ন্যাভিগেশন মেনু

৯০তম জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি

নারীর ক্ষমতায়নে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অবদান


ঝর্ণা বাড়ৈ

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব একটি ইতিহাস, একটি অনুপ্রেরণার নাম। জীবন শুরু করেছিলেন শত প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে। নিজের আন্তরিকতা, প্রচেষ্টা ও মানসিক দৃঢ়তা দিয়ে এগিয়ে গেছেন তিনি।

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বাংলাদেশের ইতিহাসে নারীর ক্ষমতায়নের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং শ্রেষ্ঠ স্মরণীয় মানবী। বিশ শতকের প্রথমার্ধে নারী অবরোধের বেড়াজাল উপেক্ষা করে সাহসী পদক্ষেপে বেরিয়ে আসেন তিনি।

সহধর্মিণী হিসেবে নয়, রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে আজীবন প্রিয়তম স্বামী শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়াসঙ্গী ছিলেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ইতিহাসের কালজয়ী মহানায়ক শেখ মুজিবের অনুপ্রেরণাদায়িনী হয়ে পাশে ছিলেন।

বাঙালি জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে ধাপে বঙ্গমাতার অবদান রয়েছে। আর সেটা বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী হিসেবে নয়, একজন দক্ষ নারী সংগঠক হিসেবে। যিনি ধূপের মতো নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়সম আসনে অধিষ্ঠিত হতে সহায়তা করেছেন। 

বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির দীর্ঘ  সংগ্রাম, স্বাধীনতা ও  দেশ গঠনে মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির পিতার নামের সাথে শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত নামটি শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। যখনই আমরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কথা বলি তখনই বঙ্গমাতার নাম চলে আসে।

খোকা থেকে মুজিব, মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু এবং সবশেষে বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছনে যে নারীর অবদান অনস্বীকার্য তিনি আর কেউ নন, তিনি আমাদের নারী জাতির অহংকার শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

যিনি সোনার বাংলা বিনির্মাণে আড়ালে অন্তরালে থেকে রেখেছেন অসামান্য অবদান। যিনি কখনো নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগ বিলাসের কথা ভাবেননি । ভেবেছেন দেশ, দেশের মানুষ আর নেতা কর্মীদের কথা। বঙ্গবন্ধুর বন্দী জীবনে দক্ষ হাতে সামলিয়েছেন ছেলে-মেয়ে, সংসার  এবং ভেবেছেন নেতা কর্মীদের কথা। সেই দক্ষ সংগঠক মহিয়সী নারী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

১৯৩০ সালর ৮ আগস্ট শেখ মোহাম্মদ জহুরুল হক এবং হোসেন আরা বেগমের কোল আলো করে শ্রাবণ দুপুরে জন্ম নিল এক মহিয়সী নারী ফজিলাতুন্নেছা যার ডাক নাম রেনু । মাত্র তিন বছর বয়সে তিনি তাঁর পিতাকে হারান। তারপরে  দু’বছরের মাথায় তাঁর মাকেও হারান। বড় বোন জিনাতুন্নেছা, ডাকনাম জিন্নি ও ছোট বোন ফজিলাতুন্নেছা এই দুই শিশুর দায়িত্ব নেন বঙ্গমাতার দাদা শেখ মো. আবুল কাসেম।

দাদার ইচ্ছায় মাত্র তিন বছর বয়সের ফজিলাতুন্নেছার সাথে দশ বছরের শেখ মুজিবুর রহমানের বিয়ে হয়। শাশুড়ি সায়রা খাতুন এবং শ্বশুর শেখ লুৎফর রহমানের কাছে তিনি বাড়ির বউ হয়ে থাকেননি, থেকেছেন নিজের সন্তান হয়ে। শিশু অবস্থায় বিয়ে হলেও বঙ্গমাতার সংসার শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর এন্ট্রান্স পাশের পর ১৯৪২ সালে।

