আর্মি স্টেডিয়ামে তিল ধারণের স্থান নেই। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতে যে এত মানুষ আসতে পারে, ক’বছর আগেও মানুষ ধারণা করতো না। তন্ময় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বোঝে না। কিন্তু শুনতে তার ভাল লাগে। সেটাও বড় কথা নয়। সে এসেছে কতকগুলো নামের টানে। সে শুনে দেখতে চায় ওস্তাদ আয়ান আলী-আমান আলীর সারোদ, কৌশিকী চক্রবর্তীর কন্ঠ সঙ্গীত এবং বিশেষতঃ হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার বাঁশি। পরে গল্প করতে চায় অন্যদের সাথে। উচ্চাঙ্গসংগীত শুনতে যাওয়াটা তাকে উচ্চাঙ্গের সংস্কৃতিবান মানুষ হিসেবে পরিচিত করবে পরিচিত মহলে। এটাই মূল লক্ষ্য।
এরকম ভাবনা থেকে রাত দশটার দিকে সে স্টেডিয়ামে ঢোকে। প্রথমটা উসখুস করলেও রাত বারোটা নাগাদ সে একবারে মজে যায়।চোখ বন্ধ করে শুনছে আয়ান আলী-আমান আলীর সারোদ। ‘যদি তোর ডাক শুনে’ বাজিয়ে যখন আয়ান-আমান তাদের পরিবেশণা শেষ করলেন, ততক্ষণে অন্যের কাছে গল্প করার উদ্দেশ্যটা আর মুখ্য নেই তন্ময়ের কাছে। তারপর কৌশিকী চক্রবর্তী, তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার, গনেশ রাজাগোপালান -- একের পর এক সব বিস্ময়।
হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া যখন মঞ্চে উঠলেন তখন পুবের আকাশ ফর্সা হবার আভাস দিচ্ছে। আহীর ভৈরবী রাগে পন্ডিতজি শুরু করেছেন তার পরিবেশনা । তন্ময় চোখ বুজে শুনছে। প্রতিটা পরিবেশণার পরে মানুষ যখন হাততালি দিচ্ছে, তখনও সে চোখ বুজেই থাকছে; আবেশটা ভাঙতে চায় না। কতক্ষণ কেটে গেছে জানে না সে। একবারে বুঁদ। হঠাৎ পিছন থেকে কাঁধের উপর হাতের চাপ। চোখ খুলে পেছন ফেরে সে। ময়লা চাদরে মাথা ঢাকা একটা লোক। সে থতমত খেয়ে যায়। তাকিয়ে থাকে। কথা বলে সেই মানুষটি।
- আসো।
- কোথায়? কে আপনি?
- আমারে চিনতি পারলে না? আমি তোমার লক্ষণদা। চন্ডিপুরির লক্ষণ।
- আপনি এখানে?
- আইছিলাম। বড় পন্ডিত, তার বাঁশি শুনতি।
- আপনিও তো বাঁশি বাজাতেন, না?
- ইম, বাজাতাম।
অস্বাভাবিক জোর ‘তাম’ অংশে। যেন অতীত হওয়াটা জোর দিয়ে বোঝাতে হচ্ছে।
- এতবড় মানুষ বাজাচ্ছে কিন্তু মজা পালাম না।
- কেন?
- আসো। এই দিকি আসো, কচ্চি। পূর্ণিমার রাত আজকে; তুমি চাঁদ দ্যাহোছো? এহ্যানে তো চাঁদ দেহা যায় না। ঘেরা দেয়া মাঠে নকল আলো। এহানে বাশিতি সুর ওঠপে? আসো তোমারে বাঁশি শুনাই।
কথা বলতে বলতে হাঁটা শুরু করে সে। সম্মোহিতের মত তন্ময় হাঁটতে থাকে লক্ষণের পিছু পিছু। মঞ্চে হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়াকে পেছনে রেখে সে চলেছে চন্ডিপুরের লক্ষণদার বাঁশি শুনতে। সেই সুর শুনতে যা কি না চৌরাশিয়ার বাঁশিতেও ওঠে না।
- আকাশ দেখতি হবে। চাঁদ দেখতি হবে। ফাঁকা বিলের মধ্যি বসতি হবে। অনেক দূরি থাকপে বাড়ীঘর গ্রাম। সবকিছু ছায়ার মত, সপ্নের মত। সেইখানে বাঁশিতি সুর ওঠপে।
- সেইজন্যে আপনি মাঝরাতে বাঁশি বাজাতেন মাঠের মাঝখানে ফাঁকা রাস্তায় বসে?
- আমার তো উপায় ছিলো না অন্য সময় বাজানো। সারাদিন মানষির বাড়ী কাজ করতাম। রাতি খাইয়ে দাইয়ে তার পরে বাজাতাম। কেউ বেরাক্ত না হয় তাই ফাঁকা জায়গায় চলে যাতাম। ...
