ন্যাভিগেশন মেনু

উলিপুরে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে ভাসমান সবজি চাষ


উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামের উলিপুরে হাতিয়া, দলদলিয়া, বজরা, থেতরাই, বুড়াবুড়ি, গুনাইগাছ, বেগমগঞ্জ ও সাহেবের আলগা ইউনিয়নসহ আরও বেশ কিছু  ইউনিয়নের বিরাট অংশ বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধ থাকে।

উপজেলার ওই এলাকাগুলো প্রায় ৫ থেকে ৬ মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে। কৃষকরা সময়মতো আবাদ করতে পারে না। ওই সময়ে ওইসব জলমগ্ন এলাকা কচুরিপানা ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ দিয়ে ঢাকা থাকে। বিশেষ করে বিভিন্ন খাল-বিল, নদী-নালা ও মজাপুকুর।

এ সময় সেখানে কোনও কৃষিকাজ থাকে না, ফসল হয় না, কৃষকরা বেকার সময় পার করে। যার ফলে অনেক জমি পতিত হিসেবে থাকে। বন্যা ও জলাবদ্ধ এলাকাগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের কৌশল হিসেবে ভাসমান সবজি উৎপাদনে কৃষি সমৃদ্ধির নতুন যুগের সূচনা করে আস্তে আস্তে উপজেলার জলাবদ্ধ এলাকায় এ কার্যক্রম সম্প্রসারিত হচ্ছে। সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে স্তুপ করে প্রয়োজনীয় মাপের ভেলার মতো বেড তৈরি করে ভাসমান পদ্ধতিতে জলাবদ্ধ এলাকায় বছরব্যাপী বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি অনায়াসে উৎপাদন হচ্ছে।

উলিপুরের কৃষকদের নিকট দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে এই ভাসমান বেডে সবজি চাষ পদ্ধতি।

সরেজমিনে নতুন অনন্তপুর, দুধকুমুর বিল, কালপানি বজরা, দিঘলাছড়া বিল, দড়িকিশোরপুর এলাকার বিভিন্ন জলাশয় ঘুরে দেখা গেছে, ভাসমান বেডে কলমি শাক, লাল শাক, লাউ, ঢেঁড়শ, বরবটি, মরিচসহ লতাজাতীয় ও লতাবিহীন বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি চাষ হচ্ছে।

এই পদ্ধতিতে কম জমিতে স্বল্প খরচে চাষাবাদ করে বেশি ফসল উৎপাদন করে অধিক লাভবান হওয়ার কারণে কৃষকদের মাঝে আগ্রহও বাড়ছে।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্পের আওতায় খরিফ-২/২০২১-২০২২ মৌসুমে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ২৮টি প্রদর্শনী ছাড়াও কৃষক উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে ভাসমান বেডে সবজি চাষ করা হচ্ছে। জলাশয়ে কচুরিপানা ও আগাছা ব্যবহার করে তৈরিকৃত বেডে সম্পূর্ণ জৈবিক পদ্ধতিতে সবজি চাষ করা হচ্ছে। সবজি উৎপাদনে ব্যবহার করা হচ্ছে জৈব বালাইনাশক ও সেক্স ফেরোমন ফাঁদ।

কৃষক রফিকুল ইসলাম জানান, 'দুধকুমুর বিলে কচুরিপানার কারণে বোরো মৌসুমে  ধানের আবাদ হয় না। কৃষি বিভাগের পরামর্শে কচুরিপানা নষ্ট করার জন্য কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়েছিল কিন্তু তাতেও কচুরিপানা ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ বিল থেকে কমে নাই। পরে কৃষি অফিসারদের পরামর্শে ভাসমান বেডে সবজি চাষ শুরু করি।'

তিনি বলেন, 'গতবার সেখান থেকে উৎপাদিত সবজি প্রায় ১৮ হাজার টাকা বিক্রি করেছি। কম জায়গায় বেশি ফসল উৎপাদন করে লাভবান হওয়ায় ওই এলাকায় আরও ৪-৫ জন কৃষক উদ্বুদ্ধ হয়ে ভাসমান বেডে সবজি চাষ শুরু করেছেন।'

হাতিয়া নতুন অনন্তপুর দুধকুমুর বিলের আজম আলী দম্পতি জানান, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে গত তিন বছর থেকে ভাসমান বেডে বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজি চাষ করে আসছেন। প্রয়োজন মতো নিজের বাগানের টাটকা সবজি তুলে পরিবারের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পরেও গত বছর ৮ হাজার টাকার সবজি বিক্রি করেছেন বলে জানিয়েছেন ওই দম্পতি।

এ ছাড়াও বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ভাসমান বেডগুলো অতিবৃষ্টি ও বন্যায় কখনও ডুবে ফসল নষ্ট হয় না, বাড়তি পানি সেচের প্রয়োজন হয় না, কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার ছাড়াই উৎপাদিত হচ্ছে এসব সবজি। গরু ও ছাগল সবজি বাগান নষ্ট করতে পারে না। এ ছাড়াও কম জমিতে বেশি ফসল উৎপাদন হয়।

তাছাড়া, ৬ মাস পর ওই পরিত্যক্ত বেডগুলো থেকে উৎকৃষ্টমানের কমপোস্ট সার অন্য জমিতে প্রয়োগ করতে পারে বলে কৃষকরা জানান।

নতুন অনন্তপুর ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ছায়িদুর রহমান বলেন, হাতিয়া ইউনিয়নের হিজলী গোফপাড়া প্রমত্তা দুধকুমুর বিলটি কচুরিপানার কারণে বছরের পর বছর পতিত হিসেবে পড়ে থাকতো। কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দিলেও সঠিক ভাবে পালন করতে না পারায় কোন লাভ হয়নি।

পরে ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে সবজি চাষ শুরু করা হয়। এখন দুধকুমুর বিলে এই পদ্ধতিতে কৃষকরা সবজি চাষ করে লাভের মুখ দেখতে শুরু করছেন বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষিবিদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ভাসমান বেডে সম্পূর্ণ জৈবিক পদ্ধতিতে সবজি চাষ করা হচ্ছে। এতে কৃষকরা সবজির উচ্চমূল্য প্রাপ্তির পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে পুষ্টির চাহিদা পূরণ হচ্ছে। একই সাথে জলাশয়গুলোকে ব্যবহার করে সবজি আবাদ এলাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামীতে উলিপুর উপজেলায় ভাসমান বেডে সবজি চাষ আরও জনপ্রিয় হবে বলে আশা করছেন তিনি।

এসআই/সিবি/এডিবি/