ফজিলাতুন্নেছা মুজিব স্থানীয় একটি মিশনারি স্কুলে ভর্তি হলেও তাঁর স্কুল জীবনের পড়ালেখা বেশি দূর এগোয়নি। তিনি ঘরে বসেই পড়ালেখা শিখেছেন। তাঁরা যখন সংসার শুরু করেন, তখন বঙ্গবন্ধুর বয়স ১৯ বছর আর ফজিলাতুন্নেছার বয়স ১০ বছর। স্বামী বাইরে থাকাকালীন সময়ে ফজিলাতুন্নেছা অবসর সময়ে বিভিন্ন রকমের বই পড়তেন, গান শুনতেন।

 বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবনের প্রেরণার বড় উৎস ছিলেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তার অনুপ্রেরনায় শেখ মুজিব হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু, হয়ে উঠেছেন শ্রেষ্ঠ বাঙালি ।

ফজিলাতুন্নেছার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ছিল অতুলনীয়। তিনি সবসময়ই বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে সাহস যোগাতেন। ‘বঙ্গবন্ধুকে যখন প্যারোলে মুক্তি দেয়ার কথা হয় তখন তিনি বাঁধা দেন। তিনি বলেন, আপনাকে নিঃশর্ত মুক্তি না দিলে আপনি প্যারোলে মুক্তি নেবেন না। স্বাধীনতার নেপথ্য সৈনিক হিসেবে ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বঙ্গবন্ধুকে সাহস যুগিয়েছেন । তিনি দেশের স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। তাই ইতিহাস থেকে তাকে সরিয়ে ফেলার কোন সুযোগ নেই।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের  ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণের সঙ্গে বঙ্গমাতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকারের  দায়ের করা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জন বাঙালি নৌ ও সেনাবাহিনীর সদস্য এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র্রদ্রোহের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করা হয়।

বঙ্গবন্ধু এ মামলায় বিচলিত না হয়ে আইনিভাবে মোকাবেলার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য আইনজীবীদের অর্থ জোগানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেন। এ মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলে বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দির মুক্তি দাবিতে বাঙালি রাস্তায় নামে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের রাজপথ বিক্ষোভে জনসমুদ্রে পরিণত হয়।

পূর্ব পাকিস্তানের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকেও গ্রেফতারের হুমকি দেয়। আন্দোলনের বেগবানতায় কার্যত তখন সরকার পিছু হটে। পাকিস্তান সরকার এ সময় লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্যারোলে মুক্তির সিদ্ধান্তে বেঁকে বসেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিনি প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে জোরালো আপত্তি জানান।

পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে প্যারোলে নয়; নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হবে। তিনি কারাগারে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে লাহোর বৈঠকে যেতে নিষেধ করেন। তিনি আরও বুঝতে পেরেছিলেন, শেখ মুজিবের ব্যাপারে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ। পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হবে।

ফজিলাতুন্নেছার পরামর্শে শেখ মুজিব অনড় থাকেন। প্যারোলে মুক্তির ক্ষেত্রে তিনি অসম্মতি প্রকাশ করেন। ইতিমধ্যে শেখ মুজিবের মুক্তি আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি লাভ করেন। পরদিন অর্থাৎ ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাঙালি তাদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি দিয়ে বরণ করে নেয়। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে প্যারোলে মুক্তি না নেওয়ার শেখ ফজিলাতুন্নেছার এই সিদ্ধান্ত যে কোনো মাপকাঠিতে অনন্য হিসেবে স্বীকৃত।

বঙ্গমাতার অপর অনন্য সিদ্ধান্ত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। আমরা জেনেছি, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের নেপথ্যে বঙ্গমাতার সঠিক পরামর্শ ছিল। বঙ্গবন্ধুকে সেই সময় তাঁর সহচররা ৭ মার্চের ভাষণের ব্যাপারে নানা পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন।

