ন্যাভিগেশন মেনু

মহারাষ্ট্রে মহানাটক, অঙ্ক বদলে মুখ্যমন্ত্রী বিজেপির ফড়নবিস, উপমুখ্যমন্ত্রী অজিত


মৌসুমি দাস, কলকাতা থেকে

বলিউডের সুপারহিট থ্রিলার সিনেমার স্ক্রিপ্টকে হারিয়ে দিলেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিস ও উপমুখ্যমন্ত্রী অজিত পাওয়ার। ভাইপোর পাওয়ার-প্লেতে ক্লিন বোল্ড মারাঠাভূমির দীর্ঘদিনের স্ট্রংম্যান কাকা শরদ পাওয়ার। মহারাষ্ট্রে বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের পর গত একমাস ধরে আরবসাগর তীরে চলছিল সরকার গঠনে চমকের পর চমক। কিন্তু শনিবার ভোরের আলো ফুটতেই মুম্বইয়ে কুর্সি দখল নিয়ে পর পর যা হল মহাচমক।

মহারাষ্ট্রে সরকার গঠনের জন‌্য জোট বঁধল বিজেপি-এনসিপি’র একাংশ। এনসিপি সুপ্রিমো  তথা কাকা শরদ পাওয়ারকে কার্যত অন্ধকারে রেখে শনিবার সকালে ফড়নবিসের বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিয়ে উপ-মুখ‌্যমন্ত্রী পদে শপথ গ্রহণ করেলেন অজিত পাওয়ার। মুখ‌্যমন্ত্রী পদে দ্বিতীয়বারের জন‌্য শপথ নিলেন দেবেন্দ্র ফড়নবিস। বিজেপির সঙ্গে অজিত পাওয়ার গোপনে সন্ধি করে রাতারাতি বদলে দিলেন মহারাষ্ট্রে সরকার গঠনের যাবতীয় নাটকের প্লট। আরবসাগরের তীরে প্রতিদিন শাহরুখ খান, সালমান খানদের নায়ক করে কত শত ক্রাইম-থ্রিলার সিনেমার চিত্রনাট‌্য রচনা হয়, সেই বলিউড মাটিতে রাজনীতির পটও যে মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যায় তারই উদাহরণ দেখল ভারতবাসী। শুক্রবার রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময়ও শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরে জানতেন শনিবারই তিনি মারাঠাভূমের মুখ‌্যমন্ত্রী হচ্ছেন। আর এদিন সকালে তাঁর ঘুম ভাঙল বিজেপির দেবেন্দ্র ফড়নবিসের মুখ‌্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়ে নেওয়ার খবর শুনে। “ক্রিকেট আর রাজনীতিতে যে কোনও মুহূর্তে সব কিছু ওলটপালট হয়ে যেতে পারে। যখন মনে হবে তুমি ম‌্যাচ হেরে যাচ্ছে তখনই রেজাল্ট বদলে যায়।” দিন কয়েক আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিজেপির অন্যতম শীর্ষ নেতা নীতিন গড়করির বলা এই কথাটাই যেন সত্যি হয়ে গেল।

শুক্রবার গভীর রাতেই বিজেপি-এনসিপির একাংশের মধ্যে জোট চূড়ান্ত হয়। সেই মতো রাজ‌্যপালকেও সরকার গঠনের বিষয়টি জানান ফড়নবিস। এদিন ভোর ৫.৪৭ মিনিটে মহারাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রপতি শাসন প্রত‌্যাহার করে দেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে সে কথা জানানো হয়। দিল্লিতে ছিলেন রাজ্যপাল ভগৎ সিং কোশিয়ারি। তিনিও ভোররাতে মুম্বই ফিরে আসেন। কাকপক্ষী টের পাওয়ার আগেই সকাল আটটা নাগাদ এদিন শপথ গ্রহণ করেন ফড়নবিস। তিনি বলেন, “মহারাষ্ট্রে খিচুড়ি শাসন নয়, স্থায়ী সরকারের প্রয়োজন। আমাদের রাজ‌্যপাল সরকার গঠনে ডেকেছিলেন। এনসিপি সমর্থন করায় তাদের ধন‌্যবাদ।” এদিন রাজ‌্যপাল ভগৎ সিং কোশিয়ারি তাদের শপথ বাক‌্য পাঠ করান। ফড়নবিস ও অজিত পাওয়ারকে মহারাষ্ট্রে সরকার গঠন ও নতুন দায়িত্বের জন‌্য অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ।

এনসিপি প্রধান প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শরদ পাওয়ার অবশ‌্য সকালেই জানান, তিনি এই জোটের ব‌্যাপারে আগে থেকে কিছুই জানতেন না। সকাল সাতটায় তাঁকে জানানো হয় বিজেপির সঙ্গে তাঁর দল জোট সরকার গড়ছে।  ভাইপোর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “বিজেপির সঙ্গে জোটের সিদ্ধান্ত আমার নয়। অজিত পাওয়ারের।” এদিন দুপুরে শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরেকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “অজিতের সিদ্ধান্ত দলের নীতিবিরুদ্ধ। শৃঙ্খলাভঙ্গের শামিল। ওর সঙ্গে কয়েকজন বিধায়ক এই সিদ্ধান্ত নেন। ওঁদের বিরুদ্ধে যা ব‌্যবস্থা নেওয়ার নেব। ওঁদের বিধানসভার সদস‌্য পদ কেড়ে নেওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে। দলবিরোধী আইনে পদক্ষেপ করা হবে। ১০—১১ জন  বিধায়ক অজিতের সঙ্গে গিয়েছিল। ওঁরা এখন আবার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। ওঁদের অনেকের দাবি ভুল বুঝিয়ে এদিন তাদের রাজভবনে নিয়ে যায় অজিত। ওঁরা কিছু বোঝার আগেই শপথ হয়ে যায়। আমাদের সঙ্গে এনসিপি, কংগ্রেস, শিবসেনার ১৭০ বিধায়ক আছেন।” বিজেপিকে সমর্থন করা নিয়ে এনসিপিতে কাকা-ভাইপো যে দুই শিবিরে ভাঙন ধরেছে তা তাঁদের বক্তব‌্যতেই স্পষ্ট।

