ন্যাভিগেশন মেনু

চীন: বন্ধুত্বের চিন্ময় এক উদাহরণ


 ড. মোস্তাক আহমেদ গালিব

চীন আমাদের খুব কাছের বন্ধুরাষ্ট্র। উভয়দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কটি ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে স্থাপিত হলেও চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কয়েক দিনের বা কয়েক যুগের নয়। এই সম্পর্ক, এই বন্ধুত্ব বহু শতাব্দী প্রাচীন। 

হাজার বছরের আস্থার ইটে তৈরি এই সম্পর্কের গাঁথুনি। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে মহাপরাক্রমশালী হান সম্রাট ঊ এর আমলে তাঁর রাজদূত চাং ছিয়েন সর্বপ্রথম সিন্ধু অববাহিকার ভারতীয় সভ্যতার বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেন বলে চীনা ঐতিহাসিক সি মা ছিয়েনের বিবরণীতে জানা যায়। রাজদূত চাং ছিয়েন ব্যাকট্রিয়া অঞ্চলের দক্ষিণ পূর্বে ‘শেন তু’ নামক একটি উর্বর মহাজনপদের বিষয়ে উল্লেখ করেন এবং পরবর্তীতে চীনের সিছুয়ান প্রদেশ হয়ে সেই ‘শেন তু’ এর ‘মো জিয়ে থুও’ নামক মহাজনপদে যাবার জন্য বহুবার চেষ্টা করেন। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে ‘শেন তু’ এবং ‘মো জিয়ে থুও’ বলতে প্রাচীন সিন্ধু (‘শেন তু’) সভ্যতার অন্তর্গত মগধকেই (‘মো জিয়ে থুও) বোঝানো হয়েছে। এই চাং ছিয়েনকে প্রাচীন রেশম পথের উদ্ভাবক হিসেবে এখনও চীনে পরম শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করা হয়। 

হান সম্রাট ঊ ও তাঁর রাজদূত চাং ছিয়েন যে কাজটি শুরু করেছিলেন সেটিকে আরও এগিয়ে নেন পরবর্তী কালের বৌদ্ধ সাধক ফা শিয়েন (যিনি আমাদের দেশে ফা হিয়েন নামে পরিচিত), গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলে তিনি রাজধানী পাটালিপুত্রে আসেন এবং একাদিক্রমে দশ বছর এখানে অবস্থান করেন। পরবর্তীতে থাং সম্রাটের আমলে ফা শিয়েনের পথ ধরেই এদেশে আসেন সুবিখ্যাত বৌদ্ধ সাধক সুয়ান জাং (ইনি আমাদের দেশে হিউয়েন সাং নামে পরিচিত)।  সুয়ান জাং এর সরাসরি গুরু ছিলেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ শীলভদ্র। শীলভদ্র বাঙালি (প্রাচীন সমতট অঞ্চলের নবদ্বীপ এলাকার বাসিন্দা) ছিলেন বিধায় সুয়েন জাংকে একটি বাংলা নামও দেন। সুয়েন জাং-এর বাংলা নাম ছিল মোক্ষদেব। শুধু যে চীনারাই এখানে আসতো তা নয়, ফা শিয়েন বুদ্ধভদ্র নামক এক শ্রমণকে সঙ্গে করে চীনে নিয়ে গিয়েছিলেন। কালে বুদ্ধভদ্র চীনা ভাষায় অসাধারণ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন ও অবতংশ সুত্রের চীনা অনুবাদ করেন। 

আমরা অনেকেই হয়ত জানি আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর পুর্বে বিক্রমপুরের অতীশ দীপঙ্কর চীন সফর করেছিলেন। তিনি সেখানে গিয়ে চীনের মানুষের সাথে বাংলার সংস্কৃতির পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। অতীশ দীপঙ্কর ১০৫৪ সালে তিব্বতে মারা যান। বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ চীন ১৯৭৮ সালে তার দেহভষ্ম ফিরিয়ে দেয় বাংলাদেশকে। 

