ন্যাভিগেশন মেনু

চুয়াডাঙ্গায় বিলুপ্তির পথে তাঁতশিল্প, পেশা ছাড়ছেন তাঁতিরা


সালাউদ্দীন কাজল:

প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও পুঁজির অভাব, সুষ্ঠু নীতিমালার অভাব, দফায় দফায় সুতা ও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানান প্রতিকুলতার কারণে চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা পৌরএলাকার এরশাদপুর গ্রামের এককালের প্রসিদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী হস্তচালিত তাঁতশিল্প বিলুপ্ত হতে চলেছে।

এ শিল্পের সাথে জড়িত অধিকাংশ তাঁতিসহ শ্রমিকরা বেকার হয়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন। এদের মধ্যে কেউ রিকশাভ্যান চালক, কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ রাজমিস্ত্রির সহকারী আবার কেউ মুদি দোকানে কাজ করছেন।

এখন এরশাদপুর গ্রামের হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ তাঁতের কাজ করেন। হাতেগোনা কয়েকজন যারা এ শিল্পকে আঁকড়ে ধরে আছেন তাদের বাপ-দাদার তিনপুরুষের পুরনো পেশা হিসেবে আর কতোদিন লোকসান গুনবে এই দুশ্চিন্তায় প্রহর গুনছেন তারা। 

আগে ওই এলাকার প্রতিটি ঘরে ঘরে তাঁত থাকলেও বর্তমানে মাত্র ৪০-৫০টি পরিবারে তাঁত রয়েছে। বস্ত্র তৈরির ইলেকট্রিক আধুনিক যন্ত্রপাতি, ফ্যাশানে ভিন্নতা, পোশাকে আধুনিকতার ছোঁয়া হাতে তৈরি তাঁতশিল্পকে হার মানিয়েছে। 

হস্তচালিত এই সকল তাঁতে এখন শুধুমাত্র গামছা তৈরি হয়। মুনাফা কমে যাওয়ায় তরুণ প্রজন্মের কেউ তাঁত পেশায় আর আসতে চায় না। অভিভাবকরাও চান না অনিশ্চিত ভবিষ্যতের এই কাজে জড়িয়ে পড়ুক তাদের ছেলেমেয়েরা।

তাঁতিরা বলছেন, এখন থেকে পঁচিশ বছর আগেও এরশাদপুর গ্রামে তাঁতশিল্প ছিল জমজমাট। ভোরে তাঁতশ্রমিকদের কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠতো তাঁতঘরগুলো। কিন্তু বর্তমানে সুতার দাম বেশি ও ইলেকট্রিক তাঁত না থাকায় তাদের বাপ-দাদার পৈত্রিক ব্যবসা গুটাতে হচ্ছে। কালের বিবর্তনে আধুনিক যন্ত্রপাতির সাথে পাল্লা দিয়ে টিকতে না পেরে আজ তারা বিলুপ্তির পথে।

স্বাধীনতার পূর্বে এরশাদপুর গ্রামের পাঁচ শতাধিক পরিবার তাঁতশিল্পের উপর নির্ভরশীল ছিল। এখানে প্রায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৫ হাজার শ্রমিক কর্মরত ছিল। কাঁকডাকা ভোরে মাকুর খটখট শব্দে ঘুম ভাঙতো সকলের। তাঁতশ্রমিকের কলরবে এরশাদপুর গ্রাম থাকতো সরগরম। এখন আর তেমন মাকুরের খটখট শব্দ নেই। মাকুর শব্দে আর ঘুম ভাঙে না। সেই তাঁতঘরগুলোর অধিকাংশই এখন আর নেই। হাতেগোনা যে কয়টি তাঁতঘর আছে সেগুলোতেও এখন বিরাজ করে সুনসান নিরবতা। 

আগে এখানকার তৈরি লুঙ্গি, গামছা ও তোয়ালের সুনাম ছিল দেশজুড়ে। আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনের পাশে ছিল তাঁতের তৈরি কাপড়ের বড় মোকাম। এছাড়া কুষ্টিয়ার পোড়াদহ ও পাবনার শাহজাদপুর হাটও এরশাদপুরের তাঁতের লুঙ্গি-গামছার দখলে ছিল। বর্তমানে এরশাদপুরের সেই অবস্থা আর নেই। এখন কেউ কেউ শুধু গামছা তৈরি করে বাপ-দাদার পেশাটি কোনো রকম টিকিয়ে রেখেছেন।

