ন্যাভিগেশন মেনু

১১ ডিসেম্বর যেভাবে হানাদারমুক্ত হয়েছিলো মুন্সীগঞ্জ


আজ ১১ ডিসেম্বর, মুন্সীগঞ্জ হানাদারমুক্ত দিবস। এই দিনে মুন্সীগঞ্জবাসী হানাদারদের অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়।

কিভাবে মুন্সীগঞ্জ হানাদারমুক্ত হয়েছিলো সেই স্মৃতিময় মুহুর্তগুলো তুলে ধরে আজকের বাংলাদেশ পোষ্টের জেলা প্রতিনিধি মোঃ রুবেল এর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন তিন থানার (মুন্সীগঞ্জ, গজারিয়া ও টঙ্গীবাড়ি) বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) যুদ্ধকালীন কমান্ডার ও মুন্সীগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক আহ্বায়ক হাজী মোহাম্মদ হোসেন বাবুল। 

সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যদিয়ে তৈরি হলো মহান মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশনা। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতির জন্য রক্ত টকবগ করে উঠলো। ২৫ মার্চ পাক হানাদাররা বাঙ্গালীদের উপর ঝাপিয়ে পড়ার মধ্যদিয়ে শুরু হলো পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিহত করার প্রস্তুতি।

৯ মে মুন্সীগঞ্জে পাকবাহিনী প্রবেশ করে। ১১ মে মুন্সিগঞ্জে প্রথম আমার বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। ১৮ মে বিএলএফ এর ট্রেনিং নেওয়ার জন্য  ভারতের উদ্দেশ্য রওনা হই। ১১ জুলাই ট্রেনিং শেষে শেখ ফজলুল হক মনির উপস্থিতিতে তিন থানার (মুন্সিগঞ্জ, গজারিয়া এবং টঙ্গিবাড়ী) কমান্ডারের দায়িত্ব প্রাপ্ত হই।

তিনি আরও বলেন, ১৯৭১ সালের ১০ জুলাই বাংলাবাজার ইউনিয়নের ভূকৈলাশ গ্রামে আমরা ৩টি নৌকায় ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্প স্থাপন করি। ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে আমরা ১০জন তৎকালীন মুন্সীগঞ্জ মহকুমার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রথম প্রবেশ করি। ভাসমান ক্যাম্পে ভারতীয় ট্রেনিংপ্রাপ্ত মোঃ মহিউদ্দিন (সাবেক এমপি), মরহুম খালেদুজ্জামান খোকা, শহীদুল আলম সাঈদ, শহীদ নজরুল ইসলাম (গজারিয়ায়  পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধে যিনি শহীদ হন), আশরাফ-উজ্জামান আশরাফ, ইকবাল হোসেন (লৌহজংয়ের সাবেক এমপি), আব্দুল শহীদ খান, সেন্টু, মরহুম শেখ হুমায়ন, ডাঃ মোঃ মতিন ও আনিছ উজ্জামান আনিস অবস্থান করি।

এছাড়া ভাসমান ক্যাম্পে মোয়াজ্জেম হোসেন, মোহাম্মদ আলী, আশা, তোফাজ্জল হোসেন, মোঃ মহসিন, জাকারিয়া মোল্লা, খোরশেদ দিদার, সলেমান বেপারী, আবুল কাশেম, মরহুম মোফাজ্জেল হোসেন মোফা, মতি, মান্নান, শহীদ মুজিবুর রহমান, আরীফ কমিশনার, হানিফ মাঝি ও গোলাম মোস্তফা যোগ দেন।

মোহাম্মদ হোসেন বাবুল বলেন, ১০ আগস্ট আশরাফুজ্জামান আশরাফ, খালেকুজ্জামান খোকা, শেখ হুমায়ন ও ডাঃ মতিনসহ ৫ জন লৌহজং থানা অপারেশনের জন্য রওনা দেই। ১২ আগস্ট লৌহজংয়ের কোলাপাড়া গ্রামের মরহুম মালেকের (তৎকালীন লৌহজং আওয়ামী লীগ নেতা) বাড়িতে অবস্থান নেই। ভারতীয় ট্রেনিং ও দেশিয় ট্রেনিংপ্রাপ্ত মোট ১৪ জন মালেকের বাড়িতে বসে থানা অপারেশনের পরিকল্পনা করি। ১৪ আগস্ট রাত ১২টার দিকে থানার পশ্চিম দিকে খালের কচুরিপানা দিয়ে ভেলা তৈরি করে তাতে আমাদের অস্ত্র রেখে আমরা থানার পাশে এসে অবস্থান নেই। তখন আমাদের সাথে ছিলো দুটি এলএমজি ও অন্যান্য অস্ত্র। যা মহকুমার অন্য কারও নিকট ছিলো না। 