বঙ্গমাতা এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে যা মন থেকে বলতে ইচ্ছে করে, যা বলা উচিত, তাই বলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। 'এবারের সংগ্রাম- আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম- স্বাধীনতার সংগ্রাম' বলে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের স্বাধীনতার ডাকে বঙ্গমাতার মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন বঙ্গবন্ধুকে সাহস জুগিয়েছিল।

বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রামে ওপরে বর্ণিত এ দু’টি ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহে যদি বঙ্গমাতা প্রত্যক্ষ অবদান না রাখতেন, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্য রকমও হতে পারত।

নারীর ক্ষমতায়নের বহুমুখী, বহুমাত্রাযুক্ত ও বহুস্তরীয় ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার সাথে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সম্পৃক্ত ছিলেন।

তিনি রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক এবং সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অটল এক প্রতিছবি। দেশের জনগণের আর্থ-সামাজি এবং রাজনৈতিক ভালো মন্দে তার মন বিচলিত হতো এবং তিনি সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিতেন। 

বঙ্গবন্ধু কোলকাতায় লেখাপড়া ও রাজনীতি করতেন, দফায় দফায় কারাবরণ করেছেন। এই নিয়ে কোন অভিযোগ ছিলনা তাঁর। বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, “রেনু খুব কষ্ট করত কিন্তু কিছুই বলতো না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা পয়সা জোগাড় করে রাখত। যাতে আমার কষ্ট না হয়।”

 ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বরে তাঁদের প্রথম সন্তান জন্মের পরেই মারা যায়। দুই কন্যা ও তিন পুত্র সন্তানের মধ্যে ’৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন কন্যা শেখ হাসিনা, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৪৯ সালে পুত্র শেখ কামাল, ১৯৫৩ সালে শেখ জামাল, ১৯৫৭ সালে কন্যা শেখ রেহানা এবং ১৯৬৪ সালে পুত্র রাসেল জন্মগ্রহন করে।

 অনন্য মানবিক গুণাবলী ছিল তাঁর। ঘরে বসে নিজেই স্কুল খুলে মেয়েদের লেখাপড়া ও সেলাই শেখাতেন। গরীব ছেলেমেয়ে, এতিম, কন্যাদায়গ্রস্থ পিতামাতাকে অর্থ সাহায্য করতেন। দলের নেতাকর্মীদের চিকিৎসার খরচ যোগাতেন।

সংগঠন ও আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর প্রয়োজন মেটাতে নিজের সম্পদ বিলিয়ে দিতেন। তাঁর কাছ থেকে কেউ কোনদিন রিক্ত হস্তে ফেরেনি।

 বাংলার নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু অহরহ গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরেছেন, জীবনের সোনালী চৌদ্দ বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ছিলেন।

বঙ্গমাতা সন্তান প্রতিপালন ও লেখাপড়া করানোর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলে আইনজীবী নিয়োগ, মামলা চালানোর খরচ, কোর্টে যাওয়া, নিজে রান্না করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া, সাক্ষাতের সময় সব কিছু পুংখানুপুংখ জানিয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের কাছে পৌছে দিয়ে তা কার্যকর করতেন।

বাড়ীতে দলের সভা পরিচালনা, দলের খরচ যোগানো, রান্না করে নেতা-কর্মীদের খাওয়ানো সবকিছু সুনিপুণভাবে সম্পাদন করতেন। মামলার খরচ ও সংগঠনের খরচ যোগাতে নিজের গহনা, ঘরের আসবাবপত্র বিক্রয় করেছেন তিনি।

 ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ, প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয়, বঙ্গবন্ধু সদস্য নির্বাচিত হন। টুঙ্গিপাড়া থেকে বঙ্গমাতা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ঢাকায় আসলেন। রজনী বোস লেনে একটি ভাড়া বাড়ীতে বসবাস শুরু করলেন। ১৫ মে, বঙ্গবন্ধু কৃষি উন্নয়ন, বন ও সমবায়মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ৩০ মে পাকিস্তান সরকার পূর্ববাংলা মন্ত্রীসভা বাতিল করে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে।

