ন্যাভিগেশন মেনু

পরিবহন হেলপার থেকে যেভাবে দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান


দ্বীপ আজাদ, নোয়াখালী প্রতিনিধি

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুরে নারীকে বিবস্ত্র করে নির্মম নির্যাতনের ঘটনায় র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার দেলোয়ার হোসেনের (৩০) বিরুদ্ধে মাদক বিক্রি, চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

দেলোয়ারের এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে এতোদিন কেউ মুখ খুলতে রাজি না হলেও তার গ্রেপ্তারের পর স্থানীয় বাসিন্দাদের মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে তার অপরাধ জগতের গল্প।

৪নং পূর্ব একলাশপুর গ্রামের পাটোয়ারী বাড়ির মৃত ছায়েদুল হকের ছেলে দেলোয়ার হোসেন দ্ইু বছর আগেও কখনো অটোরিকশা এবং মিনিবাসের হেলপার, কখনো সবজি বিক্রেতা হিসেবে কাজ করতেন। এরপর কিছুদিন অটোরিকশাও চালিয়েছেন।

২০১৮ সালের দিকে বেগমগঞ্জের সুমন বাহিনীর সাথে যুক্ত হয় দেলোয়ার। সুমন বাহিনীর হয়ে এলাকায় নানা অপকর্মের সাথে যুক্ত হন। এরপর নিজের নামে বাহিনী গড়ে তুলে এলাকায় মাদক বিক্রি, চাঁদাবাজি, লোকজনকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়, ইভটিজিংসহ নানা অপরাধ সংগঠিত করে দেলোয়ার বাহিনী।

তার এ বাহিনীতে রয়েছে ৫০/৬০ জনের সক্রিয় সদস্য। যে দেলোয়ারকে এক সময় নানা পেশা বদল করেও ভাত খেতে কষ্ট হতো, সে এখন অনেক টাকার মালিক। তার রয়েছে মৎস্য খামারসহ একাধিক ব্যবসা।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ি, দেলোয়ারের নামে বেগমগঞ্জ মডেল থানায় হত্যা, বিষ্ফোরক ও মারামারির তিনটি মামলা রয়েছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে শরীফপুরে হাসান হত্যা মামলার পলাতক আসামী সে।

এছাড়া ২০১৮ সালে একলাশপুরে আলী হত্যায় তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ২০১৮ সালে মোহাম্মদ আলী ও রবিন নামের দুই যুবককে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা ঘটনায় সে জড়িত ছিলো বলেও জানিয়েছে একলাশপুরের স্থানীয় বাসিন্দারা।

নিজ এলাকায় এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্মম নির্যাতনের ঘটনায় প্রথম থেকে দেলোয়ারের নাম উঠে আসলেও আসামী তালিকার তার নাম না থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করেন অনেকে। প্রভাবশালীদের চাপে তার নাম বাদ দেওয়া হতে পারে বলেও অনেকে মন্তব্য করেছে।

সিএনজি চালিয়ে কোনোরকম সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া দেলোয়ার ২০১৩ সালের দিকে এখলাশপুর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের একটি রাজনৈতিক দলের নেতা জহিরের হাত ধরে রাজনীতিতে যোগ দেয়।

যুব রাজনীতির শেকড় গজাতে জহিরের মাধ্যমে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাথে ছবি তুলে সখ্যতা গড়ে তোলে দেলোয়ার। এক পর্যায়ে দেলোয়ার হয়ে উঠে নেতাদের আস্থাভাজন কর্মী।

২০১৪ সালে রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে দেলোয়ার স্থানীয় উঠতি বয়সের যুবকদের সংগঠিত করে গড়ে তোলে সন্ত্রাসী বাহিনী। তার বাহিনীর প্রধান সদস্য হিসেবে সক্রিয় ভূমিকায় কাজ করে বাদল ও কালাম। দেলোয়ার সেই বাহিনীর মাধ্যমে ধীরে ধীরে এলাকায় গড়ে তোলে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজিসহ এক অপরাধ সম্রাজ্য।

