ন্যাভিগেশন মেনু

শেখ হাসিনার দেশ সেবায় ৩৮ বছর


নয় মাস পর পাকিস্তানের বন্দি দশা থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশের মাটির স্পর্শ  করে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বাঙালির জনকের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাও ছয় বছর বাদে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরেছিলেন সামরিক জান্তার রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করেই।খুশির আনন্দ অশ্রু ঝড়িয়ে বাঙালি যেমন বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়েছিল তেমনিভাবেই দেশবাসী শেখ হাসিনাকে বরণ করে নিয়েছিল।

পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হারিয়ে শেখ হাসিনা গত ৩৮ বছর ধরে দেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে নিরলসভাবে দেশ গড়ার কাজ করে যাচ্ছেন। এরমাঝে তাঁকেও একাধিকবার হত্যার অপচেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তিনি ভয়কে জয় করে দেশের সেবা করে যাচ্ছেন। এজন্য একাধিকবার দেশে-বিদেশে দুর্লভ সম্মান অর্জন করেছেন।যা বাংলাদেশে বিরল।  

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ১৭ জানুয়ারি। এদিন ঢাকার বিমানবন্দরে অবতরণের পর লাখ লাখ লোক তাঁকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানিয়েছিল।

সেদিন দেশবাসী বঙ্গবন্ধুর ছায়া দেখতে পেয়েছিলেন শেখ হাসিনার মাঝে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ঢাকায় নেমেই আপনজনের মঝে ফিরতে পেরে আনন্দে  কেঁদেছিলেন।

তেমনি ঢাকায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে মঞ্চে উঠে শেখ হাসিনাও কেঁদেছিলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে হৃদয়ের আবেগ ঢেলে সেদিন বলেছিলেন, ‘আজকের জনসভায় লাখো চেনামুখ আমি দেখছি। শুধু নেই প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাই, আরও অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। আপা বলে ডাকবে না।

সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন। স্বামী-সংসার-ছেলে রেখে আপনাদের কাছে এসেছি। বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার জন্য আসিনি।

আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই। আবার বাংলার মানুষ শোষণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হচ্ছে।

আমি চাই বাংলার মানুষের মুক্তি। শোষণের মুক্তি। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করেছিলেন। আজ যদি বাংলার মানুষের মুক্তি না আসে তবে আমার কাছে মৃত্যুই শ্রেয়। আমি আপনাদের পাশে থেকে সংগ্রাম করে মরতে চাই।’

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয়। সেদিন শেখ হাসিনা তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা, স্বামী ও দুই সন্তানসহ পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। এরফলে তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান।

পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়া পশ্চিম জার্মানি থেকেই স্ত্রী শেখ হাসিনা, শ্যালিকা শেখ রেহানা এবং দুই শিশুসন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং প্রাণ রক্ষার জন্য ভারত সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী।

নিরাপত্তার কারণে অতিগোপনে ২৪ আগস্ট সকালে ভারতীয় দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা তাঁদের ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নিয়ে যান। এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে ২৫ অগাস্ট সকালে দিল্লি পৌঁছান শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, ওয়াজেদ মিয়া এবং তাদের দুই সন্তান।

তাঁরা গিয়ে ওঠেন দিল্লির ডিফেন্স কলোনির একটি বাসায়।বাসায় ছিল একটি ড্রয়িং-কাম-ডাইনিং রুম এবং দুটো বেডরুম। বাংলাদেশে সেন্সরশিপ থাকায় দেশের খবর তেমন ভারতের পত্রিকায় ছাপা হতো না। তাই বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে একরকম অন্ধকারে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে।

শেখ হাসিনা দিল্লি পৌঁছানোর দুই সপ্তাহ পর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে ১৫ আগস্ট মর্মান্তিক ঘটনা জানতে পারেন। পরে শেখ হাসিনাকে ইন্ডিয়া গেটের কাছে পান্ডারা পার্কের ‘সি’ ব্লকে একটি ফ্ল্যাট দেওয়া হয়।