মধ্যযুগে বাংলার স্বাধীন সুলতানগনের আমলে দু’দেশের যোগাযোগ অনন্য মাত্রা লাভ করে। ১৪০৪-৩৯ সাল পর্যন্ত ৩৪ বছরে ইলিয়াসশাহী সুলতানদের ১৪টি মিশন চীনে গমন করে এবং চীন থেকে সমুদ্রপথে ৪টি বৃহৎমিশন মুলুক-ই-বাঙ্গালায় এসেছিল। এ সময় প্রথম বাংলার চীনা নামকরণ ‘পাং গে লা’ করা হয়, যা পরবর্তী কালে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান ‘মুং চিয়া লা’ নাম ধারন করে। এ সময় চীনে সর্বশেষ হান রাজবংশ মিং সাম্রাজ্যের শাসন চলছিল। মুলুক-ই-বাঙ্গালা থেকে মিং সম্রাট ইয়ুং ল্য- কে বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ সোনার পাতে চিঠি লিখে পাঠানো হয় এবং আফ্রিকা থেকে আনা জিরাফ উপহার পাঠানো হয়। মিং সম্রাট ইয়ুং ল্যকেও বিভিন্ন দলিল দস্তাবেজে মুলুক-ই-বাঙ্গালার কথা দুহাত ভরে লিখে রেখে গেছেন। মিং রাজবংশীয় দরবারি ইতিহাস মিং শী লু- এর ১৪তম অংশে লিখিত ইতিহাস থেকে জানা যায়  ইতোপূর্বে বেশ কয়েকবার মুলুক-ই-বাঙ্গালায় আক্রমণকারী ও শান্তি বিনষ্টকারী পার্শ্ববর্তী জৌনপুরের সুলতান ই পু লা জিন(ইব্রাহীম শার্কী)কে রাজকীয় দূত মারফৎমূল্যবান উপহার পাঠিয়ে খোদ সম্রাট ইয়ুং ল্য অনুরোধ করেন প্রতিবেশি অর্থাৎমুলুক-ই-বাঙ্গালার সঙ্গে সুশীল আচরণ করতে। প্রবল প্রতাপ সম্রাট ইয়ুং ল্য আজ বেঁচে নেই, কিন্ত প্রতিবেশির বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ানোর যে দীক্ষা তিনি দিয়ে গেছেন ছয়’শ বছর পেরিয়েও গণপ্রজাতন্ত্রী চীন তা থেকে বিচ্যুত হয় নি। বাংলাদেশের সঙ্গে বজায় রয়েছে চীনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। 

কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকেই দ্রুতগতিতে এগিয়েছে বাংলাদেশ চীন মৈত্রী। ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও এই দুই দেশের মধ্যকার চমত্কার কূটনৈতিক সম্পর্ক একটি রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত। এ দু’দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক’কে সত্যিকারভাবেই বলা চলে ‘উইন উইন’ সম্পর্কের আদর্শ উদাহরণ। বাংলাদেশী রাজনীতির চক্রনেমিতে ঢাকায় যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক সব সময়ই দৃঢ় ও মজভুত থেকেছে। দুদেশের বন্ধুত্বের নিদর্শন হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেই আশির দশক থেকে একের পর এক নির্মিত বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুগুলো। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দুই দেশ পরস্পরকে সমর্থন করেছে। ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ও সামরিক সম্পর্কের পাশাপাশি চীন এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার ও উন্নয়ন সহযোগী। 

ভারত মহাসাগরের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-কৌশলগত ও ভূ-অর্থনৈতিক অবস্থান আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে দেশটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে পরিণত হয়েছে। এমনকি বৈশ্বিক কৌশলগত সহযোগিতার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবস্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ থেকেই সার্ক এর শেষ হয়ে আসিয়ানের শুরু বিধায় বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগ-সেতু হিসেবে বিবেচিত। সে হিসাবে প্রায় আঠারো কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশই বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজারে প্রবেশের চাবি। এসব কারণেই চীনের ‘এক অঞ্চল এক পথ’ (বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ)নউদ্যোগের অতি গুরুত্বপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। পৃথিবীর প্রায় ১৫০ টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত গোটা উদ্যোগে থাকা সর্বমোট ছয়টি অর্থনৈতিক করিডোরের একটি, বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার-চীন অর্থনৈতিক করিডোরটি সরাসরি গিয়েছে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তাঁর সফরকালে দুই দেশের মধ্যে ২৭টি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়। এর মধ্যে ১৫টি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি হয়েছে দুই দেশের সরকার পর্যায়ে (জিটুজি)। বাকি ১২টি ছিল ঋণ চুক্তি ও সমঝোতা চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ বর্তমানে চলমান আছে, কিছু প্রকল্প শুরু হবার অপেক্ষায় আছে আর কিছু প্রকল্পের কারিগরি ও অর্থনৈতিক দিকগুলো আবার বিবেচনা করা হচ্ছে। 

বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার সহযোগিতার সম্পর্কটি আসলে প্রতিদিনই পরিণত হচ্ছে, পাচ্ছে বহুমাত্রিকতার ছোঁয়া। আশির দশকে যে সম্পর্কটি কেবলই ছিল প্রকল্প সহযোগিতা ভিত্তিক সেটি এখন ডাল পালা মেলেছে আরও অনেক বিভাগে। সরকারী বিনিয়োগের পাশাপাশি একটা বড় সংখ্যক বেসরকারি চীনা বিনিয়োগকারি এদেশে আছেন। এটা একটা ভালো দিক বটে, কেননা ‘এক অঞ্চল এক পথ’ উদ্যোগের পাঁচটি মৌলিক উদ্দেশ্য রয়েছে –সেখানে পঞ্চম ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো ‘পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধিকরণ’। কেবলমাত্র সরকারী উদ্যোগকে ভিত্তি করে দুইদেশের মানুষে মানুষে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করা কঠিন। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকেই সামনে এগিয়ে আসতে হবে। বেসরকারি চীনা বিনিয়োগকারীরা সেই পথে যাত্রাটি শুরু করেছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারও এক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছেন, সরকার সারাদেশে একশোটি ইপিজেড নির্মাণের পাশাপাশি চট্টগ্রামে একটি চীনা শিল্পাঞ্চল ও নির্মাণ করছে। নিঃসন্দেহে এই পদক্ষেপগুলো সার্বিকভাবে দেশের বেকার সমস্যা সমাধানের সাথে সাথে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। ইতোমধ্যেই গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে বেড়ে গেছে চীনা ভাষা শিখতে আসা মানুষের সংখ্যা। চাহিদা বেশি থাকায় সারাদেশেই বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে এমন নানা ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র। সাধারণ মানুষের কাছে চীন এখন মোটেই আর কোনও অচেনা দুরের দেশ নয়। 

বলা হয়ে থাকে বিপদেই বন্ধুর পরিচয়। সম্পর্কের বহুমাত্রিকতার আরেকটি উদাহরণ হলো দুদেশের মধ্যকার কোভিড-১৯ প্রটোকলের আওতাধীন সহযোগিতা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাথমিক টিকা প্রয়োগ পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। এর অর্থ সাড়ে ১৩ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনা। তাঁদের সবাইকে দুই ডোজ করে টিকা দিতে ২৭ কোটি ডোজ দরকার ছিল। একটা পর্যায়ে সংক্রমণ অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়ে টিকা কূটনীতির শিকার হয়ে প্রায় কোণঠাসা অবস্থায় পড়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ঠিক সেই সময় বাংলাদেশের সাহায্যে এগিয়ে আসে চীন। চীনের সিনোফার্মের টিকা এখন পর্যন্ত আমাদের দেশের কোভিড-১৯ প্রতিরোধ টিকার প্রধান উত্স হয়ে আছে। চীনের পক্ষ থেকে এটি নিঃসন্দেহে একটি সাধুবাদ পাবার মতো উদ্যোগ। আমরা জানি করোনা মহামারী পরবর্তী চীনে ‘হেলথ সিল্ক রুট’ প্রকল্পের আওতায় স্বাস্থ্য ও চিকিত্সা খাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিশাল দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের ক্ষেত্রে এখানে সহযোগিতার একটি ভালো সুযোগ রয়েছে। এর পাশাপাশি করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও সার্বিক দারিদ্র বিমোচনেও চীনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ। 

