ন্যাভিগেশন মেনু

কন্যাশিশুর অধিকার শুরু হোক পরিবার থেকেই


লিপি মেরী রড্রিকস্

গত ২২ সেপ্টেম্বর যখন সাবিনা, কৃষ্ণা আর সামসুরনাহারের জন্য টেলিভিশনের পর্দায় তাকিয়ে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম, কিছুক্ষণ পর পর নিজের অজান্তেই চোখের পাতা ভিজে উঠছিলো।এ আবার কেমন তর আদিখ্যাতা। কই আর কাউকেতো শুনলাম না এমন টিভি সেটের সামনে বসে বেকুবের মতো আবেগ সামলাতে! তবে ঘড়ির কাটা দুপুরের গণ্ডি পেরুতে না পেরুতেই দেখি আমাদের এক বড় ভাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন- "টেলিভিশনের পর্দায় তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না। চোখে জল চলে আসছে" যাক, হাফ ছেড়ে বাঁচলাম, আমার মতো অনেকের চোখেই সেদিন বিশেষ কোন রোগ ভর করেছিলো, তাও একযোগে! 

সপ্তাহ ধরে চারিদিকে শুধু মেয়েদের জয়জয়কার। সেদিন ঢাকা চাকা বাসেও শুনলাম চালক এবং তার সহযোগী আলাপ করছিলেন। যা খেলা দেখাইলো ঐ মাইয়াগুলা। আমাগো বেটা পেলেয়ারাও কখনও এমন খেলা খেলে নাই। সামনে লুকিং গ্লাসে উনার চেহারায় বিজয়ী উচ্ছাস দেখে আরও একবার খুব গর্বে ফুলে উঠলো কন্যা হয়ে জন্মানোর গর্বে। যদিও পরক্ষণেই মেয়েদের হাফ প্যান্ট পরে ভিনদেশের মাটিয়ে দৌড়াদৌড়ি বিষয়টি তাদের আলোচনার ও আপত্তির প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে উঠে। 

জাতি যখন আজ ঘটা করে কন্যা শিশু দিবস উৎযাপনে মূখরিত, তখন এমন বিজয় নিঃসন্দেহে আমাদের আনন্দকে দ্বিগুণ করে তোলে। পাশাপাশি কন্যাদের সূবর্ণ ভবিষ্যৎ কল্পনায় নিরন্তন আশা সঞ্চার করে।এমন টুকরো টুকরো ইতিহাস রচয়িতাদের দেখে নিজের গর্ভজাত কন্যা সন্তানকে ঘিরে শত আংশকার বদলে স্বপ্নাতুর হয়ে উঠে মাতৃ হৃদয়। এ বিজয় আমাদের স্বপ্ন দেখায়, হয়ত এভাবেই আমাদের আরো কন্যারা ঘরে বাইরে, মাঠে ঘাটে সবত্রই মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।নিজের অপূর্ণ সব সাধগুলো নিশ্চয়ই আমার মেয়েটা পূরণ করবে একদিন! 

পরক্ষণেই আবার ভাবি করোনা অতিমারি যেখানে শত সহস্র শিশুর স্কুলে ফেরা পথ চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে, সেখানে কন্যা শিশুদের নিয়ে স্বপ্ন দেখা কতটা যৌক্তিক! গেল মাসে একটা অনলাইন খবরের কাগজে দেখছিলাম, গত বছর দেশের অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন ইউংয়ের প্রকাশিত ঐ প্রতিবেদনে আরো উঠে আসে যে করোনা মহামারির মধ্যে শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে ৭৭ হাজারেরও অধিক শিশু। বাকি ৩ লক্ষ ৫৫ হাজার শিশু বিভিন্ন কারণে ঝরে পড়েছে বিদ্যালয় থেকে। ঝরে পড়ার এই হার ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। এর মধ্যে বাল্যবিবাহের কারণে ঝড়ে পড়ার হার ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ, ১৬ দশমিক ১৫ শতাংশ শিশুশ্রমে ও অন্যান্য কারণে ৭৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ।

সেদিন অফিসের প্রয়োজনে দুজন মেয়ে শিশুর খোঁজ করছিলাম। দুজনই মিরপুরের একটি কলোনীর বাসিন্দা। আমি যে সংস্থায় কাজ করি সেই সংস্থা শিশুদের উন্নয়নে সেখানে কাজ করছে দীর্ঘ দিন। এদের একজনকে খুঁজে পাওয়া গেল, আরেকজনকে পাওয়া গেল না। বেশ কাঠ খড় পুড়িয়ে জানা গেল, মেয়েকে বিয়ে দেবে বলে এলাকার ছেড়ে চলে গেছে পুরো পরিবার। বিয়েও হয়ে গেছে এর মধ্যে সদ্য ১২তে পা রাখা সেই শিশুটির। শুধু হতদরিদ্র শ্রেণীর মধ্যেই নয়, নিম্ন-মধ্যবিত্ত,মধ্যবিত্তদের মধ্যেও বাল্যবিয়ের উদাহারণ দেখানো যাবে ভূরি ভূরি। 

এই বাল্যবিয়ের জাল ছিড়ে কোন ভাবেই আমাদের সন্তানরা বিশেষ করে মেয়ে শিশুরা বের হতে পারছেনা। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে বাল্যবিবাহমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন তাও আজ প্রায় ৮ বছর হয়ে গেল। সেদিন একটি পত্রিকায় পড়ছিলাম, বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণে জানা গেছে যে, জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাল্যবিয়ে বন্ধের বর্তমান প্রচেষ্টাকে অন্তত আটগুণ বাড়াতে হবে। আর জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে এই প্রচেষ্টা বৃদ্ধি করতে হবে ১৭ গুণ। 

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের শুধুমাত্র সরকারের একার পক্ষে যে সম্ভব নয় তা আমরা সকলেই জানি। পরিবারের সচেতনতা এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরী। বাবা-মা কন্যাকে বোঝা ভেবে বয়ে বেড়ানোর মানসিকতা ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে হবে। মেয়েকেও দিতে হবে ছেলে সন্তানের মতোই ন্যায্য অধিকার। পরিবার যখন মেয়েকে শুধুমাত্র মেয়ে নয়, সন্তান ভাবতে পারবে, এবং সেই মতো মেয়ে শিশুর যত্ন নিতে পারবে, তখনই কেবল একটি কন্যার সমাজে এবং ক্রমে রাষ্ট্রে স্বীকৃতি পাবার পথ সুগম হবে! এছাড়াও আমাদের মেয়ে শিশুদের নিরাপদে পথ চলার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। যার জন্য প্রয়োজন, আইন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারকরণ, আইন কানুনের সুষ্ঠ প্রয়োগ এবং ব্যাপক প্রচার প্রচারণা। সাবিনা, কৃষ্ণারা ছড়িয়ে পড়ুক সমগ্র দেশের আনাচে কানাচে এই প্রত্যাশাই ব্যক্ত করি এই কন্যাশিশু দিবসে! 

-     লেখক লিপি মেরী রড্রিকস্ একজন উন্নয়ন কর্মী