পরে আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান, আব্দুস সামাদ আজাদ, আমির হোসেন আমু, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী দিল্লি গিয়ে গিয়ে শেখ হাসিনাকে দলের নেতৃত্ব গ্রহণের অনুরোধ করেন।

শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন তিনি।একই বছরের ১৭ মে তিনি দেশে ফেরেন।

১৬ মে শেখ হাসিনা ও পুতুল দিল্লি থেকে একটি ফ্লাইটে কলকাতা পৌঁছান। ১৭ মে বিকেলে তাঁরা কলকাতা থেকে ঢাকায় পৌঁছান। তাদের সঙ্গে ছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ ও এম কোরবান আলী।

সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ তেজগাঁওয়ের পুরনো বিমানবন্দরে গিয়ে শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।

বিমানবন্দরের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য রাখার পর শেখ হাসিনাকে নিয়ে যাওয়া হয় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে। শেখ হাসিনা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন,‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’দেশে ফেরার পর শেখ হাসিনাকে শরণার্থীর মতোন বাস করতে হয়েছিল।তাকে ঢাকা শহরে বিভিন্ন আত্মীয় স্বজন , শুভাকাক্ষীর বাসায় পালাক্রমে থাকতে হয়েছে।

প্রথম কয়েকদিন থাকেন শেখ জামালের শ্বশুর সৈয়দ হোসেনের লাল মাটিয়ার বাসায়।এরপর ছিলেন শেখ সেলিমের বাসায়। মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের জনৈকা সেলিমাখালার বাসা ও ধানমন্ডির ‘জলি খালা’র বাসায় ছিলেন।কলাবাগানে বঙ্গবন্ধু পরিবারের পারিবারিক চিকিৎসক ডা: এস এ মালেকের বাসা ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর বাসায় ছিলেন।

সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে শেখ হাসিনাকে প্রবেশ করতে দেয়নি। পরিবারের সদস্যদের জন্য করতে পারেননি মোনাজাত বা কোনো দোয়া মাহফিলের।

কিছু নিবেদিতপ্রাণ দলীয় নেতাকর্মী নিয়ে ৩২নং বাসার সামনের রাস্তায় বসে মিলাদ পড়িয়েছিলেন। অবশ্য অনেক দিন পরে তাঁকে ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারে থাকতে দেওয়া হয়।’

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তুলেছিল স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়া। সংবিধান স্থগিত করে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষিত করা হয়েছিল। রাজনীতিকদের বেচাকেনার সামগ্রীতে পরিণত করে রাষ্ট্রীয় মদদে দলভাঙার নীতি অবলম্বন করা হয়েছিল।

দেশে ফিরে তাঁকে অনেক হেনস্থা পোহাতে হয়। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সামরিক সরকার তাঁকে আটক করে ১৫ দিন অন্তরীণ রাখে। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি এবং নভেম্বর মাসে তাঁকে দু’বার গৃহবন্দী করা হয়।

১৯৮৫ সালের ২ মার্চ তাঁকে আটক করে প্রায় ৩ মাস গৃহবন্দী করে রাখা হয়। ১৯৮৬ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে তিনি ১৫ দিন গৃহবন্দী ছিলেন। ১৯৮৭ সালে ১১ নভেম্বর তাঁকে গ্রেফতার করে এক মাস অন্তরীণ রাখা হয়।

১৯৮৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা গ্রেফতার হয়ে গৃহবন্দী হন। ১৯৯০ সালে ২৭ নভেম্বর শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু ভবনে অন্তরীণ করা হয়।

ওয়ান ইলেভেনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেফতার হয়ে প্রায় ১১ মাস বিশেষ কারাগারে বন্দি ছিলেন তিনি।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ চার মেয়াদে ক্ষমতাসীন হয়েছে। প্রথমবার ১৯৯৬ সালে, দ্বিতীয়বার ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ মহাজোট চার-তৃতীয়াংশ আসনে বিশাল বিজয়ী হয়ে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠন করে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিশাল বিজয় নিয়ে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। সর্বশেষ গত বছরের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবারও ভূমিধস জয়ের পর ৭ জানুয়ারি সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন আওয়ামী লীগ সভাপতি।