ন্যাভিগেশন মেনু

একুশের পথ বেয়ে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা


একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালীর জাতীয় জীবনে একটি ঐতিহাসিক দিন। একুশের আন্দোলনের বীজের মধ্যে অঙ্কুরিত ছিল বাঙালীর স্বাধীনতার মন্ত্র। একুশের মধ্য দিয়ে এসেছে স্বাধীনতা সংগ্রাম। সে এক মহা ইতিহাস। যার নায়ক জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে বাঙালীর অকাতরে প্রাণ দেওয়ার ঘটনা বিশ্বকে তাঁক লাগিয়ে দিয়েছে।অনন্য দিন একুশে ফেব্রুয়ারি। এদিন বাঙালী রক্ত দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছ থেকে তাঁর মাতৃভাষার মর্যাদা লাভ করেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু’র জীবনের বেশির ভাগ কেটেছে দখলদার পাকিস্তানের কারাগারে। কারাগারে বসেই তিনি একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনকে বেগবান করেছেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। 

আজ শুধু বাংলাদেশেই নয় - একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিরল মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। সারাবিশ্বে শ্রদ্ধার সঙ্গে উদযাপিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মূলত ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনই আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলনের গোড়াপত্তন করে দিয়েছিল। 

এক কথায় ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে। ভাষা আন্দোলন আমাদের শিখিয়ে দিয়েছিল শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে কিভাবে দাঁড়াতে হয়, মুক্তি কিভাবে আদায় করতে হয়।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে এসে দেশটির  গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্সের (বর্তমানে সুরাবর্দি উদ্যান) জনসভায় এবং কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা দেন।

সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র জনতার মধ্যে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এরপর ঢাকার পল্টন ময়দানে আবার ভাষাবিদ্রোহ উস্কে দেন জিন্নাহ। তিনি বলেন, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এর ফলাফল ছিল সুদূর প্রসারী।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলায় বক্তৃতা প্রদান এবং সরকারী কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি বাংলাকে দেশের সিংহভাগ নাগরিকের ভাষা উল্লেখ করে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবি জানান। 

সরকারী কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদও জানান তিনি। তাঁর এই বক্তব্য সমর্থন করেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত কয়েকজন গণপরিষদ সদস্য।  বাঙালী জনসাধারণ তাদের মাতৃভাষা দাবি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। 

‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবি নিয়ে ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে পড়ে। ভাষা নিয়ে আন্দোলন দমাতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সকল সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু বীর বাঙালী তা মানবে কেন।

এদিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সাধারণ মানুষকে নিয়ে খণ্ড খণ্ড মিছিল বের করেন। আন্দোলন দমাতে তৎকালীন পাকিস্তানের পুলিশের গুলিবর্ষণে প্রাণ হারান আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, রফিক,  শফিকসহ নাম না জানা অনেকে। 

প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে মহা ইতিহাস গড়েছেন বাঙালীরা। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও রাজপথে নেমে আসেন। স্বজন হারানোর স্মৃতি অমর করে রাখতে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের স্মরণে গড়ে তোলা হয় প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ। ২৬ ফেব্রুয়ারি স্মৃতির মিনার গুঁড়িয়ে দেয় পুলিশ। এতে কোন কাজ হয় না।

বাঙালীর ভাষার আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। ৯ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।ভাষার অধিকারের পক্ষে লড়ার পাশাপাশি, ঔপনিবেশিক প্রভূত্ব ও শাসন শোষণের বিরুদ্ধে একুশ ছিল বাঙালীর প্রথম প্রতিরোধ। 

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতিসত্তার যে স্ফূরণ ঘটেছিল তা-ই পরবর্তীতে বাঙালীর জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় প্রেরণা জোগায়। 

৫২’র পর থেকে প্রতি বছর দিনটিকে স্মরণ করে বাংলাদেশসহ বিশ্বে যথাযোগ্য মর্যাদা ও প্রাণের আকুতি দিয়ে উদযাপিত হচ্ছে মহান শহীদ দিবস। আজও সকলের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় সাহিত্যিক-কলামিষ্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত- চির বেদনার গান… আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি...।

চির বেদনার গান হলেও একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতি বছর বাঙালীর কাছে নতুন আবেগ আর নব চেতনায় জাগ্রত হয়ে আসে। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যাবার সাহস ও শক্তি জোগায়। অগ্রগতির পথে ধাবিত হওয়ার শক্তি পায় বাঙালী। 

