ন্যাভিগেশন মেনু

আজ নীলিমা ইব্রাহীমের প্রয়ান দিবস


বিশেষ প্রতিবেদক

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ নীলিমা রায় চৌধুরীর আজ ( ১৮ জুন) প্রয়ান দিবস। ২০০২ সালে এ দিনে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। কিন্তু তাঁর কাজ ও আদর্শ স্মরণ করেন বাংলাদেশের মানুষ।

নীলিমা রায় চৌধুরীর বাল্য কিংবা শিক্ষাজীবন দারুন গৌরবোজ্জল। ১৯৩৫ সালে চারটি বিষয়ে লেটার নম্বর নিয়ে ম্যাট্টিক পাস করেন। বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে ভর্তি হন।

১৯৪১ সালে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে প্রথম শ্রেণি লাভ করেন। তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকায় উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটক নিয়ে ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯২১ সালের ১১ অক্টোবর খুলনায় জন্ম গ্রহণ করেন নীলিমা রায় চৌধুরী। তার বাবা প্রফুল্ল কুমার রায় চৌধুরী খুলনার বিশিষ্ট উকিল ছিলেন। তাদের পূর্ব-পুরুষ ছিল জমিদার বংশের।

নীলিমা রায় ১৯৪৫ সালে ইন্ডিয়ান আর্মি মেডিক্যাল কোরের ক্যাপ্টেন ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমকে বিয়ে করেন। তারপর তিনি নীলিমা ইব্রাহিম নামেই সমধিক পরিচিত হয়ে ওঠেন। পারিবারিক জীবনে তিনি পাঁচ মেয়ে সন্তানের জননী।

নীলিমা ইব্রাহীমের কর্মের ব্যাপ্তি বিশাল। শিক্ষা, সাহিত্য, সমাজসেবা, অর্থনীতি চিন্তা, রাজনীতির বাস্তবতা এবং নারীর সঠিক পরিচয় নির্ণয়ে তার আছে নিরলস সাধনা।

ষাটের দশকটি ছিল বাংলাদেশের (তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান) জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাল। এ সময় থেকেই বাঙালি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শুরু করে।

সেই সময়টিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নীলিমা ইব্রাহিমের আগমন ঘটে। ১৯৫৬ সালে প্রভাষক পদে বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। তারপর শিক্ষার্থীদের পাঠদানের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গেনে নানাবিধ সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি।

ষাটের দশকের শুরু থেকেই বেশ কিছু উপন্যাস যেমন, বিশ শতকের মেয়ে, একপথ  দুইবাঁক, কেয়াবন সঞ্চারিনী প্রকাশিত হয়। তাছাড়া নীলিমা ইব্রাহিমের বেশ কিছু প্রবন্ধ এ সময় সাহিত্যিক  সমাজে তোলপাড় সৃষ্টি করে।

শরৎ প্রতিভা, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, বাংলার কবি মধুসূদন এবং তার গবেষণাধর্মী বই উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি সমাজ ও বাংলা নাটক সুধি মহলে ব্যাপকভাবে প্রশংশিত হয়। তিনি শক্তিশালী লেখিকা হিসেবে নিজের আসনটি শক্ত করেন।

এসব উপন্যাস ও প্রবন্ধে তিনি সমাজ সচেতনা কথা তুলে ধরেন। বিশেষ করে নারীদের মনের কথা বলার চেষ্টা করেন। পুরুষের পাশাপাশি নারীর সাবলম্বী হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গীর কথাই যেন তার গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় ছিল।

তিনি বাঙালি নারীকে দেখতে চেয়েছেন, নারীরাও মাথা উচু করে হেঁটে চলবে। মেরুদণ্ড যেন বাঁকা না হয়। যে নারী উপার্জন করে পুরুষ তাকে অবজ্ঞা করতে শতবার চিন্তা করে, এ কথাটি তিনি বিভিন্নভাবে প্রবন্ধ ও উপন্যাসে উপস্থাপন করে পাঠকের চিন্তাকে বিস্তৃত করার চেষ্টা করেন।

নারীর ব্যক্তিত্বের বিকাশ, তার স্বাধীন সত্তার উন্মোচন এবং সমাজে নারীর যথাযোগ্য স্থান নির্ণয়ের প্রয়াস পেয়েছেন তিনি। তবে তিনি নারীবাদী লেখিকা নন। সমাজে অসম বিকাশের জন্য নারী মুক্তির ক্ষেত্রে যে অচলায়তনের সৃষ্টি হয়েছে, তা ভেঙে নারী পুরুষের সুস্থ, স্বাভাবিক ও আত্ম-সস্মান সম্পন্ন জীবন লাভই তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।

ওইদিক থেকে তিনি এক মানবতাবাদী লেখক। বিশ শতকের মেয়ে, কেয়াবন সঞ্চারিনী প্রভৃতি উপন্যাসে তিনি নারীকে স্বাধীন, স্বাবলম্বী ও মানুষ  হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। তার বিশ্বাস, নারী পুরুষের মিলিত প্রয়াসেই মানবমুক্তি সম্ভব।