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, দিনের শুরু থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দেলোয়ার বাহিনীর সদস্যরা এখলাশপুরের অলিগলি থেকে শুরু থেকে বেগমগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজি মাদক ব্যবসা, মানুষকে জিম্মি করে টাকা আদায়সহ তাদের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে আসছে।

এলাকাবাসী জানায়, গত দুই সেপ্টেম্বর এখলাশপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড খালপাড় এলাকার নুর ইসলাম মিয়ার বাড়ীতে গৃহবধূর স্বামীকে বেঁধে রেখে তার চোখের সামনেই গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণের চেষ্টা করে দেলোয়ার বাহিনীর সদস্য বাদল, মো. রহিম, মো. আবুল কালাম, ইসরাফিল হোসেন, সাজু , সামছুদ্দিন সুমন, আবদুর রব, আরিফ, রহমত উল্যাসহ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।

ধর্ষণে ব্যর্থ হলে তারা ওই গৃহবধূকে মধ্যযুগীয় কায়দায় বিবস্ত্র করে নির্যাতন করতে থাকে এবং ভিডিও ধারণ করে নির্যাতিতার স্বামীর কাছে মোটা অংকের টাকা দাবি করে। ঘটনাটি জানাজানি হলে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রশাসনের দ্বারস্থ হওয়ার চেষ্টা করলে দেলোয়ার এবং বাদলদের অস্ত্রের মহড়ায় এলাকাবাসী আতংকিত হয়ে পড়ায় বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়।

ঘটনার দিন এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে স্থানীয়দের আরও আতংকিত করে তোলায় অসহায় গৃহবধূর পরিবার আর প্রশাসনের দারস্থ হওয়ার সাহস করেনি। এভাবেই একের পর এক বৃহৎ অপরাধ চক্র গড়ে তোলেন দেলোয়ার বাহিনীর সদস্যরা।

নোয়াখালী পুলিশ সুপার মোঃ আলমগীর হোসেন বলেন, ভিকটিমের সাথে বার বার আলোচনা করে তাকে অভয় দিয়ে আসামীদের সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে। ভিকটিম যার যার বিষয়ে তথ্য দিয়েছে তাদের নাম এজাহারভুক্ত করা রয়েছে।

তিনি জানান, ‘এ ঘটনায় মূলহোতা দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার হোসেন ও তার সহযোগী আবুল কালামের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা দায়ের করেছেন নির্যাতিতা নারী। মঙ্গলবার (৬ অক্টোবর) রাত সাড়ে ৮টার দিকে ওই নারী বাদী হয়ে বেগমগঞ্জ মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলাটি করেন।’

মামলার এজাহারে নির্যাতনের শিকার ওই নারী অভিযোগ করেছেন, গত ২ সেপ্টেম্বর দেলোয়ার বাহিনীর সদস্যরা বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনার আগে দেলোয়ার তাকে দুইবার ধর্ষণ করেছিলো। এর মধ্যে একবার ধর্ষণ করা হয় প্রায় এক বছর আগে। আর দ্বিতীয়বার ধর্ষণ করা হয় রমজানের কিছুদিন আগে। দ্বিতীয়বার ধর্ষণের ঘটনার দিন দেলোয়ারের সহযোগী কালামও তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন।

এ ঘটনায় মামলার প্রধান আসামি বাদল এবং দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ারকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। রবিবার (৪ অক্টোবর) মধ্যরাত থেকে সোমবার ভোররাত পর্যন্ত র্যাব-১১-এর নিরবচ্ছিন্ন সাঁড়াশি অভিযানে বাদলকে ঢাকা হাইওয়ে এবং দেলোয়ারকে অস্ত্রসহ নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া মামলার আরেক আসামি আবুল কালামকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

এর আগে রবিবার বিকেল ৪টা এবং রাত ১১টায় অভিযান চালিয়ে একলাশপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে মো. আব্দুর রহিম (২০) ও মো. রহমত উল্যাহ (৪১) নামে দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

ডিএ/এমআইআর/এডিবি