ন্যাভিগেশন মেনু

সৎ, নির্লোভী ও প্রিয়ভাষী সাংবাদিক মীজানুর রহমান


আতাউর রহমান

মহামারী করোনাকালে সাংবাদিকতার দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছরে কত পেশাগত স্মৃতি রয়েছে দেশে বিদেশে। একজন সৎ ও নির্লোভী প্রিয়ভাষী সাংবাদিক মীজানুর রহমান। যার মাধ্যমে আমি জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রথম প্রবেশ করেছিলাম। আর সেই সাংবাদিক মীজানুর রহমানের মৃত্যুর  বছর দেখতে  দেখতে আঠারো বছর পার হয়ে গেল। সৎ ও নির্লোভী প্রিয়ভাষী সাংবাদিক মীজানুর রহমান ছাত্র জীবন থেকেই দেশ ও জাতি গঠনে যেসব সাংবাদিকরা অবদান রেখে গেছেন তাদেরই একজন প্রিয়ভাষী সাংবাদিক মীজানুর রহমান।

আজ ১৯ জুলাই তাঁর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। জাতীয় প্রেসক্লাবের আঙিনায় প্রবেশ করলেই যাঁর অবয়ব ফোটে উঠে তিনি সাংবাদিকদের এক প্রিয় নাম মীজানুর রহমান। কত স্মৃতি আজ মনে পড়ে তাঁকে নিয়ে। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে  গাজীপুর প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠাকালে একটি অনুষ্ঠানে আমার প্রথম পরিচয় হয় মরহুম মিজানুর রহমান সাহেবের সাথে।

এরপর ১৯৮৪ সালের মে মাসের প্রথম দিকে আমাকে তিনি প্রথম জাতীয় প্রেসক্লাবে নিয়ে যান আরেকজন মহীরুহ সাংবাদিক আলহাজ শামস উল হুদার কাছে। তিনিও আজ বেঁচে নেই। তাকেও আজ স্বরণ করি গভীর শ্রদ্ধাভরে। আজ থেকে আঠারো বছর আগে তিনি যেদিন ইন্তেকাল করেন ২০০৩ সালে।  সেদিন আমি দেশের বাইরে থাকায় আজো আমাকে তাড়া করে শোকাবহ বেদনায় এক অনুশোচনায়। বারে বারে মনে পড়ে বারডেম হাসপাতালের সামান্য স্মৃতির কথা ।

তিনি বলেছিলেন “তোমরা আমার  লাশটি বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফনের ব্যবস্থা করিও। তিনি কয়েকজন সাংবাদিক নেতাকেও বিষয়টি অবহিত করেছিলেন।  সেদিন আমি  দেশে থাকলে হয়তোবা এ বিষয়টিকে সকলকে অবহিত করতে পারতাম এবং হয়তো সফল হতাম। কারণ দেশের খ্যাতিমানসব বড় বড় রাজনীতিক , মন্ত্রী, এমপি ও সাংবাদিকের সাথে সাংবাদিক মীজানুর রহমানের ছিল গভীর সুসম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা।

২০০৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বর্তমান বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ অনেকে শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিলেও তার দাফনের আশাটি পূরণ হয়নি। অবশেষে টঙ্গীর গাজীপুরা গ্রামের পারিবারিক গোরস্থানেই তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।

প্রেসক্লাবের আঙিনায় কখনও চায়ের টেবিলে, কখনও লাইব্রেরীতে আবার কখনও আলোচনার গোলটেবিলে বসে যিনি দেশের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে নজর কাড়তেন সকলের। তিনি হলেন সাংবাদিক মহলের প্রিয় মুখ মীজানুর রহমান।

তাঁর সততা, নিষ্ঠা ও  পেশাগত কাজের প্রতি আন্তরিকতায় তিনি ছিলেন অকৃত্রিম। মহান ভাষা আন্দোলন  থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন সংকটকালে তিনি তাঁর অবস্থানে  থেকে  রাজনীতিবিদদের সাথে সেতু হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন গুরুত্ব¡পূর্ণ ভূমিকায়। পেশাগত জীবনে শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ,মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশসহ অধিকাংশ রাজনীতিবিদদের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ও সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয়েছে বলে তিনি আমাদের অনেক স্মৃতি কথা শোনাতেন।

প্রিয়ভাষী এই সাংবাদিকের সাথে  দেশের সব বড় বড় রাজনীতিকের  যেমন  যোগাযোগ ছিল  তেমনি ছিলো এলাকার তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের সাথে।

