ন্যাভিগেশন মেনু

১৩ বছর বালকের বিষ্ময়কর প্রযুক্তি উদ্ভাবন


নিজস্ব প্রতিবেদন: এবার এক ১৩ বছরের খুদে বাংলাদেশি বালকের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কথা। এটা  রূপকথা বা স্বপ্নপুরীর দেশের কোনো রাজকুমারের গল্প নয়। এই খুদে একক প্রচেষ্টায় গেম বানিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশের এই খুদে কম্পিউটার প্রোগ্রামারের নাম ওয়াসিক ফারহান রূপকথা। নামের সঙ্গে কর্মের মিল শকভাগ।

‘স্পেস কলাইডার’ নামের এই গেমটি কম্পিউটারের (পিসি) পাশাপাশি খেলা যাচ্ছে মোবাইল ফোনেও। আর এর মাধ্যমে প্রযুক্তি দুনিয়ার বিস্ময় বালক রূপকথার সফলতায় যুক্ত হলো আরো একটি পালক।

বছর ১৩ বছর বয়সী বাংলাদেশি কিশোর ওয়াসিক ফারহান রূপকথার তৈরি গেমটি এরই মধ্যে গুগল প্লে-স্টোর থেকে বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে ডাউনলোড হচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এমনকি আফ্রিকা থেকেও। ভারত, সৌদি আরব, কুয়েত, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রশংসিত হচ্ছে গেমটি।

রূপকথা স্টুডিও থেকে প্লে-স্টোরে ছাড়া গেমটি ডাউনলোড সংখ্যা সপ্তাহের ব্যবধানে ছাড়িয়ে গেছে দেড় হাজারেরও বেশি। ৪ দশমিক ৮ রেটিং নিয়ে সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হওয়া স্পেস শুটার গেমের তালিকার শীর্ষে জায়গা করে নিয়েছে গেমটি। একই সঙ্গে দিন দিন জনপ্রিয়তার তালিকায় শামিল হচ্ছে গেমটির পিসি সংস্করণ।

গ্রহ-উপগ্রহ থেকে ছুটে আসা উল্কা আর ভিনগ্রহের প্রাণি থেকে পৃথিবীকে সুরক্ষিত রাখার চ্যালেঞ্জ নিয়েই ইউনিটি প্ল্যাটফর্মে সি শার্পে গেমটি তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে মেধাবী রূপকথা। বয়সে কাঁচা হলেও চিন্তায় দুরন্ত এই কিশোরের ভাবনায় সব সময় ঘুরপাক খায় আগামীর পৃথিবীকে মহাকাশের অনভিপ্রেত আক্রমণ থেকে রক্ষার।

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কটূক্তি রূপকথার মনে রেখাপাত করেছে। সে জানায়, ভবিষ্যতে সাইবার হামলা থেকে বাংলাদেশকে সুরক্ষিত রাখা না গেলে অনেক ভালো কিছুই আর ভালো থাকতে পারবে না।

রূপকথা আরো জানায় তার তৈরি গেমের পেছনের উদ্দেশ্যের কথা। রূপকথা চায়, নতুন প্রজন্মের গেমাররা মানুষ হত্যার মতো নৃশংস গেম না খেলে পৃথিবীকে ভালোবাসুক। যুদ্ধ করুক পৃথিবীকে বাঁচাতে।

মৃদুভাষী ও লাজুক স্বভাবের এই কিশোরের ভাবনার প্রায় পুরোটা অংশজুড়েই কম্পিউটার থাকলেও প্রকৃতিপ্রেম তার মধ্যে প্রবল। বৃষ্টি শুরু হলে জানালার ফাঁক গলে হাত ভেজানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না রূপকথা। অবসরে পিএস ফোর-এ গেম খেলে।

অবশ্য স্পেস কলাইডার গেম তৈরি করেই কিন্তু থেমে নেই রূপকথা। একক পরিকল্পনা ও চেষ্টায় এখন সে কাজ করছে নতুন আরেকটি গেম ‘ডিফেন্ড দি আর্থ’। গেমের কাজ প্রায় শেষ। চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই করে দু-একদিনের মধ্যেই তা অবমুক্ত করবে গুগল প্লে-স্টোরে।

রূপকথার মা সিনথিয়া ফারহিন রিশা বলেন, ‘সাত মাস বয়স থেকেই কম্পিউটারের প্রতি রূপকথার ঝোঁক। ওই বয়স থেকেই রূপকথাকে কম্পিউটার ছাড়া খাওয়ানো যেত না। অল্পদিনের মধ্যেই দেখা গেল রূপকথা কি-বোর্ড ব্যবহার করতে চেষ্টা করছে।

এর পর থেকে ওর ধ্যান-জ্ঞান এই কম্পিউটার নিয়েই। শৈশবেই চিটকোড ব্যবহার করে খেলত। কঠিন কঠিন গেম শেষ করত একটানে। অল্পদিনেই কম্পিউটার ওর কাছে খেলনায় পরিণত হয়।’

