ন্যাভিগেশন মেনু

কভিড-১৯: চিকিৎসা পদ্ধতির ভবিষ্যত


প্রফেসর ড. পরেশ চন্দ্র মোদক:

করোনাভাইরাস আতঙ্কে পৃথিবী আজ অচল। এটি মানুষ আর ভাইরাসের মধ্যে একটি যুদ্ধ। প্রচলিত প্যাথলজি এবং সকল প্রকার সমরাস্ত্র এ যুদ্ধে অকেজো। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হলো একমাত্র মাধ্যম যা সকলে অনুশীলন করছে। নতুনভাবে উদ্ভাবিত কিটের মাধমে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে সনাক্ত করার পর লক্ষণ অনুযায়ি উপশমদায়ক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে এলোপ্যাথিক ঔষধের মাধ্যমে। এটা করা হচ্ছে আন্দাজে। কারণ এ রোগের ওষুধ এলোপ্যাথিতে নেই। 

যদিও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা লক্ষণভিক্তিক তবুও এ পদ্ধতির কথা কোন দেশের সরকার একবারও উচ্চারণ করেননি। সকল দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এলোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারক ও চিকিৎসকগণের মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এ যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে মহাব্যাস্ত। জনগণকে তাদের নির্দেশ মানতে বাধ্য করার জন্যে আইনপ্রয়োগকারী সকল বিভাগকে ব্যবহার করছেন। 

সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলি হচ্ছে-

১। এসেপটিক পদ্ধতি যেমন-মাস্ক ব্যবহার করা, ঘনিষ্ট সংযোগ ও গণসংযোগ এড়িয়ে চলা , নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ রাখা।

২। জীবানুনাশক দ্বারা হাত ধৌত করা ও স্প্রে করে বস্তুসমূহ জীবানু মুক্ত করা 

৩। রোগজীবানু সনাক্ত করা এবং

৪। এলোপ্যাথিক চিকিৎসা করা।

এই সমস্ত পদক্ষেপগুলি বৈজ্ঞানিকভাবে উন্নত দেশগুলির দ্বারা ডিজাইন করা হয়েছে যেখানে করোনার প্রাদুর্ভাব তীব্র। আমরা কেবল তাদের অনুসরণ করছি। আমাদের ভাবা উচিত স্থান কাল ও পাত্র ভেদে পদ্ধতির মাঝে ভিন্নতা থাকবে। আমাদের দেশ উষ্ণ ও আর্দ্র। দেশের অধিকাংশ মানুষ জীবানুমুক্ত পরিবেশে বাস করে না। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী। 

উন্নত দেশের লোকজনই বরঞ্চ নতুন কোন পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে না। তাই তারা সহজে আক্রান্ত হয়। সংক্রমিত লোকের স্পর্শেই  যখন অন্যরা আক্রান্ত হয় বিষয়টি যখন জানা তখন সেটা গোড়াতেই অর্থাৎ লেগ পিরিয়ডেই কন্ট্রোল করা স্বাভাবিক রুল। মাইক্রোবাইওলজিষ্টরা এ বিষয়টি ভাল করেই জানেন। 

কিন্তু তা করা হয়নি। ফলে সংক্রমণের সুযোগ পেয়ে বিনা বাধায় করোনা আজ লগ পিরিয়ডে অবস্থান করছে। এ অবস্থায় কন্ট্রোল করা এতো সহজ নয়। এখন দেশের সবাই এর খেসারত দিচ্ছে। যারা দেশের সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত তারা সরকারকে এ বিষয়ে আগে থেকেই অবহিত করেননি।

সাধারণ মানুষ এ বিষয়গুলি জানেন না। কিন্তু তারা তো জানেন। জনগণের স্বার্থে জনগণের অর্থে তারা নিয়োজিত। এ বিষয়টি তারা ভুলে গেছেন। তারা কি এ দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন?

উল্লেখ্য, এই পদক্ষেপগুলো অনেক পুরাতন, ১৬৭৬ সালে তৈরী করা যখন মানুষ এনিমেলকিউলস নামক মাইক্রোস্কোপে প্রথম ক্ষুদ্র বস্তুর উপস্থিতি লক্ষ্য করেছিলেন। মনে করা হতো- রোগের বীজ বাহির থেকে আসে। আর সেই রোগবীজ সংক্রামক, স্পর্শেই কাউকে আক্রমন করতে পারে।  তাই এসেপটিক পদ্ধতির উদ্ভাবন করা হয়েছিল যাতে রোগের বীজ কারো সংস্পর্শে না আসে। 