বিনত মাথা নত করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় জাতি। অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। কেননা একুশে  ফেব্রুয়ারির পথ বেয়ে বাঙালী স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে। বুঝতে পারে আমরা ভীন জাতির পরাধীনভাবে বাস করছি। 

এর থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। বাঙালীর হৃদয়ের কথা অনুধাবন করে নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর বাণী দিয়ে থাকেন রাষ্ট্রপতি এবং  প্রধানমন্ত্রী। 

একুশের প্রথম প্রহরে রাত ১২টা ০১ মিনিটে  ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রথম পুষ্পার্ঘ্য নিবেদনের মধ্য দিয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী। 

এরপর পুরো জাতিকে শহীদদের প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা জানানোর জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় শহীদ মিনার। রাত ১২টা ০১ মিনিটে শুরু হওয়া এ শ্রদ্ধা নিবেদন পালা চলে পরের দিন সূর্যাস্ত অবধি। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে শহীদ মিনার। সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচি উদযাপন করা হয়। 

কিন্তু করোনা কারণে এ বছর কোন কর্মসূচীতে কাটছাট আনা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐতিহ্য বজায় রেখে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উপস্থিত হতে পারেন। তবে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কখন শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন, সেই বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং এসএসএফ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলে খসড়া কর্মসূচিতে উল্লেখ করা হয়েছে। 

বাংলাদেশের বায়ান্নর ভাষার সংগ্রাম আন্দোলিত করেছে বিশ্ববাসীকেও। বর্বর পাকিস্তানিরা যে  বাংলাকে নিশ্চিহ্ন করার  চেষ্টা করেছিল, আজ তা নিয়ে পৃথিবীর সব ভাষাভাষী মানুষের রয়েছে বিপুল আগ্রহ। 

আর বাঙালীর মহান নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জ্যোতি ছড়াচ্ছেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেরও আগে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

মাতৃভাষাপ্রেমী বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন জেলে। সে সময় ব্যক্তি মুজিব রাজনৈতিক ময়দানে অনুপস্থিত থাকলেও জেলে বসে নিয়মিত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন। 

১৯৫২ সালের পর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু, সংসদের দৈনন্দিন কার্যাবলী বাংলায় চালু প্রসঙ্গে তিনি আইন সভায় তুলে ধরেন। ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। 

দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। 

বিশ্বসভায় বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এটাই ছিল প্রথম উদ্যোগ। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনের প্রথম সরকারী নির্দেশ জারি করেন।

‘মা তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতন। এ কেবল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়, এ হচ্ছে সর্বকালের মানুষের চিরন্তন অনুভূতি। কবি অতুল প্রসাদ সেন এর ভাষায়- ‘মোদের গরব মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা।’ 

কবি আবদুল হাকিম মাতৃভাষা আগ্রাসনের ওপর একটি সার্থক কবিতা লেখেন,‘যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’

শুধুমাত্র  দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভাগ হয় ভারতবর্ষ। জন্ম নেয় পৃথক দুই রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্বাঞ্চলের মানুষ বাঙালী। মাতৃভাষা বাংলা। অপরদিকে পশ্চিমাঞ্চলে প্রচলিত ছিল সিন্ধী,পশতু, বেলুচসহ আরও কয়েকটি ভাষা। 

এ অবস্থায় পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলীম লীগ নেতৃত্ব উর্দুকে গোটা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত শুরু করে। অবশ্য তারও অনেক আগে পূর্ব বাংলায় ভাষা চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। বাঙালীর মায়ের ভাষার প্রতি অনুভূতি কত তীব্র ছিল তা জানিয়ে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম লিখেছিলেন- যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি...। 

কিন্তু এ অঞ্চলের মানুষকে পেছনে ফেলে রাখার প্রাথমিক ষড়যন্ত্র হিসেবে ভাষার ওপর আঘাত হানে পাকিস্তান সরকার। মায়ের ভাষা বাংলা কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ লিখেছিলেন, ‘মাগো, ওরা বলে/ সবার কথা কেড়ে নেবে।/তোমার কোলে শুয়ে/ গল্প শুনতে দেবে না।/বলো, মা,/ তাই কি হয়?

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, আজকের বাংলাদেশ পোস্ট      

ইমেইল: [email protected]