ন্যাভিগেশন মেনু

ভৈরবে বড়ভাইকে হত্যা করে বিচার চেয়েছিল ছোটভাই


কিশোরগঞ্জের ভৈরবে আপন বড়ভাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করে আসামি নিজেই হত্যার বিচার দাবি করেন। পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দীর্ঘ তদন্তে বেড়িয়ে আসে হত্যাকাণ্ডের আসল ঘটনা। 

এ ঘটনায় পিবিআই কিশোরগঞ্জ জেলা (ইউনিট ইনর্চাজ) পুলিশ সুপার মো. শাহাদাত হোসেনের তত্ত্বাবধানে গ্রেপ্তারকৃত আসামি মো. রিপন মিয়া (৩৫), আব্দুর রব (৩৫), ইমান আলী (২৮) ও সবুজকে (৩৫) গত ১৭ সেপ্টেম্বর নিজ নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। পরে তাদের ভাষ্যমতে উন্মোচিত হয় হত্যার আসল ঘটনা।

মূলতঃ পারিবারিক, জমিজমা নিয়ে বিরোধ এবং নেশা করতে বাধা দেওয়ায় এসিড মেরে, পানিতে ডুবিয়ে ঘাড় ভেঙ্গে নৃশংসভাবে স্বপন মিয়াকে (৩৮) হত্যা করে তার আপন ছোটভাই মো. রিপন মিয়া (৩৫)।

রিপন মিয়া পরবর্তীতে ভাই হত্যায় বাদি হয়ে এজাহারে সন্দেহজনক তিন জনকে এবং অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।

মামলার তথ্যদাতা হিসেবে বাদিকে মূল অপরাধী হিসেবে সন্দেহ করা প্রচলিত ধারণার পরিপন্থী। কারণ ভিকটিমের পক্ষে তাকেই মামলা প্রমাণ করতে হয়। তাই বাদিকে দোষী প্রমাণ করতে যথেষ্ট ও সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রয়োজন হয়।

তদন্তে জানা যায়, ভিকটিম স্বপন মিয়ার চার ভাই ও এক বোন। ভাইদের মধ্যে ভিকটিমের বড়ভাই খোকন মিয়া (৪০) সৌদি প্রবাসী। স্বপন মিয়া স্থানীয় বাজারে চা বিক্রেতা আর আসামি মো. রিপন মিয়া ভিকটিমের ছোটভাই।

রিপন মিয়া আগে মালয়েশিয়া প্রবাসী ছিল। ঘটনার অনুমান ২-৩ বছর আগে মো. রিপন মিয়া মালয়েশিয়া থেকে দেশে আসেন। করোনার কারণে উক্ত আসামি বিদেশে না যেতে পেরে বাড়ির পাশে মাছের খামারসহ কৃষিজমি আবাদ করতেন। 

ভিকটিমের সবার ছোট ভাই সোহেল মিয়া (৩১) একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি। 

অন্যদিকে স্বপন মিয়া হত্যাকাণ্ডের তিনদিন পর তার ছেলের জন্ম হয়। তাই তার স্ত্রী মামলার বাদি হতে পারেননি। 

গ্রেপ্তারের পর আসামি মো. রিপন মিয়া প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তার বড়ভাই স্বপন মিয়াকে হত্যার করেছে মর্মে স্বীকার করায় উক্ত আসামিকে আদালতে পাঠানো হয়।

রিপন মিয়া গত ১৮ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. শহীদুল ইসলাম চৌধুরীর আদালতে  বড়ভাই স্বপন মিয়াকে হত্যার কথা স্বীকার করেন। সেইসঙ্গে আরও ৫ জনের নাম উল্লেখ করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। গ্রেপ্তার অপর তিন আসামিকেও আদালতে পাঠানো হয়। 

তদন্তে জানা যায়, মো. রিপন মিয়া নিয়মিতভাবে তার কয়েকজন বন্ধুর সাথে ইয়াবা ও গাঁজা সেবন করতো। এছাড়া স্বপন মিয়ার সাথে  রিপন মিয়ার পারিবারিক বিভিন্ন কারনসহ পৈতৃক জমিজমা বন্টন নিয়ে বিরোধ ছিল। তাছাড়া রিপন মিয়াকে নেশা করতে স্বপন মিয়া বাধা দিতো। তার নেশার বিষয়টি তাদের মাকে জানিয়ে দেওয়ায় রিপন মিয়া বড়ভাই স্বপন মিয়ার উপর ক্ষিপ্ত ছিল।