১৮৩০ সনে ইউরোপে কলেরার প্রাদুর্ভাবের সময় এসেপটিক পদ্ধতিগুলি কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়। কলেরার প্রাদুর্ভাবের সময় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার কার্যকারীতা ছিল সবচেয়ে বেশী। রোগের জীবানুকে না জেনেই লক্ষণ অনুসারে চিকিৎসা করে হোমিওপ্যাথগণ সফল হয়েছিলেন। এবিষয়টি ডক্যুমেন্টেড যে কেউ তা দেখতে পারেন। 

তারও ৩ বছর পর অর্থাৎ ১৮৩৩ সনে রবার্ট কচ কলেরা রোগের জীবানু আবিস্কার করেন। ১৮৫৪ সনে কলেরার মহামারীতে লন্ডন হোমিওপ্যাথিক হাসপাতালে কলেরায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথির কার্যকারীতা দেখে বেশ কিছু এলোপ্যাথিক চিকিৎসক যেমন-ড. মেকলাউলিন, ড. পপলার, ড. এন্ড্রুস, ড. জিলেস. ড. জর্জ সহ আরও কতিপয় চিকিৎসক মুগ্ধ হয়ে তাদের পেশা ছেড়ে দিয়ে হোমিওপ্যাথিতে আকৃষ্ট হন।

তৎকালে ব্রিটিশ জার্নাল অব হোমিওপ্যাথিতে এসব তথ্য পাওয়া যাবে। হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা কিন্তু লক্ষণভিত্তিক করা হয়, জীবাণুভিত্তিক নয়। এর পরেও বিভিন্ন সময়ে মহামারিতে হোমিওপ্যাথির কার্যকারীতা প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু করোনায় আক্রান্ত বিশ্বে হোমিওপ্যাথির নাম অনুপস্থিত। তাহলে কী হোমিওপ্যাথি এখন তার কার্যকারীতা হারিয়েছে? 

আমাদের দেশের সরকার হোমিওবান্ধব। কথাগুলি প্রায়ই বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ডের চেয়ারম্যান বিভিন্ন সেমিনারে বলে থাকেন। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি না।  হোমিওপ্যাথগণও এ ব্যাপারে মুখ খুলছেন না। কেন?

কোয়ারেন্টিনে থাকা, ঘনিষ্ট যোগাযোগ এবং গণসংযোগ এড়ানো নিজের জন্য তো ভালই অপরের জন্যও ভাল। তবে আমাদের সবার জন্য সাধারণ মাস্কের ব্যবহার সম্পর্কে একটু চিন্তা করা উচিত। কারণ, সাধারণ মাস্ক ব্যবহারে নিশ্চিতভাবেই ঘটবে অটোজেনিক সমস্যা। মানুষের কাছে যাওয়ার সময় মাস্ক ব্যবহার করা উচিত। নাক-মুখ কাপড় বা রুমাল দিয়ে ঢেকেও একই কাজা করা যায়। তবে, এটা কিছুক্ষনের জন্য। অন্য সময় নাক-মুখ খোলা থাকলে অসুবিধার কিছু নেই।

আমাদের অনেকে নাক বন্ধ রাখলে কিছুক্ষণের মধ্যেই সাফোকেশনে ভুগে, মাথা ধরে যায়। এ জন্যে শারীরিকভাবেও দূর্বল বোধ করে। তাতে সহজেই অন্য কোন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে যারা ইনফ্লুয়েঞ্জা ও হাঁচি-কাশিতে ভুগছেন, শ্বাসকষ্টে আছেন তাঁরা ভিড় এড়িয়ে চলবেন নতুবা মাস্ক ব্যবহার করে বাহিরে যেতে পারেন।

সর্দি-কাশির মতো করোনাতেও একইভাবে মানুষ বা অন্য কোন প্রাণী তাদের নাকের ও মুখের অভ্যন্তরে প্রথমে আক্রান্ত হয়। অ্যালকোহলে বা অ্যান্টিসেপ্টিক সাবানে হাত পরিস্কার করলে অবশ্যই তা পরিস্কার হবে। সাধারণ পানিতে কি হাত পরিস্কার হবে না? নিশ্চয়ই হবে। বরঞ্চ পানির দ্বারা মুখ-নাক উভয়ই পরিস্কার করা যায়।

কিন্তু অ্যান্টিসেপ্টিক সাবানে নাক ও মুখের ভিতরে পরিস্কার করা যায় না, সংক্রমনও বন্ধ হবে না।অ্যালকোহলে মুখ পরিস্কার করা গেলেও নাকের ভিতরে পরিস্কার করা যাবে না। তাছাড়া অ্যালকোহলের ক্রিয়া জীবানুর ওপর ধ্বংসাক্তক ও তাৎক্ষণিক। কিছুক্ষণ পরেই তা উবে যায়। জীবানুনাশক ক্রিয়াও আর থাকে না। 