শরদের পাশে বসে এদিন উদ্ধব ঠাকরে বিজেপির নাম না করে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “ওরা শিবসেনার বিধায়কদের ভাঙানোর যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তা চালিয়ে যাক। মহারাষ্ট্রও ঘুমিয়ে থাকবে না।”কূটনীতিকদের একাংশের দাবি, শরদ পাওয়ার প্রকাশ্যে উদ্ধব ও সোনিয়ার সঙ্গে জোট বাঁধার কথা বললেও গোপনে বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। দু’দিন আগে দিল্লি এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতেই বিজেপি-এনসিপি জোটের ব‌্যাপারটি পুরো ঠিক হয়ে যায়।

শুক্রবার রাতেও সবাই জানতেন মহারাষ্ট্রে সরকার গড়তে চলেছে শিবসেনা-এনসিপি ও কংগ্রেস জোট। নতুন জোট সরকারের নাম ঠিক হয় ‘মহারাষ্ট্র বিকাশ আঘাড়ি’। উদ্ধবকে মুখ‌্যমন্ত্রী করতেও রাজি ছিলেন শরদ ও সোনিয়া গান্ধী। গত কয়েক সপ্তাহে সরকার গঠনের জন‌্য শিবসেনা ও কংগ্রেসের মধ্যে যোগসূত্র গড়তে মুম্বই-দিল্লিতে সবচেয়ে বেশি ছোটাছুটি করছিলেন ৭৮ বছরের শরদ। প্রায় রোজই উদ্ধব ও সোনিয়ার সঙ্গে কথা বলে জোট সরকারের বিষয়টি চূড়ান্ত করে ফেলেছিলেন। এদিন সকালে জোট সরকারের মহারাষ্ট্রে ক্ষমতা দখলের কথা ছিল। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে দেশবাসী শুনল সম্পূর্ণ অন‌্য কথা। বিজেপি-এনসিপি জোট শুধু হলই না, সবাইকে অন্ধকারে রেখে কোনও ঘোষণা ছাড়াই একবারে মুখ‌্যমন্ত্রী ও উপ-মুখ‌্যমন্ত্রী পদে শপথও নিয়ে ফেললেন ফড়নবিস ও শরদের ভাইপো অজিত। এই ঘটনায় কংগ্রেস নেতা আহমেদ প‌্যাটেল এ প্রসঙ্গে বলেন, “মাঝ রাতে গোপনে বেআইনি ও দুষ্ট রণকৌশল নেওয়া হয়েছে। এমন লজ্জাকর ব‌্যাপার যে ওঁদের গোপনে শপথ নিতে হল। এমন অবৈধ সরকার গঠন নিজেদেরই বিপর্যয় আনবে।”

 বিধানসভা নির্বাচনে ২৮৮টি আসনের মধ্যে বিজেপি জেতে ১০৫, কংগ্রেস ৪৪, এনসিপি ৫৪, শিবসেনা ৫৬টি। ম‌্যাজিক ফিগার ১৪৫। আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে এই জোট সরকারকে বিধানসভায় সংখ‌্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে হবে। শরদ পাওয়ারের দাবি, এই সরকার আস্থা ভোটে জিতবে না। শরদ-কন‌্যা এনসিপি নেত্রী কাকা অজিতের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে হোয়াটসঅ‌্যাপ স্টেটাসে লেখেন, “দল এবং পরিবার ভেঙে গেল। কাকে বিশ্বাস করব? জীবনে এত প্রতারিত হইনি।” এদিন কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সিং সুরজেওয়ালা টুইটারে লিখেছেন, “মহারাষ্ট্রবাসীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন অজিত পাওয়ার। এটা গণতন্ত্রকে হত‌্যা।” শিবসেনা মুখপাত্র সঞ্জয় রাউতও ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেন, “অজিত পাওয়ার মহারাষ্ট্রবাসীকে পিছন থেকে ছোরা মেরেছে। এনসিপির যে সব বিধায়ক বিজেপির সঙ্গে সমঝোতা করলেন তারা আসলে মহারাষ্ট্রে ছত্রপতি শিবাজি মহারাজকে অসম্মান করেছেন।” বিজেপি টাকা ও ক্ষমতার অপব‌্যবহার করে এনসিপির সমর্থন পেয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। কেউ আবার বিজেপির বিরুদ্ধে বিধায়ক কেনা-বেচার অভিযোগও তুলেছেন। বিকালে এনসিপির সমস্ত বিধায়কদের নিয়ে বৈঠকে শরদ পাওয়ার বৈঠকে বসেন। সেখানে যে বিধায়ক অজিতের সঙ্গে রাজভবনে গিয়েছিলেন তিনিও এসে যোগ দেন। বলেন,“আমাকে ভুল বুঝিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।” শরদ পাওয়ার অবশ্য স্পষ্ট করে দিয়েছেন আপাতত ভাইপো অজিতকে এখনই বহিস্কার করে দিচ্ছেন না। কারণ, তাতে করে দল ভেঙে যেতে পারে, সুবিধা পেয়ে যেতে পারে বিজেপি।

একই ধরণের সংবাদ পেতে এখানে ক্লিক করুন