ন্যাভিগেশন মেনু

আগামী জাতীয় নির্বাচন: গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখাই চ্যালেঞ্জ


সাম্প্রতিক ভারত সফর নিয়ে ১৪ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে প্রধানমন্ত্রী তার সফরের অর্জনের বিষয়গুলো তুলে ধরেন। করোনা-মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনৈতিক সংকট এবং বিশ্বে আসন্ন দুর্ভিক্ষের বিষয়ে দেশবাসীকে সতর্ক করে প্রস্তুতি নিতে বলেন সরকার প্রধান। 

পাশাপাশি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন শেখ হাসিনা। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে যথাসময়ে নির্বাচন হবে বলে জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী আশা করেন, আগামী নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে। তবে কেউ যদি নির্বাচনে না আসে সেটা তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। তাতে তার দল বা সরকারের কিছু করার নেই। বাংলাদেশের সরকার প্রধানের এ সব বক্তব্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দাবি রাখে। 

গত ৫-৮ সেপ্টেম্বর ভারতে শেখ হাসিনার সফর ও পরে এর ফলাফল নিয়ে গত কিছুদিন ধরে বিস্তর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উঠে আসছে সংবাদ মাধ্যমে। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর কিছু বক্তব্য বোদ্ধামহলের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।  

শেখ হাসিনা দাবি করেন, করোনা মহামারির তিন বছরের মাথায় তাঁর সফর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। ভারত থেকে তিনি খালি হাতে ফিরে আসেননি বলেও দাবি করেন। বলেন, প্রতিবেশি দেশ হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, যোগাযোগ সবক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছে। তাঁর এবারের সফরের অর্জন হিসেবে শেখ হাসিনা কুশিয়ারা নদীর পানি প্রত্যাহারে সমঝোতাস্মারক সই, ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে অন্য দেশে বিনা মাশুলে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির সুযোগ, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সড়ক, রেল ও নৌপথে যোগাযোগ স্থাপনে মতৈক্যের বিষয়গুলোকে তুলে ধরেন। 

প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনায়কসুলভ প্রজ্ঞার সঙ্গেই বলেছেন যে, ‘দরজা বন্ধ করে কোনো লাভ হয় না। খুলে দিলেই লাভ হতে পারে। এতে মানুষের ভালো হয়, কল্যাণ হয়, কর্মসংস্থান বাড়ে’।

ভারত সফরের প্রসঙ্গ ছাড়িয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী করোনা মাহামারি ও তারপরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গোটা বিশ্বজুড়ে গভীর অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়ে দেশবাসীকে সতর্ক করেছেন। শেখ হাসিনা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, সারাবিশ্বে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। 

শেখ হাসিনা দেশবাসীক সামনের কঠিন সময় মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিতে আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমি আগে থেকেই সবাইকে বলে আসছি- আমাদের মাটি আছে ফসল ফলাও, নিজের খাবার নিজে তৈরি করো। নিজেরটা আগে নিজে করে রাখি। যেন কারও মুখাপেক্ষী না হতে হয়’।

বিশ্বব্যাংকও তাদের সবশেষ প্রতিবেদনে ২০২৩ সালে বিশ্ব অর্থনীতি ফের মন্দায় পড়বে বলে সতর্ক করেছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশই অর্থনৈতিক সংকট সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক অবশ্য বলছে বাংলাদেশ এ অর্থনৈতিক সংকট এখন পর্যন্ত সামাল দিতে পেরেছে। সংস্থাটি বাজেট সহায়তাবাবদ বাংলাদেশকে ৫০ কোটি ডলার বরাদ্দেরও ঘোষণা দিয়েছে। 

তীব্র ডলার সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান আর দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের নাভিঃশ্বাস উঠলেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ধস নেমেছে- এমনটা বলা যায় না। সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে সামাল দিতে। 

এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনেতার মতোই কোনো রাখঢাক না করে দেশবাসীকে আসন্ন কঠিন সময়ের বিষয়ে সতর্ক করেছেন এবং প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। তাঁর এ সাহসী মনোভাব সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। 

ভারত সফর এবং অর্থনৈতিক সংকটের বাইরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি নিয়ে বলেছেন, তা হলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় সব দল নির্বাচনে আসবে আশা প্রকাশ করে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই বলেছেন কেউ না এলে সেটা তাদের দলের সিদ্ধান্ত। 

এখানটায় দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দল, সুধিসমাজ এমনকি আন্তর্জাতিক মহলেরেও উদ্বেগ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যে দিন সংবাদ সম্মেলন করেন ঠিক সেদিনই নির্বাচন কমিশন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করে। সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ১৪টি চ্যালেঞ্চের কথা বলেছে কমিশন। এ সব চ্যালেঞ্জের মধ্যে কমিশনের প্রতি আস্থাহীনতা, পুলিশ ও প্রশাসন নির্বাচনকালীন সময়ে কতটা নিরপেক্ষ থাকবে সে বিষয়ে সংশয়, ইভিএমে ভোট অন্যতম। 

এ সব গুরুতর বিষয়ের ফয়সালা না করলে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি না হলে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে আসতে আগ্রহী হবে না, কমিশনের প্রতি আস্থাশীল হবে না। এ ক্ষেত্রে সরকার এবং সরকার প্রধানেরও দায়িত্ব থাকে। 

গত কিছু দিন ধরে বিএনপির বিভিন্ন সমাবেশে ক্ষমতাসীন দলের প্রকাশ্য হামলার বিষয়গুলো নিয়মিতই গণমাধ্যমে শিরোনাম হচ্ছে। এ বিষয়টা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। 

২০০৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত তার সরকার জনগণের কথা বলার অধিকার, চলাফেরার অধিকার, সমালোচনা অধিকার নিশ্চিত করেছে বলেও সংবাদ সম্মেলনে দাবি করে শেখ হাসিনা। 

কিন্তু, জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে-বিশেষ করে গুমের বিষয় নিয়ে। এ বিষয়ে জাতিসংঘের গুম বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটি ২০ সেপ্টেম্বর জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে একটি রিপোর্ট দিতে যাচ্ছে। 

এ ছাড়া যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স-ইআইইউ’র হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে গণতন্ত্রসূচক, গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা সূচক, মুক্তগণমাধ্যম সূচক, ইন্টারনেটের স্বাধীনতা সূচক- সব সূচকেই বাংলাদেশের অবস্থা খারাপ। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়েএ এ সবক্ষেত্রে পিছিয়ে বাংলাদেশ। ইআইইউ বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে ‘হাইব্রিড গণতন্ত্র’ বলেও অভিহিত করেছে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বিরোধী রাজনৈতিকদলগুলোর আস্থা অর্জন করতে হবে কমিশনকে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে হলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সরকারকে এ বিষয়গুলোর প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিতে হবে।

- মাহমুদ হাশিম, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, চীন আন্তর্জাতিক বেতার