তাঁতিরা আরও জানান, কাচামাল, রং, কেমিক্যালের মূল্য ও সুতার মূল্য বৃদ্ধির কারণে তাঁতের তৈরি কাপড়ের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় তাঁতের তৈরি কাপড়ের মূল্য বাড়েনি। অপরদিকে মেশিনের তৈরি নানাবিধ পণ্যসামগ্রী বাজারে আসায় দেশে তৈরি কাপড়ের চাহিদা একেবারেই কমে গেছে। মূল্যও অনেক কমেছে। এ কারণে অনেকেই তাঁতের মেশিন কম দামে বিক্রি করে দিয়েছেন। অনেকেই ফেলে রেখেছেন। বাড়িতে ঘূণ ধরা কাঠের তাঁতগুলো এখন পড়ে আছে। তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগর ও তাঁতের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুসকিল হয়ে উঠেছে। 

তাঁতিদের দাবি, এখন তাদের এ ঐতিহ্য এবং শিল্পকে রক্ষা করতে হলে সরকারের সুদৃষ্টি প্রয়োজন। 

সরেজমিনে এরশাদপুর গ্রামে তাঁতিপাড়ায় গেলে চোখে পড়ে মাকড়শার জাল আটকে রয়েছে ভাঙ্গাচোড়া তাঁতগুলোর সাথে। দেখেই বোঝা যায় অনেকদিন কোনও শ্রমিক বসেনি তাঁতে। আগের মতো আর কর্মব্যস্ততা নেই তাঁতপল্লীতে। বর্তমানে সেখানে এখন নিঃশব্দের আবাদ। মাঝে মাঝে কয়েকটি তাঁতকল চললেও আগের মতো আর তাদের তাঁতে সুর ওঠেনা। আগের মতো তাঁতের খটর-খটর শব্দ এখন আর শোনা যায় না।

হঠাৎ এক বাড়িতে শোনা যায় তাঁতের শব্দ। বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখা যায় শান্তনা খাতুন নামে এক মাঝবয়সী নারী তাঁতে গামছা তৈরি করছেন। তিনি জানান, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সংসার তার। স্বামীহারা এই মাঝবয়সী নারী সংসারের কাজের ফাঁকে কিছু টাকা আয়ের জন্য সারাবছর তাঁতে গামছা বুনেন।

পাশের বাড়ির রহমত উল্লাহও নির্ভরশীল ছিলেন এ পেশায়। তবে এখন নেই। কেন ছেড়ে দিয়েছেন এ পেশা - এমন প্রশ্নে রহমত উল্লাহ বলেন, 'এ পেশায় এখন আর তাঁতিদের পেঠে ভাত যায় না। শ্রমিক দুই গজ গামছা বুনলে মজুরি পাবেন ৩০ টাকা। এ মূল্যে সারাদিন কাজ করলে শ্রমিকের মূল্য হয় এক থেকে দেড়শ টাকা। তা দিয়ে বর্তমানে কোনও পরিবারের সংসার চলতে পারে না। যে কারণে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে পেটের দায়ে ভিন্ন পেশায় চলে গেছি।'

এ পাড়ার অপর তাঁতি তসলিমা খাতুন (৪০) জানান, 'এ কাজে লাভ না হওয়ায় এবং করোনাকালীন স্বামী আব্দুল মান্নান রাজমিস্ত্রির সহকারীর কাজ বেছে নিয়েছে। আমি মাঝে মাঝে কাজের ফাঁকে ফাঁকে দিনে ৪টি গামছা তৈরি করি। এতে আমার সারাদিনে লাভ হয় মাত্র ৬০ টাকা। আমিও এ কাজ ছেড়ে দেবো।'

গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধ তাঁতি আবু তাহের বলেন, 'কৃষি ব্যাংক থেকে ৭০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তিনটি তাঁত চালাতাম। বর্তমানে ঋণ সুদে-মুলে দেড় লক্ষ টাকা দাঁড়িয়েছে। লাভ না হওয়ায় তাঁত বন্ধ করে দিয়েছি। এখন ঋণ পরিশোধ নিয়ে মহা দুঃশ্চিন্তায় আছি।'

তিনি বলেন, 'তাঁতশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে এ মহুর্তে প্রয়োজন এ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের আধুনিক প্রশিক্ষণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং তাঁতিদেরকে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে সরকার আন্তরিক হলে তাঁতিরা তাদের অতীত পেশা নিয়ে টিকে থাকতে পারবেন।'

তাঁতি আতিয়ার রহমান জানান, তিনি ৫০ বছর ধরে তাঁতের কাজ করছেন। বর্তমানে তাঁতের তৈরি গামছা বিক্রি করে লাভ না হওয়ায় তার তিন ছেলে এবং এক মেয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন।

তার দাবি, তাঁতিদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করে এবং রঙ ও সুতার দাম কমালে শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী এই তাঁতশিল্পের হারানো গৌরবকে উদ্ধার সম্ভব হবে।