তোমার মনে আছে তুমি আমারে একবার এট্টা বাঁশি কিনে দিছিলে কাঞ্চননগরের বাজাররের থে? ওইটে বাজাবো। তোমরা তো এহন আর গেরামে যাও না শোনাবো কি করে? আজকে শোনো।
তন্ময় মনে করতে পারে না কবে সে লক্ষণকে বাঁশি কিনে দিয়েছিলো। কিছু না বলে সে শুনতে থাকে; পেছন পেছন হাঁটতে থাকে সম্মোহিতের মত। ঘুমন্ত শহরের পাকা রাস্তা ছাড়িয়ে গ্রামের কাঁচা রাস্তা। তারপরে নদীর ধার ঘেঁষে আলের উপর দিয়ে পায়ে চলার পথ। লক্ষণ হাঁটছে আর তন্ময় তাকে অনুসরণ করছে; হাওয়ায় ভাসছে যেন। কথায় কথায় তারা পৌঁছে গেছে নবগঙ্গা পাড়ে। লক্ষণ বলছেন, গাঙের অবস্থা দ্যাহোছো? বাঁশি বাজপে ক্যাম্বায়? তন্ময় ভাবতে চেষ্টা করে গাঙ মরে যাওয়ার সাথে বাঁশির সুরের সম্পর্ক কী? তার তালগোল পাকিয়ে যায়। লক্ষণই আবার কথা বলে, যমুনায় জল না থাকলি তমাল তলায় বাঁশি বাজপে?
অগ্রহায়নের ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে কুয়াশা ভেজা রাস্তা। আলো তখনো ফোটেনি। লক্ষণদা বাঁশি বের করে তার চাদরের নিচে থেকে। পরম শ্রদ্ধায় দু’হাতে বাঁশি ধরে কপালে ছুঁইয়ে প্রণাম করে সে। তন্ময় যেন বুঝতে পারে যমুনা, নবগঙ্গা আর তমালের সম্পর্ক।
বাঁশির সম্মোহনী সুর চারদিক ছেয়ে ফেলে। তন্ময় তাকিয়ে থাকে লক্ষণের দিকে নির্বাক, সম্মোহিত। লক্ষণ বাজিয়ে চলে। এভাবে কেটে যায় অনেকক্ষণ।
আনসারের বাঁশিতে সে জেগে ওঠে, ওঠেন, ওঠেন। ওঠে তন্ময়। বাসায় ফোন করবে। ভুল করে ফোন চলে যায় গ্রামে তার ছোট ভাইয়ের কাছে।
ওদিক থেকে ‘হ্যালো’ শোনার পর সে একটু অপ্রস্তুত হয়। এত সকালে বাড়ীতে ফোন, যেখানে নিয়মিত যোগাযোগই নেই। কী বলবে? সাথে সাথে সামলে নেয়।
- কেমন আছো?
- আছি এক রকম। চন্ডিপুরি এক লক্ষণদা ছিলো না, সে মারা গেছে। শশ্মানের জোগাড়যন্ত্র করতিছি।
বিদ্যুতের শক লাগে তন্ময়ের।
- কখন? কীভাবে?
- ও তো পাগলা ছিলো। মাঝরাতে উঠে বাঁশি বাজাতো। কালকে ভোরের দিকে বাঁশি নিয়ে বার হয়। ফাঁকা রাস্তায় বাঁশি বাজাচ্ছিলো। সকালে লোকজন দেখে রাস্তায় মরে পড়ে আছে।
তন্ময় চুপ করে য়ায় এক মুহুর্তের জন্য। তারপর বলে,
- এই ঠান্ডায়. . .
- ইম ঠান্ডায় খালি এট্টা চাদর গায় দিয়ে রারোইছিলো।
- ঘিয়ে রঙের একটা ময়লা চাদর।
- হ্যাঁ। আপনি জানেন কিভাবে?
- না হঠাৎ মনে হলো, কালো পাড় করা ঘিয়ে রঙের একটা চাদর সে পড়তো আমাদের ছোটবেলায়, তাই মনে হলো।
আচ্ছা ঠিক আছে তোমরা ভাল আছো তো?
কথা বলতে বলতে স্টেডিয়ামের বাইরে চলে আসে সে। তারপর লাফ দিয়ে গাবতলীর বাসে উঠে পড়ে, গ্রামের বাড়ি যাবে। লক্ষণের চিতায় কাঠ দেবে সে। সাথে একটা বাঁশি। বাঁশি সে কিনবে কাঞ্চননগর বাজার থেকে।
এস এস
বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুনঃ https://www.ajkerbangladeshpost.com