করোনা পরবর্তী সময়ে চীন সরকারের নেয়া অর্থনৈতিক প্যাকেজগুলোর কারনেই বৃহৎ অর্থনীতিগুলোর ভেতর এখনও সতেজ রয়েছে কেবল চীনের অর্থনীতি। বাংলাদেশ নিজেও এই কাজটি এখন পর্যন্ত বেশ সফলতার সঙ্গেই করতে পেরেছে। তবুও ধারণা করা হচ্ছে যে বাংলাদেশের একটা বৃহৎজনগোষ্ঠী মহামারী পরবর্তী সময়ে দারিদ্রসীমার নিচে চলে যাবে। এখানে একটা কথা কিন্তু না বললেই নয় য়ে ব্যাপক করোনা মহামারীর মধ্যেও চীন কিন্তু সফল ভাবেই দারিদ্রতাকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে পেরেছে। ২০২০ সালের ২৩ নভেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে দারিদ্রমুক্ত হয়েছে চীন। শতকোটির বেশি জনসংখ্যার দেশ চীনে কাজটি কিন্ত মোটেই সহজ ছিল না। ১৯৭৮ সালে কমরেড দেং শিয়াও পিং এর ‘খোলা দরজা নীতির’ ফসল হিসাবে চীনে দারিদ্র বিমোচনের গতি বাড়তে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় এক বিপুল সংখক জনগোষ্ঠী দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেলেও চীনের জন্য সম্পূর্ণভাবে দারিদ্র বিমোচন ছিল কঠিন, কেননা এতো কিছুর পরেও কিন্তু কিছু লোক দারিদ্রসীমার নীচেই থেকে যাচ্ছিল। পরবর্তীতে চীন সরকার ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ পাঁচশালা পরিকল্পনায় গ্রামভিত্তিক উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষা করে টেকসই উন্নয়নের নীতিমালা প্রণয়ন করে। এই পরিকল্পনাটিকেই বলা হয়ে থাকে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-এর ‘গ্রামাঞ্চল পুনরুজ্জীবিতকরণ’ কর্মপরিকল্পনা। গ্রামাঞ্চল পুনরুজ্জীবিতকরণ কর্মপরিকল্পনার আলোকে সরকার হাতে নেয় ‘টার্গেটেড পোভার্টি এলিভিয়েশন’ প্রকল্প। এই প্রকল্পের মূলকথা হলো দারিদ্র দূরীকরণে নানবিধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও দেখা গেছে কিছু লোক এর সুফল ভোগ করা থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে। বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠীর জন্য আসলেই কোথাও তেমন কোনও পরিকল্পনা নেয়া হয় না, আবার কখনও কখনও বলা হয় কিছু লোকের নিয়তিই হয়তো দরিদ্র অবস্থায় থাকা। প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং সরকার ভাঙতে চাইল দারিদ্রের এই দুষ্টচক্র। তাঁরা সারা চীন জুড়ে এমন ৮৩২ টি কাউন্টি চিহ্নিত করল যেখানে ইতোপূর্বে নেয়া সকল দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্পের পরেও দারিদ্রের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাননি সাধারণ মানুষ। দ্রুততার সাথে সরকারী কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রেষণে পাঠানো হলো এসব অঞ্চলে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিধায় আমিও নিজেও কিছু সময় সেখানে গিয়ে হাতে কলমে কাজ করেছি, কাছে থেকে দেখেছি সে বিশাল কর্মযজ্ঞ। প্রতিটি গ্রামের ‘টার্গেটেড পোভার্টি এলিভিয়েশন’ প্রকল্প কর্মকর্তার দফতরে থাকে সেই গ্রামের সকল দরিদ্র পরিবারের তথ্য। সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে পরিবার ভিত্তিক পরিকল্পনা নেয়া ও বাস্তবায়ন করা হয়। এক সময় পরিবারটি দারিদ্রের অভিশাপ থেকে বের হয়ে এলেও প্রকল্প কর্মকর্তার কাজ শেষ হয় না। কারন পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে চীনারা দেখেছেন প্রথমবার দারিদ্রসীমা পেরুনো এরা অনেকটাই দুর্বল শিশুর মতো, এদের কিছুদিন ঠিকঠাকভাবে খেয়াল না রাখলে এরা অনেকেই হয়তো নানবিধ কারণে আবারও দারিদ্রসীমার নিচে চলে যেতে পারেন। তাই প্রকল্প কর্মকর্তা সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখেন ও কেস টু কেস পদক্ষেপ নিয়ে টেকসই দারিদ্র বিমোচন নিশ্চিত করেন, যার ফলে সরকার নিশ্চিত হতে পারে দারিদ্রসীমা পেরুনো মানুষটি সহসা আর দারিদ্রসীমার নিচে নামবেন না। দারিদ্র বিমোচনে চীনের যে মহাসাফল্যের কথা বলে হয়ে থাকে, সে সাফল্যের পেছনে আসলে কাজ করেছে ‘গ্রামাঞ্চল পুনরুজ্জীবিতকরণ’ কর্মপরিকল্পনা। 