তাঁতি পপি খাতুন বলেন, '৩০ বছর আগে আমার আটটি তাঁত ছিল। আমরা গামছা ও লুঙ্গি বুনতাম। ওই সময় প্রতিদিন ৮০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা লাভ হতো। বর্তমানে সুতার মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এখন দিনে ১০০ টাকাও লাভ হয়না। এ কারেণ বর্তমানে শুধু একটা তাত চালু রেখেছি।'

তার দাবি, মেশিনের তৈরি নানাবিধ পণ্যসামগ্রী বাজারে আসায় দেশিয় তৈরি কাপড়ের চাহিদা একেবারেই কমে গেছে। গ্রামীণ জনপদের উৎপাদনশীল এ তাঁতশিল্পকে ধরে রাখতে সুষ্ঠুনীতিমালা প্রয়োজন।

তাঁতি জহুরা খাতুন বলেন, 'আমাদের হস্তচালিত তাঁত কুটিরশিল্পের কারণে বিলুপ্তির পথে। এখন ইলেকট্রিক পয়েন্টের তাঁতশিল্পের যুগ। সরকার প্রণোদনা বা ঋণ দিয়ে আমাদের ইলেকট্রিক পয়েন্টে তাঁতের ব্যবস্থা করে দিলে এ শিল্প আবার ঐতিহ্য ফিরে পাবে।' 

এখানকার বাসিন্দাদের দাবি, কয়েক বছর ধরে তাঁতপণ্যের বাজার পড়তির দিকে ছিল। কিন্তু বর্তমানে করোনা সব তছনছ করে দিয়েছে।

তাঁতিদের মহাজন মহিউদ্দিন বাগু বলেন, 'বৃটিশ আমল থেকে এসব এলাকায় তাঁতশিল্পের বিস্তৃতি লাভ করে। বর্তমানে সর্বাধুনিক বস্ত্রশিল্পের বাজারে আমাদের তাঁতের তৈরি বাজারগুলো মার খাচ্ছে। কেননা, এই এলাকার তাঁতিরা হাতের সাহায্যে পণ্য তৈরি করেন। আধুনিক বস্ত্র শিল্পের বাজারে আমাদের তাঁতের তৈরি কাপড়গুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। আধুনিক মেশিন কিনতে সরকার সুদবিহীন ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করলে তাঁতিদের পেশা বদল করতে হবে না। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলেই তাঁতিরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।'

তিনি আরও বলেন, 'সাড়ে ১০ ভরি ওজনের এক বান্ডিল সুতা ১০ বছর আগে বিক্রি হতো ৪০০ টাকা দরে। বর্তমানে তা বিত্রি হচ্ছে দেড় হাজার টাকায়।'

ওই গ্রামের শিক্ষক ও সাহিত্যিক রহমার মুকুল বলেন, এরশাদপুর গ্রাম জুড়েই ছিল তাঁতি ও তাঁতশিল্প। তাঁতের ছন্দে দোলায়িত হতো ওই গ্রামের মানুষ। কাপড় বুননের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, প্রশিক্ষণের অভাব ও আধুনিক প্রযুক্তির কাছে মার খাচ্ছেন এ পেশার লোকজন। বর্তমান নানা প্রতিকুলতায় এসব তাঁত শিল্প বিলুপ্তির পথে।

আলমডাঙ্গা কেন্দ্রীয় তন্তু সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু মুসা বলেন, 'দেশ স্বাধীনের পর প্রায় ৩৫ বার সুতার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। রঙ, সুতাসহ অন্যান্য কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় গামছার উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। লাভ না হওয়ায় ধীর ধীরে সব তাঁতশিল্প বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ শিল্পকে এখন বাঁচাতে হলে চাই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। এছাড়া অন্য সব পেশার মানুষ করোনাকালীন বিভিন্ন প্রণোদনা ও সহযোগিতা পেলেও এখানকার তাঁতিরা তা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। তারা খেয়ে না খেয়ে সময় পার করলেও কেউ খোঁজ নেননি।'

আলমডাঙ্গা সরকারি ডিগ্রি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আমিরুল ইসলাম জানান, এরশাদপুরের তাঁতশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে এ মুহূর্তে প্রয়োজন এ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের আধুনিক প্রশিক্ষণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং তাঁতিদেরকে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে সহযোগিতা করা। এক্ষেত্রে সরকার আন্তরিক হলে তাঁতিরা অতীত পেশা নিয়ে টিকে থাকতে পারবেন। এ শিল্পে ব্যবহার্য প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম কমালে ও তাঁতবস্ত্র বিক্রির সমাধানে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তাঁতিরা ফিরে পাবে তাদের হারানো ঐতিহ্য। এ শিল্পকে এখন বাঁচাতে হলে চাই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।'

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মো. নজরুল ইসলাম সরকার জানান, তাঁতিদের সমস্যা সমাধানের জন্য আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সরেজমিনে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার জন্য বলা হয়েছে। 

এসকে/এডিবি/