ন্যাভিগেশন মেনু

পাকিস্তানের কবর রচনা করে আজ গঠিত হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার


নিরাপরাধ বাঙালীদের ওপর পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর নৃশংস গণহত্যা শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে। অবশ্য তার আগে থেকেই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্নস্থানে স্বাধীনতাকামী বাঙালীদের ওপর পাকিস্তানিরা হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আসছিল সুপরিকল্পিতভাবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকার পরেই ঢাকাসহ বাংলাদেশে হত্যা-নির্যাতন শুরু করে পাকিস্তান ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারের দল। মানুষ তখন প্রাণ বাঁচাতে সীমান্তের ওপারে ভারতে ছুটছেন। পলায়ন পথেও পাকিস্তানি সৈন্যদের বেপরোয়া গুলিবর্ষণের কাণ্ডে বাঙালী প্রাণ হারাচ্ছেন। 

এদিকে মুক্তিযুদ্ধ চালাতে কৌশলগত কারণে ভারতে অবস্থান নেওয়া আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন পশু শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে আর কালক্ষেপণ না করে সিদ্ধান্ত হয় প্রবাসী সরকার গঠনের। তার আগেই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সিদ্ধান্ত হয়, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্র প্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদেও অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধানই সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন-প্রণয়নের ক্ষমতা অধিকারী।...’। 

ভারতে অবস্থান নেওয়া প্রবাসী সরকার গঠনকল্পে বেছে নেওয়া হয়, তদানীন্তন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন এলাকাকে। দিনটি ছিল ১৭ এপ্রিল। আজ সেই ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। আজ থেকে ৪৯ বছর আগে একাত্তর সালের এই দিনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ আর মুক্তির সনদে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে কবর রচিত হয় পাকিস্তানের। রচিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস। ৯ মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয় স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। 

বাংলা, বাঙালী, মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিবনগর যেন অভিন্ন নাম। আর আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথে ১৭ এপ্রিল এক ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত দিন। পাকিস্তানের অপশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে। একাত্তরের অগ্নিঝরা এদিনেই বাঙালীর হাজার বছরের লালিত স্বপ্নের স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভিত্তিমূল রচিত হয়। রচিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস।

পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর হাতে বন্দী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করে এদিন গঠিত হয় বাংলাদেশ সরকার। বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায় স্বাধীনতা বাংলাদেশের নাম। পরবর্তীতে ঐতিহাসিক এ দিবসটি মুজিবনগর দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। 

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘...জনগণের ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের ক্ষমতায় গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য সেহেতু আমরা বাংলাদেশকে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি এবং এ দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করেতেছি। মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঘটনা সারাবিশ্বেই ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।     

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সেদিন ছিল শনিবার। সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আমবাগানের চারদিকে রাইফেল হাতে কড়া প্রহরায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা। হাজার হাজার মুক্তিকামী বাঙালীর উপচেপড়া ভিড় চারদিকে। ঐতিহাসিক স্বাধীনতার মুহূর্তটি ধারণ করতে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরাও প্রস্তুত। মুক্ত আকাশের নিচে চৌকি পেতে তৈরি করা হয়েছে শপথ মঞ্চ। মঞ্চের ওপর সাজানো ৬ খানা চেয়ার। অনুষ্ঠানের প্রবেশপথে বাংলায় লেখা স্বাগতম।

সকাল ১১টা বেজে ৫০ মিনিটে আসে সেই মাহেদ্রক্ষণ। নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের নেতারা একে একে আসতে থাকেন। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে প্রকম্পিত চারদিক। প্রথম শপথ মঞ্চে উঠে এলেন বঙ্গবন্ধুর আজীবনের ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাঁর পেছনে তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেম এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, বিশ্বাসঘাতক খুনী খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও জেনারেল এম এ জি ওসমানী। আশঙ্কা ছিল যে কোন মুহূর্তে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিমান হামলা। সেই আশঙ্কা উড়িয়ে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক এ শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের স্থায়িত্ব ছিল ৪৫ মিনিট। 

অনুষ্ঠানের সূচনায় পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, গীতা এবং বাইবেল থেকে পাঠ করা হয়। শিল্পী এবং হাজারো মানুষের কণ্ঠে গাওয়া হয় বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম উত্তোলন করেন মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। এরপর আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী ঐতিহাসিক দলিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এরপর নতুন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রীবর্গ ও সেনাবাহিনীর প্রধানকে শপথবাক্য পাঠ করান তিনি। 

শপথ গ্রহণের পর সশস্ত্র তেজোদীপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এবং আনসার বাহিনীর সদস্যরা মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবর্গকে রাষ্ট্রীয় কায়দায় ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করেন। পাক শাসকগোষ্ঠীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকায় তাঁকে রাষ্ট্রপতি করেই ঘোষণা করা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। 

বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সেদিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসাবে শপথ নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সরকারের মন্ত্রিসভায় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদকে সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। পরে বাঙালী জাতির কাছে মীরজাফর ও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বিবেচিত খন্দকার মোশতাক আহমেদকে আইন, বিচার ও পররাষ্ট্র দফতরের মন্ত্রী করা হয়। 

শপথ গ্রহণের পর পরই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা যা করছি সবই মুজিবের নির্দেশে। তবে তিনি কোথায় আছেন বলব না।’এ অনুষ্ঠান থেকে নতুন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দুজনই বিশ্ববাসীর কাছে নতুন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বীকৃতি দান ও সামরিক সাহায্যের আবেদন জানান। 

একাত্তরের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার ধারাবাহিকতায় গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের এ প্রকাশ্য শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান ছিল বাঙালীর স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের একটি ঐতিহাসিক টার্নিং পয়েন্ট। কেননা পাকিস্তানের জল্লাদ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিশ্বাসীকে দেখাতে চেয়েছিল বাঙালীর স্বাধীনতা যুদ্ধ হচ্ছে ভারতের মাটিতে বসে। ইয়াহিয়ার এ প্রচার মিথ্যা প্রমাণ করার জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মাটিতে বসেই।

মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে ও দক্ষ পরিচালনায় মুক্তিপাগল বাঙালী জাতি নয় মাস মরণপণ সশস্ত্র যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনেন মহামূল্যবান বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর হাজার হাজার মা-বোনের ইজ্জত, অশ্রু এবং কোটি বীর বাঙালীর আত্মত্যাগে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ স্থান দখল করে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে।

এ বছর বৈশ্বিক করোনা ভাইরাসের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার আলোকে স্বাস্থ্যবিধি/নির্দেশনা সমূহ যথাযথভাবে মেনে চলার জন্য মুজিবনগর দিবসে মেহেরপুর ব্যতিত অন্য কোন জেলা থেকে কোন ব্যক্তিকে মুজিবনগরে না আসার জন্য জোরালোভাবে অনুরোধ করা হয়েছে।  

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক আজকের বাংলাদেশ পোস্ট