ন্যাভিগেশন মেনু

অগ্নিঝরা মার্চের ২৫তম দিন:

ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ, গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু


২৫ মার্চ, ১৯৭১। বাঙালী জাতির এক বিভীষিকাময় ভয়াল কালরাত। এদিন দুপুরের পর থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। এদিন সকাল থেকেই সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। হেলিকপ্টারে তারা দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস পরিদর্শন করে বিকেলের মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরে আসে।

এদিন ঢাকার ইপিআর সদর দপ্তর পিলখানাতে অবস্থানরত ২২তম বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার বিভিন্নস্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়।

২৫ মার্চ সকালে পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ৪৫ মিনিট বৈঠক করে। তারপরই চলে যায় পাকিস্তান। আর এরই এক পর্যায়ে ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় কসাই টিক্কা খানকে গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে গোপনে চোরের মতো করাচি পালিয়ে যায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান।

”অপারেশন সার্চলাইট” বাস্তবায়ন করতে ”বেলুচিস্তানের কসাই”খ্যাত জেনারেল টিক্কা খানকে দায়িত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে ইয়াহিয়ার শঠতাপূর্ণ আলোচনা ছিল কেবলই একটি সময়ক্ষেপনের প্রক্রিয়া মাত্র।

মধ্যরাতে পিলখানা ইপিআর, রাজারবাগ পুলিশ, নীলক্ষেত ঘুমন্ত মানুষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আক্রমণ করে পাকিস্তানের পিশাচ সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও মর্টারের আঘাতে বিধ্বস্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়। পাকিস্তানী হায়েনাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় আঘাত। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। হত্যাযজ্ঞ চলে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে। গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পরিণত হয় ভুতুরে এলাকায়। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে উঠে বিভীষিকাময়। হানাদারেরা রাস্তার দুইপাশে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে। মেডিকেল কলেজ ও ছাত্রাবাসে গোলার পর গোলা ছুঁড়ে হত্যা করা হয় অজস্র মানুষকে।

এ ছাড়াও সেই রাতে একে একে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, জাতীয় প্রেসক্লাবেও অগ্নিসংযোগ, মর্টার সেল ছুঁড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাক হানাদাররা। এ হামলায় জীবন দিতে হয় বেশ ক’জন গণমাধ্যমকর্মীকেও।

অগ্নিসংযোগ করা হয় শাঁখারীপট্টি ও তাঁতীবাজারের অসংখ্য ঘরবাড়িতে। ঢাকার অলিগলিতে, বহু বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

জাতিসংঘের ঘোষণায় ‘জেনোসাইড’-এর যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বাস্তবায়ন হয়েছে সেদিন বাঙালির ওপর।

মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সর্ম্পকে লিখেছেন, “সে রাতে সাত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেপ্তার করা হয় আরও তিন হাজার মানুষকে। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট লুট। আর ধ্বংস সাধন যেনো তাদের নেশায় পরিণত হলো। ঢাকার রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুনতাড়িত শ্মশানভূমি।“

সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং শেষ শত্রু বিদায় না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। পরে হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে যায়।

পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে এক শ্বেতপত্র পাকিস্তানি সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিলো। পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত এই দলিলে বলা হয়: “১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিলো।”

এডিবি/