আমি  দেখিছি আমাদের ভাই শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার ও সাবেক সংসদ সদস্য কাজী মোজাম্মেল হক, বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হকসহ অনেকের সাথে কিভাবে এলাকার উন্নয়নে তিনি পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে।

২০০৩ সালের ১৯ জুলাই শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার যখন এমপি তখন মীজানুর রহমানের মৃত্যুর খবর পেয়ে ঢাকায় গিয়ে তাঁর লাশ দাফনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, মীজানুর রহমানের মৃত্যুর এক বছর না যেতেই আহসান উল্লাহ মাস্টার এমপি শহীদ হন ঘাতকের গুলিতে ২০০৪ সালের ৭ মে।

আজকের এই দিনে আমি শ্রদ্ধা জানাই এই দুইজন ব্যক্তিকে। তোমাদের নীতি ও আদর্শ হোক আমাদের পাথেয়।  সাংবাদিক মীজানুর রহমানের কর্মজীবন শুরু দৈনিক ইত্তেফাক থেকে। পরে তিনি বাংলাদেশ প্রেস ইন্টারন্যাশনাল (বিপিআই) ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস)-এ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

বাসসের বাণিজ্যিক সম্পাদক হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সাংবাদিক ফোরামের স্বার্থ রক্ষায় তিনি ছিলেন সব সময় সক্রিয়। এক সময়ে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের চিফ রিপোর্টার ছিলেন। ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে তিনি বেশ খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেছিলেন।

তিনি বিভিন্ন সময়ে ক্রীড়া লেখক সমিতির বিভিন্ন পদে থেকে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মোহামেডান ও ঢাকা ওয়ানডারার্স ক্লাব ও ঢাকা জেলা ক্রীড়া সমিতির সদস্য হিসেবে দেশের খেলাধুলার মান উন্নয়নে বেশ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে গেছেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সাথে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করে গেছেন।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন আপাদমস্তক সৎ সাংবাদিক। কোন লোভ, লালসা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। গাজীপুর জেলার টঙ্গীর এলাকায় গাজীপুরায় মরহুম মীজানুর রহমানের গ্রামের বাড়ী। বর্তমানে তিনি এই বাড়ির পাশে পারিবারিক কবরস্থানে চিরনিন্দ্রায় শায়িত আছেন। যতদূর  দেখেছি মানুষের উপকার করতে তিনি ছিলেন দ্বিধাহীন। 

লোকের উপকার করতে না পারলে তিনি আফসোস করতেন। প্রেসক্লাবে ক্যান্টিনে বসে তিনি প্রায় সময়ই সহকর্মী সাংবাদিকদের আপ্যায়ন করতেন আন্তরিকতার সাথে। বাসস অফিসে তিনি বিস্কুট কলা রুটি ও চা দিয়ে আপ্যায়ন করতেন সবাইকে। অফিসে তিনি টিনের বক্সে বিস্কুট রাখতেন সবার জন্য। তিনি ছিলেন উদার মনের একজন বিনয়ী মানুষ। সংগঠক হিসেবে ছিলেন তিনি খুবই বুদ্ধিদীপ্ত।

ছাত্র জীবন থেকেই তিনি সংগঠক হিসেবে বেশ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি টঙ্গী পৌরসভা প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করলে টঙ্গী পৌরসভা ঘোষণা করান যা বর্তমানে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন। বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি, বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন।

তিনি ছিলেন ধর্মানুরাগী। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন, মানুষের সাথে সময় দিয়ে কথা বলতেন, যথাসময়ে উপস্থিত থাকতেন কাজেকর্মে। সাংবাদিক মহলে তিনি সুপরিচিত এবং প্রিয় ব্যক্তিত্ব। বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকতায় আগ্রহীদের চাকুরি প্রদানে উৎসাহিত করতেন। আমাকে তিনি ব্যাংকের চাকুরি বাদ দেয়ার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করে সার্বক্ষণিক সাংবাদিকতা পেশায় দৈনিক জনতায় চাকুরি দিয়েছিলেন। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় এবং দেশ ও জাতি গঠনে মহান ভাষা আন্দোলনে সাংবাদিক সমাজের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন যুগে যুগে।

তিনি ছাত্র জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেছের ছাত্র ছিলেন। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের তিনি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে তিনি ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের কমিটিতে ছিলেন। আজকের এইদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা এবং মাগফিরাত কামনা তাঁর বিদেহী আত্মার।

লেখক: বাসস-এ কর্মরত ও সাধারণ সম্পাদক, মীজানুর রহমান স্মৃতি পরিষদ  

এস এস