কতগুলো উন্নয়নশীল দেশ যদিও দারিদ্র বিমোচনে সাফল্যের দাবী করে থাকে, কিন্ত প্রবল পশ্চিমা নীতির ওপর দণ্ডায়মান বাস্তবতা বর্জিত এই দারিদ্র বিমোচন পদ্ধতি টেকসই নয় বিধায় বড় যে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর দেখা যায় একটা ব্যাপক সংখ্যক জনগোষ্ঠী হুটহাট দারিদ্ররেখার নিচে চলে যায়। আমাদের অনেক অর্থনীতিবিদগণই করোনা পরবর্তী এ সমস্যাটির দিকে আলোকপাত করেছেন। আমি মনে করি ‘এক অঞ্চল এক পথ’ উদ্যোগের ‘পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধিকরণ’ নীতির আলোকে চীনের পুনরুজ্জীবিত গ্রামসরকারগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের দারিদ্রপীড়িত গ্রামগুলোর যোগাযোগ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তনের বড় শিকার বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের গ্রা গুলো কিভাবে চীন বাংলাদেশ বন্ধুত্বের নিদর্শন পদ্মা সেতু নির্মাণের সর্বোচ্চ সুফল ঘরে তুলতে পারে সে বিষয়ে চীনের ‘সান নং’ (কৃষি, গ্রাম ও কৃষক) নীতির কথা বলা যেতে পারে। অনেকেই বলে থাকেন চীনের তৈরি পদ্মা সেতু জাগিয়ে তুলবে দেশের পিছিয়ে পড়া ২১ জেলার মানুষকে। কিন্তু এই বৃহৎকর্মযজ্ঞটি আসলে কিভাবে সাধিত হতে পারে? সেক্ষেত্রে অবশ্যই চীনের ‘সান নং’ নীতির আলোকে গ্রামীণ উত্পদন, গ্রামীণ উত্পাদক ও গ্রামাঞ্চল ভিত্তিক বিশেষ পরিকল্পনা বিষয়ে নজর দেয়া যেতে পারে। চীনা অভিজ্ঞতার আলোকেই হয়তো সমাধান করা যেতে পারে বাংলাদেশের এই সমস্যার। পদ্মা সেতুর কথা যখন এলোই, তখন চীনকে ধন্যবাদ না দিলে বড় অন্যায় হবে। সেতু নিয়ে বহু তালবাহানা করে অনেক দিন পার করে , প্রকল্প ব্যয় অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়ে বিশ্বব্যাংক যখন প্রকল্পটিকে গলা টিপে মেরে ফেলতে উদ্যত তখন কিন্তু চীনই বাড়িয়ে দিয়েছিল বন্ধুত্বের হাত। চীনা প্রকৌশলীগণ করোনা মহামারীর সময়ও লালফৌজের মতো দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থেকে প্রকল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। 

