ন্যাভিগেশন মেনু

আমার শিকড় বাংলাদেশের মাটিতে গাঁথা: প্রণব মুখোপাধ্যায়


প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে শুধু ভারত নয়- বাংলাদেশের মানুষও শোকে কাতর। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বুধবার বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় শোকদিবস ঘোষণা করা হয়েছে। 

বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের রাষ্ট্রপতির আসন অলংকৃত করে তিনি ইতিহাস গড়েছিলেন। আর বাঙালির মুখ উজ্জল করেছিলেন। বিশ্বে পরম গর্বিত হয়েছিল বাঙালিরা।

অপরদিকে বিয়ের সূত্রে প্রণব মুখার্জী বাংলাদেশের আদরের জামাই। তাই বাংলাদেশের আত্মার বন্ধনে জড়িয়ে আছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।

তাঁর প্রাণপ্রিয় স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশের নড়াইলের সন্তান। শুভ্রা মুখ্যার্জী ভদ্রবিলা গ্রামের স্বর্গীয় অমরেন্দ্র ঘোষের মেয়ে শুভ্রা। তারা চার ভাই ও চার বোন।

নড়াইলের জামাই প্রণব মুখার্জীর মৃত্যুতে চিত্রা নদীর পাড়ের ভদ্রবিলা গ্রামে গভীর শোক সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর আত্মীয়-স্বজনসহ নড়াইলের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।  

২০১৩ সালের ৫ মার্চ সকালে শ্বশুরবাড়ি বেড়ানোর উদ্দেশে স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জীসহ নড়াইলে বেড়াতে আসেন ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী।  এরআগে ১৯৯৬ সালে মেয়ে শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে বাবার বাড়ি বেড়িয়ে যান শুভ্রা। 

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী শুভ্রা পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত নিজের গ্রাম নড়াইলের ভদ্রবিলায় কাটিয়েছিলেন। এরপর দাদা বাড়িতে থেকে স্থানীয় চাঁচড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে লেখাপড়া করেন। পরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভারত চলে যান।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাকালীন ১৯৫৭ সালের ১৩ জুলাই শুভ্রা ঘোষের  সঙ্গে প্রণব মুখার্জীর বিয়ে হয়। ওই সময় তারা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। অভিজিৎ মুখার্জি ও সুরজিৎ মুখার্জী নামের দুই ছেলে ও শর্মিষ্ঠা মুখার্জী নামে এক মেয়ে রয়েছে তাঁদের।

শ্বশুর বাড়ি ঘুরে যাওয়ার পর নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে স্ত্রীর নামে একটি তিনতলা ছাত্রী হোস্টেল করে দিয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। 

এছাড়া শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের দাদাবাড়ি চাঁচড়ায় একটি মন্দির ও একটি হাইস্কুলে ভবনও নির্মাণ করে দিয়েছেন তিনি। 

আত্মীয়তার এই বন্ধনকে স্মরণ করে ২০১৩ সালের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বক্তৃতায় প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, “আমার শিকড় বাংলাদেশের মাটিতে গাঁথা এবং আমি এর ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আত্মভূত করেছি। আমার স্ত্রীর জন্ম নড়াইলে এবং এখানেই তিনি লেখাপড়া শুরু করেন।

তিনি আরও বলেন, “আমি বড় হয়েছি আপনাদের মতো একই সাহিত্যিক ও কবিদের লেখা পড়ে, সেসব গান শুনে যা আমাদের উভয় দেশের জনগণ ভালোবাসেন, ঘুরে বেড়িয়েছি একই নদীর তীরে, যা একই রকম গানের জন্ম দেয়, যা আমাদের মনকে একই রকমভাবে ভাবিত করে তোলে।”

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মিরাটি গ্রামে ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া প্রণবের বাবা কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনও ছিল বর্ণিল। 

ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়ায় বেশ কয়েকবার কারাবরণও করতে হয় এ কংগ্রেস নেতাকে। প্রণববাবুর মায়ের নাম রাজলক্ষ্মী মুখোপাধ্যায়। 

ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর প্রণব মুখোপাধ্যায়  (পল্টু) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে আইন বিষয়েও ডিগ্রি নিয়েছিলেন। কিছুদিন কলেজের শিক্ষক ও সাংবাদিক হিসেবে কাজ করলেও তার আগ্রহ ছিল রাজনীতিতে। 

১৯৯৫-৯৬ সালে তিনি পি ভি নরসীমা রাওয়ের মন্ত্রিসভায় বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ সাংসদ পুরস্কারে ভূষিত হন। প্রণব মুখোপাধ্যায় জাতীয় কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গ শাখারও সভাপতি ছিলেন। 

১৯৮৪ সালে নিউ ইয়র্কভিত্তিক ‘ইউরো মানি’  জার্নালের এক জরিপে প্রণব মুখার্জী সে সময় বিশ্বের সেরা ৫ অর্থমন্ত্রীর একজন হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন। ‘ইমার্জিং মার্কেটস’ জার্নাল তাকে ২০১০ সালে এশিয়ার সেরা অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিল।

শুরুতে বাংলা কংগ্রেসের হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালে রাজ্যসভায় প্রথমবার সদস্যও হন এ দলের থেকে। 

অবশ্য দ্রুতই তিনি ইন্দিরা গান্ধীর নজর কাড়তে সক্ষম হন। হয়ে ওঠেন কংগ্রেসের অন্যতম প্রভাবশালী চরিত্র। যে কারণে পরের কয়েক দশকের বেশিরভাগ সময়ই বীরভূমের পল্টুকে দল, পার্লামেন্ট আর সরকারের নানা দায়িত্ব সামলাতেই ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। 

ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২০১২ সালের জুলাই মাসে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ সালেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী ও কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় সমস্যা-সমাধানকারী নেতা।

দেশের প্রতি অবদানের জন্য তাকে ভারতের সর্বোচ্চ ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন ও পদ্মবিভূষণ এবং শ্রেষ্ঠ সাংসদ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। 

প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রায় পাঁচ দশক ভারতীয় সংসদের সদস্য। 

১৯৭৩ সালে কেন্দ্রীয় শিল্পোন্নয়ন উপমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রথম ক্যাবিনেটে যোগদান করেন। 

ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পরে একটি দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দের শিকার হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। এই সময় রাজীব গান্ধী তাকে নিজের ক্যাবিনেটে স্থান দেননি। কিছুকালের জন্য তাকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল। 

এই সময় তিনি রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে নিজস্ব একটি দলও গঠন করেছিলেন। তবে ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে মিটমাট করে নেওয়ার পর এই দল নিয়ে তিনি আবার কংগ্রেসে যোগ দেন। 

প্রণব মুখোপাধ্যায় বিভিন্ন সময়ে প্রতিরক্ষা, অর্থ, বিদেশ, রাজস্ব, জাহাজ-চলাচল, পরিবহণ, যোগাযোগ এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রকের মতো একাধিক মন্ত্রকের দায়িত্ব গ্রহণের বিরল কৃতিত্বের অধিকারী।  

২০১২ সালের ২৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন তিনি। 

২০১৩ সালের ৫ মার্চ তিনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার "বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা" পান। ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ মরিশাস বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডক্টর অফ ল সম্মান দেয়। ২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার ভারতরত্ন সম্মানে সম্মানিত হন।

অসুস্থ হয়ে গত ১০ আগস্ট দিল্লির সেনা হাসপাতালে ভর্তি হন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী। হাসপাতালে করোনা রিপোর্ট পজেটিভ আসে। এরপর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ’র কারণে ব্রেন সার্জারি হয়। 

প্রণব মুখার্জী দিল্লির আর্মি রিসার্চ অ্যান্ড রেফারেল হাসপাতালে সোমবার (৩১ আগস্ট) সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। 

লেখক: আজকেরবাংলাদেশপোস্টের নির্বাহী সম্পাদক

[email protected]