ন্যাভিগেশন মেনু

শৈল্পিকতার এক অনন্য নিদর্শন আদমজী জামে মসজিদ

“আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,

আমার ক্ষুধার অন্ন তা’বলে বন্ধ করোনি প্রভু

তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,

মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!”

কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই আকুতি রেখেছে পাকিস্তান আমলে নির্মিত আদমজী জামে মসজিদ।

এ মসজিদের প্রধান বিশেষত্ব হলো দরজা-জানালাবিহীন ১৯টি প্রবেশদ্বার এবং মসজিদের সামনে শান বাঁধানো পুকুর ঘাট। এশিয়ার বৃহত্তম আদমজী পাটকল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী সোনামিয়া বাজার সংলগ্ন বিহারী ক্যাম্পে ঐতিহ্যবাহী এ জামে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।

দূর থেকেই দেখা যায় একটি সুদীর্ঘ মিনার। ব্যস্ত রাস্তার পাশে মিনারটি যেন জানান দিচ্ছে- এখানে একটি মসজিদ আছে। কাছে আসতেই চারপাশ জুড়ে সবুজের সমারোহ চোখে পড়লো। যার চোখ জুড়ানো নির্মাণশৈলী দেখে যেকোনো পথিক ক্ষণিকের জন্য থমকে যেতে বাধ্য। শৈল্পিকতার অন্যতম নিদর্শন দরজা-জানালাবিহীন মসজিদটি অর্ধশত বছরের পুরনো।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৪৫ সালে আদমজী মিল স্থাপনের সময় তৎকালীন ধনাঢ্য বাইশ পরিবারের অন্যতম গুল মোহাম্মদ আদমজী শ্রমিক-কর্মকর্তাদের জন্য মিলের অভ্যন্তরে নির্মাণ করেন এ মসজিদ। প্রায় ২ একর জায়গার উপর অবস্থিত মসজিদটি ৯০ ফুট দৈর্ঘ্য, ৬৫ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট ১২টি সুদর্শন থামের উপর স্থাপিত। পশ্চিম দিক ছাড়া বাকি তিন দিকেই রয়েছে প্রস্থ বারান্দা। ৬০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৬০ ফুট প্রস্থ তিন পাশের বারান্দার ছাদটি মোট ৭০টি পিলারের উপর নির্মিত।

মসজিদটির উপরিভাগে রয়েছে ছোট ছোট আটটি গম্বুজবেষ্টিত একটি বড় গম্বুজ। পূর্ব-দক্ষিণ কোণে অবস্থিত সুউচ্চ একটি মিনার, যেখানে ওই সময়ে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা না থাকায় খালি গলায় মুয়াজ্জিন আযান দিতেন। বর্তমানে এ মসজিদে একসঙ্গে প্রায় তিন হাজারের অধিক মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। আগে এই মসজিদে একজন খতিব, একজন পেশ ইমাম, দুইজন মুয়াজ্জিন, একজন করে খাদেম, মালী ও সুইপার কর্মরত ছিলেন যার ব্যয়ভার আদমজী জুট মিল বহন করতো। জনবল কমে গিয়ে বর্তমানে ইমাম-মুয়াজ্জিনসহ চারজনে নেমে এসেছে।

দীর্ঘ ১৯ বছর ইমামের দায়িত্ব পালন করে আসা এ মসজিদের খতিব হাফেজ মো. সোলায়মান জানান, ১৯৫২ সালের দিকে এ মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয়। একজন মুসলমান ব্যক্তি মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা ছাড়াও যেনো আল্লাহর নিকট যেকোনো সময় সিজদাহ দিতে পারে সে ধ্যান-ধারণা থেকেই মসজিদটি এইভাবে নির্মিত হয়েছে। এ কারণেই মসজিদটি অন্যান্য মসজিদ থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।

এ মসজিদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়টিই হলো এর প্রবেশদ্বার, যা কখনোই বন্ধ হবে না। এই মসজিদ ২৪ ঘন্টাই খোলা থাকে। সেজন্য অনেকেই এই মসজিদটিকে খোলা (শিয়া) মসজিদ বলে থাকে। যতোই গরম হোক না কেনো এই মসজিদে সবসময় শীতল পরিবেশ বিরাজমান থাকে বলে জানান তিনি। 

২০০২ সালে ৩০ জুন আদমজী জুট মিল বন্ধ হয়ে গেলে আদমজী উম্মুল ক্বোরা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হাকীম মো: জয়নুল আবেদীন কয়েকজন মুসল্লিকে নিয়ে মসজিদের হাল ধরেন এবং বিভিন্ন জনের সহযোগিতায় মসজিদের উন্নয়ন কাজ চালিয়ে আসছেন। বর্তমানে তিনি মসজিদটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

তার দেওয়া তথ্যমতে, আদমজী জুটমিলের নিজস্ব ৩০০ একর জায়গায় এ মসজিদটিসহ প্রায় ১৩টি মসজিদ ছিল। মিল বন্ধের পর এ মসজিদটি বাদে বাকী সবগুলো মসজিদও বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, মিল বন্ধের পর ফ্যান লাইট চুরির ভয়ে মিল কর্তৃপক্ষ সবগুলো মসজিদের মাইক, ফ্যান ও সাউন্ড বক্স খুলে নিয়ে যায়। এতে চরম বেকায়দায় পড়ে মুসুল্লিরা।

বর্তমানে সবার সহযোগিতায় মসজিদটিতে নির্মাণ করা হয়েছে ২০ হাজার লিটার পানি ধারণ ক্ষমতার একটি পানির ট্যাংকি। মুসুল্লিদের জন্য বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করতে গভীর নলকুপ বোরিং করা হয়েছে। মসজিদের ছাদ, বাগান, বৈদ্যুতিক সংযোগ, মসজিদের বারান্দা থেকে পুকুরের ঘাটলা পর্যন্ত সংস্কার করা হয়েছে।

এছাড়া মসজিদের সৌন্দর্য বর্ধণে মসজিদের ভেতরে বাইরে টাইলস ও রংয়ের কাজ করা হয়েছে। মসজিদের মুসুল্লিরা যাতে স্পষ্টভাবে ইমামের কথাবার্তা-বয়ান শুনতে পারে এই জন্য ভেতরে ও বারান্দায় সাউন্ড সিস্টেম করা হয়েছে। বর্তমানে ইমামসহ অন্যান্য খাদেমকে সম্মানী দেওয়া হচ্ছে গাছের ফল, পুকুরের মাছ ও মুসল্লিদের দানের টাকা দিয়ে। নতুনভাবে মুসল্লিদের জন্য প্রায় ১ হাজার ২০০ বর্গফুটের অজুখানা নির্মাণ করা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, মতিন প্রধান যখন পৌরসভার মেয়র ছিলেন তখন মসজিদের ছাদ নির্মাণের জন্য সরকারি অনুদান পেয়েছিলেন। এরপর তারা আর কোনো সরকারি অনুদান পায়নি।

এলাকাবাসী জানান, আদমজী জুট মিলের নিরব সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা শৈল্পিক নিদর্শনের এ মসজিদ এখনই ঠিকভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে সংস্কারের অভাবে বিলীন হয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে প্রাচীন এই ঐতিহ্য।

এমএসএস/সিবি/এডিবি/