তিনি রাজনৈতিক সচেতন শিক্ষক ছিলেন। তাই পাকিস্তান সামরিক সরকারের বাঙালি দলন নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন বারবার। ১৯৬১ সালে কবিগুরুর জন্মশতবার্ষিকী পালনকে পূর্ব পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করলে তিনি এর বিরোধীতা করেন।

১৯৬৪ দাঙ্গায় নিপীড়িত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং আধুনিক বাঙালি জাতীয়তা চেতনায় একদল নতুন সাহিত্য ও সংস্কৃতিক কর্মী তৈরির কাজে আত্ম নিয়োগ করেছিলেন।

বাংলা বিভাগের সেই আদর্শবাদী, বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের ব্রতী, অঙ্গীকার দীপ্ত অধ্যাপিকা নীলিমা ইব্রাহিম বিপুল ছাত্রসমাজকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিলেন।

নীলিমা ইব্রাহিমের জ্যেষ্ঠ মেয়ে মঞ্জুরা কবীর সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় থাকার সময় আমাদের বাড়িটা ছিল বহু ছাত্রছাত্রীর অস্থায়ী আস্তানা। আজকের বহু নামীদামি নেতারা তখন ছিলেন ছাত্রনেতা। মা ছিলেন রাজনৈতিক সচেতন মহিলা।

সেই উনসত্তরের ছাত্র আন্দোলন, ছয় দফা, এগারো দফার দিনে মা উদার হস্তে তার ছাত্রদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। ছাত্রছাত্রীরা সারা দিন মিটিং মিছিল সত্ত্বেও ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে চলে আসত মায়ের কাছে। থাকা খাওয়ার সাথে সাথে মার প্রচণ্ড আশাবাদী মনের স্পর্শে উজ্জীবিত হতো তারা। আমার আজ মনে পড়ে, কী চরম স্নেহে মা এসব ছাত্রদের ভালোমন্দের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন।’

নীলিমা ইব্রাহিম সাহসী ছিলেন, তাই পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা নজরদারীকে তোয়াক্কা করতেন না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নীলিমা ইব্রাহিম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছেড়ে বিভিন্ন গ্রামে গঞ্জে আত্মগোপন করেন।

এ সময় আকাশবানী থেকে প্রচার করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিমকে হত্যা করা হয়েছে। সংবাদটি প্রচারিত হওয়ার কিছুদিন পর জুনের শেষদিকে যুদ্ধের মধ্যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফিরে আসেন তিনি।

এ সময় পাকিস্তান সরকারের প্রযোজন ছিল নীলিমা ইব্রাহিমকে বাঁচিয়ে রাখা। তবুও তিনি পাকিস্তানী খানসেনাদের মুখোমুখি হয়েছেন অসংখ্যবার।

পাকিস্তানী খানসেনার তার বাড়ি সার্চ করতে এসেছিল। তখন চার  মেয়ে ও মেঘনা গুহ ঠাকুরতা (শহীদ অধ্যাপক জ্যোতিময় গুহ ঠাকুরতার মেয়ে)  ফুলার রোডের শিক্ষক কোয়ার্টারে ছিলেন।

আর্মি ক্যাপ্টেন বাড়ি সার্চ করতে এলে তিনি শান্ত গলায় বলেন, ‘বাড়িতে আমার মেয়েরা আছে, কোনো পুরুষ মানুষ নেই।’ কী ভেবে সেদিন মিলিটারিরা বাড়ি সার্চ না করে চলে যায়। তাছাড়া তাকে হেনস্থা করার জন্য ক্যান্টনমেন্ট থেকে তার নামে চিঠিও আসে।

স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু সরকার নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠিত হলে নীলিমা ইব্রাহিম একজন সম্মানীত দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন। শ্রদ্ধেয় বিচারপতি কে এম সোবহানের প্রধান দায়িত্বে ছিলেন।

নীলিমা ইব্রাহিমের এই কাজের বিশাল অভিজ্ঞতার খানিকটা ফসল আমরা পেয়েছি তার অমূল্য গ্রন্থ ‘আমি বীরঙ্গনা বলছি’ এর মাধ্যমে। এই বইয়ের মাধ্যমে  ’৭১ সালের যুদ্ধে লাঞ্ছিত বাঙালি নারীর কান্না-দুঃখ-শোকের ইতিহাসই কেবল পাই না, এখানে এক নারীর মানবাধিকার সচেতন শক্তিশালী লেখককে আমরা খঁজে পাই।

আমি বীরঙ্গনা বলছি, এই গ্রন্থের ভূমিকায় লেখিকা শুরুতেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন : ১৯৭২ সাল যুদ্ধ জয়ের পর যখন পাকিস্তানি বন্দীরা ভারতের উদ্দেশ্যে এ ভূ-খণ্ড ত্যাগ করে তখন আমি জানতে পারি প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ জন ধর্ষিতা নারী এ বন্দিদের সঙ্গে দেশ ত্যাগ করছেন।