 ১৯৫৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর, বঙ্গবন্ধু শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম ও ভিলেজ এইডমন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। মন্ত্রীর চেয়ে দলের দায়িত্বকে প্রাধান্য দিয়ে স্বেচ্ছায় মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দল গোছাতে মনোযোগ দিলেন বঙ্গবন্ধু। এই নিয়ে কোন অনুযোগ ছিলনা বঙ্গমাতার। হাসি মুখে স্বামীর সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন।

 ১৯৫৮সালের ৭ অক্টোবর আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারী করে সংসদ ভেঙ্গে দেয়। ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। শুরু হলো বঙ্গমাতার কষ্ট নদীর অনিরুদ্ধ উপাখ্যান। স্বামী কারাগারে, কেউ বাড়ী ভাড়া দিতে চাইলোনা। তিন দিনের নোটিশে সন্তানদের নিয়ে বাড়ী ছাড়তে হলেও তিনি অটল থেকেছেন হিমালয়ের মত।

এ প্রসঙ্গে কন্যা শেখ হাসিনা বলেন,“বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনীতিক জীবন, লড়াই, সংগ্রামে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে, কিন্তু কখনো মাকে ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি। যতো কষ্টই হোক আমার বাবাকে কখনোই বলেননি যে তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও বা সংসার কর বা খরচ দাও। আব্বা যে পদক্ষেপ নিতেন সেটাকেই সমর্থন করতেন তিনি।”

 নিজের জমানো টাকা ও আবাসন ঋণ নিয়ে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ী নির্মাণ করেন। এ প্রসঙ্গে বেবী মওদুদ ‘মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন নেছা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “সব কাজ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করতেন। খরচ বাঁচানোর জন্য নিজের হাতে পানি দেয়া, ইট ভেজানোসহ বহু শ্রম, যত্ন ও মমতা দিয়ে বত্রিশ নম্বরের বাড়ীটি নির্মাণ করেন।”

 স্বাধীনতার জন্য বঙ্গমাতার মহান ত্যাগ ইতিহাসে চিরভাস্মর হয়ে আছে। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ‘ধীরে বহে মেঘনা’ গ্রন্থ থেকে জেলখানায় স্বামীকে লেখা বঙ্গমাতার একটি চিঠির অংশ উল্লেখ করছি, “আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন, দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ, আপনি নিশ্চিত মনে সেই কাজে যান, আমার জন্য চিন্তা করবেন না।”

 ১৯৬৬-এর ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালীর মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেন। ৮ মে নারায়ণগঞ্জে ছয়দফার সমর্থনে জনসভা করে ঘরে ফেরার পর গভীর রাতে গ্রেফতার হন। ঐ সময় ছয়দফা না আটদফা বিভ্রান্তিতে অনেক নেতাও আটদফার পক্ষে কথা বলেন। ছয়দফা থেকে একচুলও নড়া যাবে না- বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ বাস্তবায়নে বঙ্গমাতা ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখেন। ছয়দফার সমর্থনে বোরকা পরে জনসংযোগ করেন।

 ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ও চৌত্রিশ নেতার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন, বেঁচে আছেন কিনা এই খবর প্রায় পাঁচ মাস অজানা ছিল। সেনাবাহিনীর এক ক্যাপ্টেন বঙ্গমাতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এলো, জানা গেলো বঙ্গবন্ধু ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসের একটি কক্ষে বন্দী, সেখানে কোন বাতাস নেই, একটি বাল্ব জ্বলে, দিন রাত বোঝা যায় না।

জিজ্ঞাসাবাদে কোন তথ্য না পেয়ে ক্যাপ্টেন হুমকি দেয় প্রয়োজনে বঙ্গমাতাকে গ্রেফতার করা হবে। তিনি ভয় পাওয়ার মানুষ নন। ঐ সময় প্রতিটি বন্দী পরিবারের নিয়মিত খোঁজ-খবর নেন ও সহযোগিতা করেন, মামলা পরিচালনার জন্য প্রবাসী বাঙ্গালীদের সহায়তায় লন্ডন থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামকে ঢাকায় নিয়ে আসেন।