রূপকথার মা আরো জানান, বয়স এক বছর হওয়ার আগেই কম্পিউটার নিয়েই রূপকথা তার নিজস্ব জগৎ তৈরি করে ফেলে। সিনথিয়া ফারহিন রিশা বলেন, ‘কারো কাছ থেকে এ, বি, সি, ডি শেখেনি রূপকথা। রিড ইট, উইকিপিডিয়া, উইকি হাউসহ বেশ কিছু ওয়েবে সে নিয়মিত পড়াশোনা করে। এখনো যা করছে নিজের প্রচেষ্টায়।’

২০১৪ সাল থেকে এ বছরের প্রথম দিক পর্যন্ত প্রোগ্রামারদের গেমিং প্ল্যাটফর্ম রোবলক্সে কয়েক ডজন গেম বানায় রূপকথা। লুআ ল্যাঙ্গুয়েজে সে এ গেমগুলো তৈরি করলেও তা সবাই খেলতে পারত না। এরপর রূপকথা চলতি বছরের ঈদুল ফিতরের আগে থেকে ইউনিটিতে গেম তৈরির কাজ শুরু করে।

অবশ্য এর আগে ছয় বছর বয়স হওয়ার আগেই বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ প্রোগ্রামারের খেতাব পায় রূপকথা। যাচাই-বাছাই করে তাকে ২০১২ সালে এই খেতাব দিয়েছিল রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট। তাকে স্বীকৃতি দেয় গোল্ডেন বুক অব রেকর্ডস। এরই মধ্যে যেকোনো প্রোগ্রামিং ভাষা কিংবা ট্রাবলশুটিংয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠে রূপকথা। এ সবকিছুই সে শিখছে নিজের মতো করে।

তাই বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে রূপকথা শৈশবেই। তার এই গৌরবগাঁথা স্থান পেয়েছে দেশের জাতীয় পাঠ্যপুস্তকেও। নিজেকে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নিতে না হলেও ২০১৩ সাল থেকেই ইংলিশ ফর টুডে পাঠ্যপুস্তকে অষ্টম শ্রেণির সব শিক্ষার্থীই রূপকথাকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধ পড়ছে।

সব মিলিয়ে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে রূপকথার অর্জন। কারণ, চার বছর বয়সেই ইম্যুলেটর ব্যবহার করে গেমের ক্যারেক্টার পরিবর্তন করেছে রূপকথা। ছয় বছরে ক্যাম স্টুডিও এবং হাইপারক্যামে কাজ করার পাশাপাশি অ্যানিমেশন তৈরি করত রূপকথা। এর পরের বছরেই সে সি++ এ দক্ষ হয়ে ওঠে।

তখন ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সি তাকে বিশ্বের সবচেয়ে কমবয়সী কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।এরপর ২০১৩ সালে একটি সম্পূর্ণ অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করে রূপকথা। এরই ফাঁকে পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যেই ১০০০টির বেশি গেম খেলে ফেলে। খেলার পাশাপাশি উইকিপিডিয়া সম্পাদনা এবং তৈরিতে তার দক্ষতা দেখায়। মহাজাগতিক বিষয়ে লাভ করে বিস্তর জ্ঞান।

সাম্প্রতিক সময়ে খেলার প্রতি তার ঝোঁক আর আগের মতো নেই। অন্যের তৈরি গেম খেলায় মত্ত থাকে না, গেম বানানোর কাজ নিয়েই দিনের বেশিটা সময় ব্যয় করে। উদ্ভাবন আর গবেষণায় ডুব দিয়েছে রূপকথা। তার ভাবনাজুড়ে কেবলই পৃথিবী আর মহাকাশ। মানবকল্যাণে কীভাবে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে সময় কাটছে।

রূপকথার সঙ্গে কথা বলে ও তার কাজ দেখে বোঝা যায়, কম্পিউটারে কোডিং করা কিংবা কোনো কিছু লেখার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের মতো বুদ্ধি ও দক্ষতা রয়েছে। কোনো বিশেষ চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই সে কোডিং লিখছে। আবার নিজের তৈরি গেমের জন্য চমৎকার একটি ট্যাগ লাইনও লিখে ফেলছে— ‘ডিফেন্ড দি আর্থ ইফ ইউ আর ব্রেভ এনাফ, ম্যানকাইন্ডস’ ফেট ইজ ইন ইউর হ্যান্ড’।

রূপকথা জানাল, প্রকাশের অপেক্ষায় থাকা তার দ্বিতীয় গেমটি (দি আর্থ ডিফেন্ডার) হবে সিরিজ গেম। প্রথম সিরিজে থাকবে স্পেস ডিফেন্ড (মহাকাশ সুরক্ষা) এবং দ্বিতীয়টি মার্সকে (মঙ্গলগ্রহ) নিয়ে। এই গেমে দেখা যাবে, নাসা মঙ্গলগ্রহে মানুষ পাঠিয়ে হোস্টাইল এলিয়েনদের (ভিনগ্রহের বিপজ্জনক প্রাণী) আক্রমণ প্রতিহত করবে। এ জন্য নাসা ভবিষ্যতে টাইম মেশিনে ভ্রমণ করার পথ খুঁজছে। একই সঙ্গে মানবদেহ ক্লোনিং করার বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করছে।

এস এস