অবিলম্বে আমি ভারতীয় দূতাবাসের সামরিক অফিসার ব্রিগেডিয়ার অশোক ডোরা এবং বাংলাদেশ কর্তপক্ষের দায়িত্বে নিয়োজিত মরহুম নুরুল মোমেন খান যাঁকে আমি মিহির নামে জানতাম তাঁদের শরণাপন্ন হই।

উভয়েই একান্ত সহানুভূতির মনোভাব নিয়ে এসব মেয়েদের সাক্ষাৎকার নেবার সুযোগ আমাদের করে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা নওসাবা শরাফী, ড. শরীফা খাতুন ও আমি সেনানিবাসে যাই এবং মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা লাভ করি। পরে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের সাথে যুক্ত থেকে নারকীয় বর্বরতার কাহিনী জানতে পারি। সেই থেকে বীরঙ্গনাদের সম্পর্কে আমার আগ্রহ জন্মে। এ ক্ষুদ্র গ্রন্থে সে আগ্রহের খণ্ডাংশ মাত্র।

গ্রন্থের এই ভূমিকা থেকেই পাঠক বুঝতে সক্ষম, পাকিস্তানীরা আমাদের মা-বোনের ইজ্জতের ওপর কী বিভৎস্য হামলা চালিয়েছিল। বইটি একটি প্রামাণ্য দলিল, তাই বইটি সর্বত্র পঠিত হওয়া প্রয়োজন। 

বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দিয়ে ১৯৭৪ সালে নীলিমা ইব্রাহিম বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব নেন। বাংলা একাডেমিতে চলছিল অনিয়ম বিশৃঙ্খলা। দৃঢ় হাতে এসব অনিয়ম দূর করেছিলেন।

মকবুল নামে এক ভণ্ড খাদেম বাংলা একাডেমির চত্বর দখল করেছিল। প্রথমে ছিল একটি কবর এবং তার পাশে মাত্র চার শতক জায়গা। মকবুলের হাতের কারসাজিতে তা বেড়ে হয়ে গেল একশত চুয়াল্লিশ শতক।

আর একটু চাপ দিলেই আরও জায়গা বেড়ে বাংলা একাডেমিকে গ্রাস করে। প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে দৃঢ় হাতে ভণ্ড মকবুলকে উচ্ছেদ করতে পেরেছিলেন সেদিন। মকবুলের কাছে পাওয়া গিয়েছিল ১৪২টি চাঁদা আদায়ের বাক্স।

শহরের বিভিন্ন স্থানে এবং শহরের বাইরেও এই বাক্সগুলো রক্ষিত ছিল। এর তত্ত্বাবধান করত এক সুসংগঠিত দল। তারা চাঁদার ভাগ নিত এবং বাক্স পাহাড়া দিত। কিন্তু মকবুলের অবৈধ ব্যবসা ভেঙে দেওয়ার পর এই বাক্সের তালা আর সে খুলতে পারেনি। পাহারাদরাই সেই বাক্স দখল করে নিয়েছে। বাংলা একাডেমি রাহুমুক্ত হয়েছে। প্রয়োজনে কী কঠিনই না হতে পারতেন তিনি।

১৯৭২ সালে থেকে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির  সভাপতি ছিলেন তিনি। এ সময়  থেকে এই প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবী মহিলা আবাস চালিয়েছেন। গড়ে তুলেছেন মহিলা সমিতি মিলনায়তন। তার উৎসাহে এই মিলনায়তন মঞ্চে নিয়মিত নাটক উপস্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি করে তিনি এ দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও বিরাট অবদান রেখেছিলেন। পরে মহিলা সমিতি ভবনের উপর তলায় একটি সেমিনার কক্ষ চালু করেছেন। যেখানে সৃজনশীল বিষয়ের চর্চার জন্য সেমিনার কক্ষ উন্মুক্ত করে দেন।

নীলিমা ইব্রাহিমকে  একবার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল।  খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর শেষ দিকে ১৯৯৫ সালে। ’মাগো আমি কোয্যাবো’ লেখার জন্য সরকার রাষ্ট্রবিরোধী মামলা ঠুকে দিল।

নীলিমা ইব্রাহিমের বাসায় পুলিশ খুঁজতে গিয়েছিল, পায়নি। তিনি অসুস্থ ছিলেন, তাই আগাম জামিনের জন্য হাইকোর্টে গেলে সেখান থেকে নানা টালবাহনায় প্রত্যাখ্যাত হন।

নিন্ম আদালত থেকে জামিন আনয়নের কথা বলা হয়। সেই করুণ ও হৃদয়বিদারক কাহিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। স্বাধীন দেশে একজন নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ ও কলমসৈনিকের এই অবস্থা। সাংবাদিক কাজী শাহেদ আহমেদও (আজকের কাগজ) আসামি ছিলেন।

তিনি বলেন, ‘নীলিমা ইব্রাহিম মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আজকের কাগজে লিখে গেছেন। লেখার ক্ষেত্রে তার জুড়ি ছিল না। এ দেশে সৎ থাকলে নানা সমস্যায় পড়তে হয়। তিনিও পড়েছিলেন।’

এস এস