তখন সিদ্ধান্ত মোতাবেক খালেকুজ্জামান গ্রেনেড চার্জ করার সাথে সাথেই মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ার শুরু হলো। সময় ১২টা ১ মিনিট। আধ ঘন্টা পর্যন্ত আমাদের গুলির কোন জবাব না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না কে আগে তীরে উঠবে। এক ঘন্টার মধ্যে আমরা থানা দখল করে নেই। থানার ভিতরে গিয়ে দেখি পেছনের দরজা দিয়ে সবাই পালিয়েছে। তারপর অস্ত্রাগার থেকে ২টি পিস্তল ও ৩০টি রাইফেল উদ্ধার করে থানা জ্বালিয়ে দিলাম। আমাদের লৌহজং অপারেশনই ছিল মুন্সীগঞ্জে প্রথম সশস্ত্র অভিযান।

তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত আমরা পুনরায় কোলাপাড়া মালেকের বাড়িতে চলে আসি। লৌহজংয়ে ভালো করে একটি ক্যাম্প করার জন্য শহীদুল আলম সাঈদ ও এমপি ইকবালের কাছে ৩০টি রাইফেল ও ১টি পিস্তল রেখে আসি। আমরা একটি পিস্তল নিয়ে মুন্সিগঞ্জে চলে আসি। মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা যুবকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। চর্তুদিকে জয় বাংলা শ্লোগান ছড়িয়ে পড়ে। স্বেচ্ছায় অনেকেই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। পরবর্তীতে সেপ্টেম্বর, অক্টোবরের দিকে ১১ বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ১৭ জন ট্রেনিংপ্রাপ্ত পুলিশ ও স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণকারী ৮০/৯০ জনের একটি শক্তিশালী টিম গঠন করি। এই টিমটিকে প্রায় ৮টি গ্রুপে বিভক্ত করে বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়। 

অক্টোবরের দিকে রামপাল স্কুলে আমাদের ৬০/৭০ জনের একটি টিম একত্রিত হই। ১৪ নভেম্বর ধলাগাও এসে সিদ্ধান্ত নিই, আমরা মুন্সীগঞ্জ থানা অপারেশন করবো। সকাল ১০টায় রামপাল বিদ্যালয় থেকে চর্তুদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর পাঠাই একসাথে থানা আক্রমণ করবো। ১৪/১৫ জন করে এক একটি ইউনিট গঠন করে চর্তুদিকে অবস্থান নিই। তখন রমজান মাস। রাত ২টায় মুন্সীগঞ্জ থানায় ৩ ঘন্টাব্যাপি সফল অপারেশন চালাই এবং আমাদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসি। 

৪ ডিসেম্বর পাকবাহিনী পালবাড়ির দিকে রওনা হয়। এ খবরটি পেয়ে আমরা বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নিউ। সকাল ৭টার দিকে পাকবাহিনী রতনপুর এলাকায় প্রবেশ করার সাথে সাথে আমরা অতর্কিত আক্রমন করি। এতে পাকবাহিনীর তিন সদস্য মারা যায়। মৃত লাশ নিয়ে পাকবাহিনী মুন্সীগঞ্জে রওনা দেয়। ৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন বরাবর ইংরেজিতে একটি চিঠি পাঠাই।

চিঠিতে বলা হয়, মুক্তিবাহিনী চর্তুদিকে এম্ব্রুশে রয়েছে। পাকবাহিনী যদি ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে ঘাটি ছেড়ে না যায় মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করবে। এই চিঠির প্রেক্ষিতে পাকবাহিনী ৯ ডিসেম্বরের পূর্বেই মুন্সীগঞ্জ ছেড়ে মুক্তারপুর নদীর পাড়ে তাবুতে অবস্থান নেয়। এ খবরটি ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ১১ ডিসেম্বর জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে সকল মুক্তিযোদ্ধা মুন্সীগঞ্জ শহরে প্রবেশ করি এবং মুন্সীগঞ্জ হানাদার মুক্ত হয়।

এম আর/সিবি/এডিবি