বঙ্গমাতার দূরদর্শিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ খুলে দিয়েছিল। কন্যা শেখ হাসিনার উদ্ধৃতি, “পাকিস্তান সরকার আম্মাকে ভয় দেখায়, বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তি না নিলে তিনি বিধবা হবেন। মা সোজা বলে দিলেন, কোন প্যারোলে মুক্তি হবেনা। নি:শর্ত মুক্তি না দিলে কোন মুক্তি হবেনা।

আমি মায়ের সিদ্ধান্তের কথা বঙ্গবন্ধুকে জানালাম। তখন অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকেও দেখেছি আমাকে বলতে, তুমি কেমন মেয়ে- বাবার মুক্তি চাওনা? আম্মাকে বলেছে, ভাবী আপনি কিন্তু বিধবা হবেন....।” লেখক সৈয়দ বদরুল আহসান, From Rebel to Founding Father: Sheikh Mujibur Rahman গ্রন্থে উল্লেখ করেনঃ She passed on the message to Mujib--- Mujib listened to his wife. He did not give any thought to freedom on parole any more.” বঙ্গবন্ধু যদি প্যারোলে যেতেন বাংলাদেশ স্বাধীন হতোনা। বঙ্গমাতার বিচক্ষণতা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ধ্রুবতারার মত।

 পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ ৭১ এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন। যে ভাষণ বুকে নিয়ে নিরস্ত্র বাঙ্গালী সশস্ত্র হয়েছিল, রক্ত দিয়ে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল। কেমন ছিলো সেই ভাষণ প্রদানের প্রেক্ষাপট? কি ভূমিকা ছিল সেখানে বঙ্গমাতার? কন্যা শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণমূলক এক বক্তব্যে পেয়েছি- “জনসভায় যাওয়ার কিছুক্ষণ পূর্বে আব্বা কাপড় পড়ে তৈরি হবেন, মা আব্বাকে নিয়ে ঘরে এলেন।

দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আব্বাকে বললেন ১৫ মিনিট চুপচাপ শুয়ে থাকার জন্য। আমি আব্বার মাথার কাছে বসে মাথা টিপে দিচ্ছিলাম। মা বেতের মোড়াটা টেনে আব্বার কাছে বসলেন।যে কোন বড় সভায় বা গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাওয়ার আগে আমার মা আব্বাকে কিছুক্ষণ একদম নিরিবিলি রাখতেন। মা আব্বাকে বললেন, সমগ্র দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তোমার মনে যে কথা আসে তুমি তাই বলবে।

অনেকে অনেক কথা বলতে বলেছে। তোমার কথার উপর সামনের অগণিত মানুষের ভাগ্য জড়িত। ”বঙ্গমাতার প্রেরণা থেকে রাজনীতির কবিগণ সূর্যেরে মঞ্চ কাঁপিয়ে শুনিয়েছিলেন স্বাধীনতার অমোঘ মন্ত্র, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

 ৭১-এর ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বত্রিশ নম্বর বাড়ী আক্রমণ করে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা, বঙ্গমাতা ছেলেমেয়ে নিয়ে প্রথমে পাশের বাসায় আশ্রয় নেন। বত্রিশ নম্বর বাড়ী তছনছ করে, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মা বাবার সামনে বাড়ী আগুনে পুড়িয়ে দেয়।

বড় ছেলে শেখ কামাল ২৫ মার্চ রাতেই মুক্তিযুদ্ধে যান। শেখ জামালও যান। উনিশবার জায়গা বদল করেও রেহাই পেলেন না, একদিন মগবাজারের এক বাড়ী থেকে ছেলে-মেয়েসহ বঙ্গমাতাকে গ্রেফতার করে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের একটি বাড়ীতে আটকে রাখে পাকি সেনারা।

বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন কিনা বঙ্গমাতা জানতেন না। বন্দি অবস্থায় কন্যা শেখ হাসিনার সন্তান জন্ম নেয়ার সময় তাঁকে একবারের জন্যও ঢাকা মেডিক্যালে যেতে দেয়া হয়নি। কনিষ্ঠা কন্যা শেখ রেহানা ‘একজন আদর্শ মায়ের প্রতিকৃতি’ লেখায় এ প্রসঙ্গে বলেছেন,“জুলাই মাসের শেষ দিকে হাসু আপা হাসপাতালে গেল। মা যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েও যেতে পারলেন না। সৈন্যরা তাকে যেতে দিলনা।

বলল, ‘তুমি কি নার্স না ডাক্তার যে সেখানে যাবে’ মা খুব কষ্ট পেয়ে সারারাত কেঁদেছিলেন।” বন্দি অবস্থায় তিনি অসুস্থ্ শ্বশুর-শাশুড়ীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করান তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (যা বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়)। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন, খবরা-খবর আদান-প্রদান করতেন।

 তাঁদের বন্দীদশার অবসান ঘটে ১৭ ডিসেম্বর। মুক্তি পেয়ে বঙ্গমাতা বাড়ির ছাদ থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে টুকরো টুকরো করে আগুন ধরিয়ে দেন। জয় বাংলা শ্লোগান দেন। এ সময় হাজার হাজার জনতা ছুটে আসে।

স্বাধীনতার পর বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশ্যে বঙ্গমাতা বলেন, ‘আমি তোমাদের মা। ’ তিনি বলেন, ‘এই বীরাঙ্গনা রমণীদের জন্য জাতি গর্বিত। তাদের লজ্জা কিংবা গ্লানিবোধের কোনো কারণ নেই। কেননা তারাই প্রথম প্রমাণ করেছেন যে, কেবল বাংলাদেশের ছেলেরাই নয়, মেয়েরাও আত্মমর্যাদাবোধে কী অসম্ভব বলীয়ান। (দৈনিক বাংলার বাণী, ১৭ ফাল্গুন, ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ)। ’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আসলে আমার আব্বা মায়ের মতন একজন সাথী পেয়েছিলেন বলেই কিন্তু তিনি তাঁর সংগ্রাম করে সফলতা অর্জন করতে পেরেছিলেন। জীবনের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়ে, সব ভোগবিলাস বিসর্জন দিয়ে আমার বাবার পাশে থেকে এ দেশের মানুষকে স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন আমার মা।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাবার পাশে থেকে মা যদি ত্যাগ স্বীকার না করতেন তাহলে হয়তো আজকে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম না। ‘স্কুল-কলেজের প্রথাগত শিক্ষা অর্জন করতে না পারলেও বেগম মুজিব স্বশিক্ষিত ছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার মায়ের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ছিল, নিজে নিজে পড়াশোনা করতেন।

আব্বা যখন আসতেন মায়ের জন্য বই নিয়ে আসতেন। পড়ার এবং শেখার অত্যন্ত আগ্রহ ছিল, যে কারণে সব সময় বই পড়াটা আমাদের একটা অভ্যাসই ছিল। পড়ার বইয়ের পাশাপাশি গল্পের বই পড়া—এটা আমাদের বাসায় একটা প্রথাই ছিল এবং এ বিষয়ে আমার মায়ের সব থেকে বেশি আগ্রহ ছিল।

‘তিনি বঙ্গমাতা সম্পর্কে বলেন, তাঁর সম্পর্কে মানুষ খুব সামান্যই জানে। তিনি অত্যন্ত সাদাসিধে ও প্রচারবিমুখ ছিলেন। তাই বঙ্গমাতার অবদান লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে গেছে।