তাছাড়া, ভিকটিম বাড়ি থেকে নতুন রাস্তা নির্মাণের ১৫ হাজার টাকা রিপন মিয়াকে না দেওয়ায় তিনি বড়ভাই স্বপন মিয়ার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার পথ খুঁজতে থাকেন। 

এসব বিরোধের জেরে গত ২৫ জুলাই রাত অনুমান ১০টার দিকে রিপন মিয়াসহ তার পূর্ব পরিচিত আব্দুর রফ, ইমান আলী, সবুজ, বুলবুল আলম (আলকাছ) মিয়ার পুকুর পাড়ে বসে স্বপন মিয়াকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ি রিপন মিয়ার এসিড কিনতে ২০০ টাকা দেয় ইমান আলী এবং বুলবুলকে। পরে তারা ভৈরব থেকে এসিড কিনে রিপন মিয়ার কাছে দিলে তিনি এসিডের বোতল তার বাড়ির পাশে পুকুর পাড়ে রেখে দেন।

রিপন মিয়া ঘটনার সময় ব্যবহৃত ভিবারটেক (এক ধরণের গাড়ি) ঠিক করার দায়িত্ব ইমান আলী ও বুলবুলকে দেয়।

পরবর্তীতে ২৬ জুলাই রাত অনুমান ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার দিকে এসিডের বোতলসহ রিপন মিয়া, ইমান আলী, সবুজ, বুলবুল, আব্দুর রব এবং ভিবারটেকের চালককে নিয়ে তার গ্রামের লতিফ মাকের্টের ভিতরে অবস্থান নেয়।পরে ভিকটিম স্বপন মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে লতিফ মার্কেটের সামনে আসলে উপরোক্ত আসামীরা সবাই ভিকটিমকে ঘিরে ধরে এবং বুলবুল ও সবুজ ভিকটিমকে পিছন থেকে গামছা দিয়ে নাকে মুখে পেঁছিয়ে ধরে। ইমান আলী ও আব্দুর রব ভিকটিম স্বপনকে জোড় করে বিভারটেক গাড়িতে তুলে। 

গাড়িতে তোলার পর ছোট রাজাকাটা কবরস্থানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় স্বপন মিয়া বাঁচার জন্য কৌশলে নিজেকে মুক্ত করে চলন্ত বিভারটেক থেকে লাফ দিয়ে দৌড় দিলে আসামী ইমান আলী তার হাতে থাকা এসিডের বোতল  স্বপন মিয়ার উপর ছুড়ে মারে। ফলে এসিডে স্বপন মিয়ার চোখ, মুখ ও নাকে লাগলে তিনি বাঁচার জন্য জোরে চিৎকার দিতে দিতে দৌড়ে পাশের বিলের পানিতে লাফ দেয়।

পরে ওই পাঁচ আসামীও বিলের পানি থেকে স্বপন মিয়াকে ধরে পানির নিচে চাপ দিয়ে ধরে রাখে। এ সময় রিপন, ইমান আলী এবং আব্দুর রব ভিকটিমের হাত পা জোর করে ধরে রাখে এবং আসামী বুলবুল এবং সবুজ মিয়া ভিকটিমের ঘাড় ভেঙ্গে ফেলে। এর কিছুক্ষণ পর স্বপন মিয়ার মৃত্যু হয়।

পরবর্তীতে তারা ভিবারটেকের চালকের সহযোগিতায় ভিকটিমের লাশ বিল থেকে উঠিয়ে ভিবারটেকে তোলে ৫০-৬০ গজ দূরে একটি কালভার্টের নিচে ফেলে যার যার মতো করে পালিয়ে যায়।

রিপন মিয়া হত্যার পরিকল্পনা করার সময় আসামী সবুজকে ৫ হাজার টাকা দেয়। এছাড়া পরিকল্পনা করার সময়  রিপন মিয়া অপারেশন সফল হলে প্রত্যেককে খুশি করে দেওয়ার কথা বলে।

পরের দিন স্বপন মিয়ার লাশ কালভার্টের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়।

পরে ২৯ সেপ্টেম্বর রিপন মিয়া ভৈরব থানায় তার ভাই স্বপন মিয়া হত্যার অভিযোগ দায়ের করেন।

মামলার পর থেকে পিবিআইয়ের ক্রাইমসিন ইউনিট ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ছায়া তদন্ত শুরু করে। ছায়া তদন্ত চলাকালে পিবিআই বাদির আচরণে সন্দেহ পরিলক্ষিত হলে মামলাটি অধিকতর তদন্ত করতে পুলিশ পরিদর্শক (নিঃ) মোহাম্মদ সাখরুল হক খানকে তদন্তের দায়িত্ব দেন।

এডিবি/