জলবায়ুর কথা যেহেতু চলেই এলো, তাহলে বলতেই হয় বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বড় হুমকি। আবার এই হুমকি মোকাবেলায় বিদেশী সহযোগিতা প্রাপ্তির জন্য বাংলাদেশকে দ্রুত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার পশ্চিমা বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। একটি জনবহুল উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জেরও। উদাহরণ স্বরূপ ধরা যাক, বিদ্যুৎ উত্পাদনের কথা। এমনিতেই বাংলাদেশে প্রাকৃতিক উত্স থেকে প্রাপ্ত জ্বালানী অপ্রতুল, তার ওপর বিগত কয়েক দশকে পশ্চিমা জ্বালানী কোম্পানির খামখেয়ালীপনা, অদক্ষতা ও অপচয়ের দরুন বিপুল পরিমাণ জ্বালানী স্রেফ নষ্ট হয়ে গিয়ে বাংলাদেশ এখন কার্যত বিপদে। অন্যদিকে উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎঅত্যাবশ্যক। আমাদের দেশটি মোটের ওপর সমতল ভূমি বিধায় এখানে জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা অপ্রতুল আবার জ্বালানী পুড়িয়ে যেনতেনভাবে বিদ্যুৎ উত্পাদন করলে কার্বন দূষণের খাঁড়াও থাকছে ঠিক মাথার ওপর। এই শাঁখের করাতের হাত থেকে বাঁচতে নবায়নযোগ্য জ্বালানী ভিত্তিক প্রকল্পগুলো একটি ভালো পদক্ষেপ হতে পারে। আমরা আশান্বিত যে বাংলাদেশ চীন উভয়েই এ বিষয়ে সচেতন এবং চীনের সহযোগিতায় বেশ কিছু সৌরবিদ্যুৎপ্রকল্প বর্তমানে চলমান। আরও কিছু পরিবেশবান্ধব অন্যান্য প্রকল্পও পাইপলাইনে আছে। 

এখানে একটা কথা না বলে পারছি না, অনেকেই আবার চীনা প্রকল্প ঋণের ভেতর ‘ঋণের ফাঁদের’ জুজু দেখেন। প্রথমেই বলছি ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে চীন তিনটি বিষয়ে কখনই আপোষ করে না, বিষয় তিনটিকে চীনা ভাষায় একত্রে বলা হয় ‘সান কুং’ এগুলো হলো ‘কুং শাং’ (ডিসকাস টু গেদার বা সমন্বিত আলোচনা), ‘কুং জিয়েন’ (বিল্ড টুগেদার বা সমন্বিত বিনির্মাণ) ও ‘কুং শিয়াং’ (শেয়ারিং টুগেদার বা একসাথে ফলাফল উপভোগ করা)। কাজেই বিষয়টি মোটেই সেরকম নয় যে এখানে কেউ চাইলেই কাউকে বোকা বানিয়ে ফাঁদে ফেলবে কারণ এখানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো কাজটিই দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে হয়ে থাকে। সর্বোপরি আমাদের দেশের দক্ষ অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকগণ চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই কেবল একটি প্রকল্পকে গ্রিন সিগন্যাল দিলে চীনা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে চীনা কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠানই এককভাবে ঋণ সরবরাহ করে না, এক্ষেত্রে  এশিয়া অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক (AIIB) , নতুন উন্নয়ন ব্যাংক (NDB) ইত্যাদির মতো এক বা একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের আকার ভেদে এতে অংশ নিয়ে থাকে। সর্বোপরি আমাদের সরকারের পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) নীতির আলোকে অংশীদারিভিত্তিক প্রকল্পগুলোতে যৌথভাবেই প্রকল্প পরিচালনা হচ্ছে বিধায় এখানে সেসব ঝুঁকিই নেই। এক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটে’ একটি আদর্শ উদাহরণ।

সবশেষে যে কথাটি না বললেই নয় সেটি হলো উন্নয়নের পথে চীনের দীর্ঘযাত্রাটিতে চীনকে পার হতে হয়েছে অনেক চরাই উৎরাই। এগুলো সবই কিন্তু বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স। কাজেই বাংলাদেশের উন্নতির পথে বাংলাদেশ ও চীনের ভেতরকার সহযোগিতাকে একটি বা দুটি ক্ষেত্রে আবদ্ধ না রেখে আরও সম্প্রসারিত করলে তা উভয় দেশের জন্যই সুবিধা বয়ে আনবে। পাশাপাশি উভয়দেশের বন্ধুত্বকে আরও নিবিড় করে মানুষে মানুষে ‘পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধিকরে’ সফল করে তুলবে ‘এক অঞ্চল এক পথ’ উদ্যোগেটিকে। 

- ড. মোস্তাক আহমেদ গালিব চীনের ঊহান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও ‘এক অঞ্চল এক পথ’ গবেষণাকেন্দ্রের পরিচালক।