বঙ্গমাতাকে প্রধানমন্ত্রী স্বামী-সংসার অন্তপ্রাণ বাঙালি নারী এবং শোষিত-নিপীড়িত জনসাধারণকে মুক্তির চেতনায় জাগিয়ে তোলার সংগ্রামে স্বামীর পাশে থাকা সহযোদ্ধা আখ্যায়িত করে বলেন, ‘আম্মা অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে আব্বাকে সহায়তা করতেন।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আম্মা জেলখানায় দেখা করতে গেলে আব্বা তাঁর মাধ্যমেই দলীয় নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবর পেতেন। আব্বার দিকনির্দেশনা আম্মা নেতা-কর্মীদের পৌঁছাতেন। আব্বা কারাবন্দি থাকলে সংসারের পাশাপাশি সংগঠন চালানোর অর্থ আম্মা জোগাড় করতেন।’

বাবার প্রতি কাজেই মা প্রতিবন্ধক নয়, সহায়ক ছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আম্মা চাইলে স্বামীকে সংসারের চার দেয়ালে আবদ্ধ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি কখনো ব্যক্তিগত-পারিবারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তাকাননি।

ফলে আমরা সন্তানরা বঞ্চিত হয়েছি এবং আম্মাকেই সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘বাবাকে কখনো টানা দুই বছরও আমাদের মাঝে পাইনি।’ তিনি বলেন, ‘আম্মা মানুষের মুক্তির জন্য আব্বার সংগ্রামী চেতনা বুঝতেন এবং সহযোগিতা করতেন।

আব্বাও আম্মার সাহস, মনোবল, ত্যাগ, বিচক্ষণতা, দুঃখকষ্ট সব বুঝতেন।’আম্মার উৎসাহেই জাতির পিতা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ লিখেছিলেন বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।

জাতির এক সন্ধিক্ষণে বেগম মুজিবের একটি সিদ্ধান্ত বাঙালিকে মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্যারলে মুক্তি নিতে চাপ দেওয়া হয়।

মাকে ভয় দেখানো হয়েছিল—‘পাকিস্তানিদের শর্ত না মানলে তিনি বিধবা হবেন।’ কিন্তু মা কোনো শর্তে মুক্তিতে রাজি হননি। আব্বাও প্যারলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। শেষ পর্যন্ত গণ-অভ্যুত্থানে পাকিস্তান সরকার আব্বাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মায়ের মেসেজ ঠিক সময়ে বাবাকে জানাতে পারায় এবং বাবা পাকিস্তানিদের প্যারলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় সে সময় অনেক আওয়ামী লীগ নেতাই আমাকে বলেন—তুমি কেমন মেয়ে হে, বাবার মুক্তি চাও না।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস আম্মার যে মনোবল দেখেছি, তা ছিল কল্পনাতীত। স্বামীকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে গেছে। দুই ছেলে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে। তিন সন্তানসহ তিনি গৃহবন্দি। যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন কিন্তু আম্মা মনোবল হারাননি।’

তিনি বলেন, ‘অসীম সাহস ও ধৈর্য নিয়ে আম্মা সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন। তিনি আল্লাহকে স্মরণ করতেন। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি অবস্থায় আম্মা অধিকাংশ সময় হাতে তসবিহ নিয়ে পড়তেন।’ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণও তাঁরই অনুপ্রেরণায় বঙ্গবন্ধু নিজের মন থেকে উৎসারিত করেছিলেন বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, ঘাতকচক্র ভীত ছিল, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াবে। তাই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খুনিরা গৃহবধূ, অন্তঃসত্ত্বা মা, শিশু কাউকে বাঁচতে দেয়নি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নস্যাৎ করতে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। তারপর ঘাতকরা দেশটাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উল্টোরথে চড়িয়ে দেয়। দেশবিরোধী সেই ষড়যন্ত্র এখনো অব্যাহত আছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার মা কোনো দিন কিছু চাননি। আমার বাবা মন্ত্রী ছিলেন, এমপি ছিলেন, এমএলএ ছিলেন। জাতীয় পরিষদে অংশ গ্রহণ করতে তাঁকে প্রায়ই করাচিতে যেতে হতো। কিন্তু আমার মা কোনো দিন ওই পশ্চিম পাকিস্তানে যাননি, যেতেও চাননি। এ দেশের স্বাধীনতার জন্য সব সময় তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা, যা পৃথিবীতে বিরল।

ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে বাংলার মানুষ কখনও ভুলবে না । বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সকল নারীর জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে, ‘তার জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের নারীদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। ‘তিনি নারীদের প্রেরণার উৎস। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন জাতির সামনে তুলে ধরার পাশাপাশি মুজিবের সংগ্রামী জীবনও আমাদেরকে জাতির কাছে তুলে ধরতে হবে।’

নবীন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ আলোচনায় বঙ্গমাতার জীবনাচারও অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উদ্ভাসিত। খোকা থেকে মুজিব, মুজিব থেকে মুজিব ভাই, মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছনে যার অবদান অনস্বীকার্য, তিনি হচ্ছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।বঙ্গমাতার অবদান তত বেশি উদ্ভাসিত হবে।

বঙ্গমাতার বিশালত্বের অজানা নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হবে। বাংলার রাজনীতির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার নাম চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা অবিছিন্ন সত্তা ছিলেন।

‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ গ্রন্থে মযহারুল ইসলাম লিখেছেন, “আমি বঙ্গবন্ধুর অনাবিল সাক্ষাতকার লাভ করেছি। একবার তিনি বলেন, ‘আমার জীবনে দুটো বৃহৎ অবলম্বন আছে-- একটি আমার আত্মবিশ্বাস, অপরটি- তিনি একটু থেকে আমাকে বললেন, অপরটি বলুন তো কি?’ হঠাৎ এ-রকম একটি প্রশ্নের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি একটু মৃদু হেসে বললেন,‘অপরটি আমার স্ত্রী, আমার আকৈশোর গৃহিণী।”

তিনি বঙ্গবন্ধুকে শক্তি, সাহস, মনোবল, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন বলেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, বঙ্গবন্ধু ‘জাতির পিতা’ হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু জীবনে যত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছেন সবটাতেই বঙ্গমাতা তাঁকে ছাঁয়ার মত সাহায্য করেছেন। ডঃ নীলিমা ইব্রাহিম বলেন,“রেণু ছিলেন নেতা মুজিবের Friend, Philosopher and Guide.”

তিনি বাংলাদেশকে গভীর ভাবে ভালবাসতেন।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণে অনন্য ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিতা নারীদের পুণর্বাসনে সক্রিয় পদক্ষেপ নেন, বীরাঙ্গনাদের বিয়ে দেন নিজ উদ্যোগে। চিরদিন কেবল দিয়েই গেছেন, নিজের জন্য কিছুই চাননি। একটি দেশের জাতির পিতা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হয়েও সহজ-সরল, সাধারণ জীবন যাপন করতেন। কোন দিন প্রচার চাননি।

বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ যেমন একই সূত্রে গ্রথিত, তেমনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবও (যিনি বঙ্গবন্ধুর প্রিয় রেণু) পরস্পর অবিচ্ছেদ্য নাম। ফজিলাতুন্নেছার শৈশবের সঙ্গী শেখ মুজিবুর রহমান।

তাঁরা একই পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন। জীবন চলার পথে একে অপরের অপরিহার্যতার প্রমাণ দিয়েছেন ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে।

বঙ্গমাতা সংসার, সমাজ, সন্তান প্রতিপালনের পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার পর দেশ পুণর্গঠনে অসামান্য অবদান রেখে ইতিহাসকে যেমন সমৃদ্ধ করেছেন, ইতিহাসও তাঁকে বঙ্গমাতায় অভিষিক্ত করেছে।জাতি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।

এই মহীয়সী নারীর জীবনী চর্চা নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে। তাঁর প্রতি জাতির কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে নয়; তাঁর আদর্শ জাতি তথা নারী জাতিকে অনুপ্রাণিত করবে।

 এই মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ঝর্ণা বাড়ৈ (পিএইচডি গবেষক) সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটি।