখেছি, প্রবাসে তাঁকেই পাই অন্য রূপে। জাতির জনকের কন্যা তিনি। 

অথচ জীবনটা তাঁর জন্য সহজ হয়নি। জীবনের অনেকটা পথ রীতিমতো লড়াই করেই কাটাতে হয়েছে তাঁকে।

বলতে গেলে জীবনের শুরুতেই জীবনযুদ্ধের সৈনিক তিনি। কৈশোর-উত্তীর্ণ বয়সে হারিয়েছেন মা-বাবা, ভাইদের। হারিয়েছেন স্বদেশের আশ্রয়। আশ্রয়হীন পরিবেশে দেশে দেশে ঘুরেছেন। নিরাপত্তা নিশ্চিত ছিল না কোথাও। 

ছিল না নিশ্চিত জীবন যাপনের নিশ্চয়তাও। লড়াই করেছেন। ভেঙে পড়েননি। উপার্জনের জন্য নিজেকে নিযুক্ত করতে হয়েছে নানা কাজে। বড়বোন শেখ হাসিনা এসেছেন রাজনীতিতে। 

আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী দলের নেতৃত্ব তুলে নিয়েছেন নিজের হাতে। শেখ রেহানা নেপথ্যে বড়বোনকে সব ধরণের সহযোগিতা করেছেন। শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়ে দেশে ফিরে আসেন, তখন তাঁর দুই সন্তান জয় ও পুতুলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন শেখ রেহানা। 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব  যেমন বিত্ত-বৈভব, সহায়-সম্পত্তির কথা কোনদিন চিন্তাও করতেন না। জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, দায়-দায়িত্ব এবং  বিপর্যয়কে হাসিমুখে গ্রহণ করতেন, শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাও বাবা-মায়ের মতই পার্থিব লোভের ঊর্ধ্বে থেকে সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত। শত কষ্টের মধ্যেও তাঁরা পিতা-মাতার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। 

রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হয়েও রাজনীতি থেকে নিজেকে সবসময় সরিয়ে রেখেছেন তিনি। তার পরও, বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ রেহানা অংশ নিতে যাচ্ছেন, এমন গুজব মাঝেমধ্যেই শোনা যায়। 

যদিও এসব কথা এখন পর্যন্ত গুজন হিসেবেই রয়ে গেছে। বাস্তবে এর কোনো প্রমাণ মেলেনি। তাই বলে তাঁকে রাজনীতি-বিচ্ছিন্ন কিংবা রাজনীতি-বিমুখ ভাবার কোনো কারণ নেই। যথেষ্ট রাজনীতি সচেতন তিনি। আড়াল থেকেই যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেওয়া যায়, তার প্রমাণ তিনি রেখেছেন। 

কয়েক বছর আগে লন্ডনে বসে বাংলাদেশের এক অনলাইন নিউজ পোর্টালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আজকের এই আধুনিক যুগে বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে দেশপ্রেমিক, শিক্ষিত ও মেধাবী তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করা এখন সময়ের দাবি। 

এই দাবিকে যারা উপেক্ষা করবেন, দেশবাসীর সামনে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’বিশ্বসংসারে এমন আড়ালচারী কিছু মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা নিভৃতে কাজ করেন দেশ ও মানুষের কল্যাণে। ব্যক্তিগত মোহের ঊর্ধ্বে উঠে দেশচিন্তায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন শেখ রেহানা। 

নিজেকে নিয়ে ভাবিত হতে না পারার বিরল শক্তি তিনি তিনি অর্জন করেছেন। পাদপ্রদীপের আলোয় নিজেকে আলোকিত করার সব সুযোগ ও সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এখন অব্দি নিজেকে রেখেছেন মোহমুক্ত। 

যারা পারিবারিকভাবে নিতান্ত সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত, রাজনৈতিক আবহে বেড়ে ওঠার পরও এমন নিভৃত জীবন কাটানো তাঁদের পক্ষে সম্ভব। ক্ষমতা কখনো শেখ রেহানার মোহভঙ্গ করতে পারেনি। কারণ তিনি সেই বিরল স্বভাবের আড়ালচারী মানুষদের একজন, যিনি নেপথ্যে থেকেও সুস্থ রাজনৈতিক ধারার আন্দোলন-সংগ্রামে ইতিবাচক শক্তির উৎস। 

শেখ রেহানার জীবনাচার লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই, তিনি সত্যের নির্মলতম আদর্শকে রক্ষা করেছেন। আত্মপ্রবঞ্চনা ও পরপ্রবঞ্চনার পঙ্কিল আবর্তের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেননি। সত্যকে তিনি ভয় করেননি। মিথ্যার সুবিধা ভোগে প্রবৃত্ত হননি কোনোদিন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ রেহানা অংশ নিতে যাচ্ছেন, এমন কথাও মাঝেমধ্যে শোনা যায়। এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়টিও স্পষ্ট করেছেন তিনি। বলেছেন, ‘রাজনীতি করার অধিকার তো সবার রয়েছে। রাজনৈতিক পরিবার বা প্রধানমন্ত্রীর সন্তান হওয়ার কারণে কেউ তো নিজের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে না।

তিনি নিজে কি রাজনীতিতে আসছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ রেহানা বলেছেন, দলের জন্য ত্যাগ-তীতিক্ষার পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ তাদের বঞ্চিত করে তিনি কোন পদ-পদবী গ্রহণ করবেন না। ঐ সাক্ষাৎকারে তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ, ‘আমি শুধু আমার সাধ্যানুযায়ী মানুষকে সাহায্য করে যেতে চাই। 

শেখ রেহানা খুব ভাল করেই জানেন ক্ষমতা অনেক সময় অনেক মানুষকে বদলে দেয়। সে বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন তিনি। না, নিজেকে বদলানোর কোনো ইচ্ছে তাঁর নেই। তাঁর মতে, ‘কোনো ক্ষমতাই বঙ্গবন্ধুর সন্তানদের বদলাতে পারে না।’

তিনি বলেছেন, ‘আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। জনগণের মধ্যে থেকে তৃণমূল থেকে রাজনীতি করে আমার বাবা হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের জনক। আমরা সেই বঙ্গবন্ধুর সন্তান, জনগণের মধ্যে এখনও আমরা খুঁজে ফিরি আমাদের মা-বাবা ও পরিবার সদস্যদের, সেই জনগণের ভালবাসা নিয়েই জীবনের বাকি সময়টুকুও পাড়ি দিতে চাই।’

কোন ক্ষমতা বা পদ-পদবীর প্রয়োজন নেই মন্তব্য করে ঐ সাক্ষাৎকারে  শেখ রেহানা বলেছেন, ‘আমাদের জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া আমরা বঙ্গবন্ধুর কন্যা। এই লন্ডনেও যখন রাস্তায় বের হই, তখন দেখি বিভিন্ন বর্ণের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে সম্মান করছে। 

সঙ্গে নিয়ে একটি ছবি তুলতে চাইছে। এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে আমাদের।’ কী অকুণ্ঠ উচ্চারণ! 

লেখক: সভাপতি, সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক।

এস এস