এর চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থা হচ্ছে-পান, লবঙ্গ ও পানির যৌথ ব্যবহার। এক লিটার পানিতে ১০টি লবঙ্গ ও ১টি পান একত্রে জ্বাল দিয়ে আধা লিটার হয়ে গেলে তা নামিয়ে নিতে হবে। এই নির্যাস কুসুম গরম অবস্থায় ২-৩ মিনিট গার্গল করতে হবে। নির্যাসটি ঠান্ডা হয়ে গেলে একটি ড্রপারের সাহয্যে নাক উচু করে দুই নাকের ভিতরে প্রতিটিতে ১০ ফোঁটা দিয়ে আস্তে টান দিয়ে মুখ দিয়ে বের করে নিতে হবে। তাতেই নাক ও মুখের ভিতর যেমন পরিস্কার হবে তেমনি থাকবে সুরক্ষিত। এটা পরিক্ষিত। দিনে দুইবার করতে হবে। পেটের ভিতরে চলে গেলেও কোন ক্ষতি হবে না। 

তবে শিশুরা এটা করতে পারবে না, ওদের দরকারও নেই। বানানো নির্জাসটি ২ দিন কার্যকরী থাকবে। নির্জাসটির ২০-৩০ ফোঁটা হাত ও মুখে ঘসে দিলে সুরক্ষিত থাকবে। পুনরায় পানি না লাগানো পর্যন্ত এর কার্যকারিতা বজায় থাকবে।

বিজ্ঞানীরা কভিড-১৯ কর্তৃক সৃষ্ট সমস্যার সমাধান খুঁজতে খুবই ব্যাস্ত। প্লাজমা থেরাপি একটি সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে। তবে এই কৌশলটি একটি ভ্যাকসিনের বিকাশের অনুরূপ। সুতরাং অন্যান্য ভ্যাকসিনগুলির মতো এটি বিজ্ঞানীদের এখনও অবধি অজানা অনেক সমস্যা ভবিষ্যতে তৈরী করবে।

কোন রোগের প্রতিষেধক বের করতে হলে আমাদের কোষের মাইটোকনড্রিয়ার ডিএনএ আর রোগ জীবানুর ডিএনএ বা আরএনএ’র বৈশিষ্ঠের মধ্যে যে মিল থাকে তা খুঁজে বের করতে হবে। যদিও ভাইরাস অত্যন্ত সূক্ষ্ম জড়দেহ তবুও তারা জীবিত সত্তা। তবে এর আরেকটি সূক্ষ্মতর অংশ রয়েছে। 

এখন পর্যন্ত ভাইরাস নিয়ে যত গবেষণা করা হয়েছে তার অধিকাংশই সূক্ষ্ম জড়দেহ নিয়ে, সেগুলি অনুমান-পদ্ধতি নির্ভর। কেননা ভাইরাসের বিভিন্ন পর্যায় ও তার সংশ্লিষ্ট উপাদানসমূহ সূক্ষ্মতর বিধায় প্রত্যক্ষ উপলব্ধির আওতায় আসে না। তাই ভাইরাসের গবেষণা প্রথমে করতে হবে মানসিক গবেষণাগারে। মনকে একাগ্র করে ভাইরাসের সূক্ষ্মতর স্তরের কথা তথা অস্তিত্বের বাস্তবতা জানা যাবে। 

উল্লেখ্য, বিজ্ঞানীরা যদি ভাইরাসের অস্তিত্বের বাস্তবতাকে গবেষণাগারে বৈবহারিক কাজে রূপায়িত করতে পারেন তাহলে ভাইরাসের আক্রমণ ঘটবার আগেই তা প্রতিহত করতে পারবেন।

আমরা আমাদের সাধারণ জ্ঞান দ্বারা জানি, ওষুধের সক্রিয় কারণগুলি বিপরীত পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল তৈরি করে। রোগের আওতায় থাকা কোন ব্যাক্তির ওপর ওষুধের যেমন প্রভাব পড়বে সুস্থাবস্থায় থাকা ওই ব্যাক্তির ক্ষেত্রে ওষুধের ক্রিয়া অবশ্যই ভিন্ন হবে। এবং সাধারণ জ্ঞান আরও জানতে চায়, ওই দুই পরিস্থিতিতে ঠিক কী তফাৎ হয়েছিল। 

ওষুধ-অ্যাকশনের এই ভিন্নতা আপাতদৃষ্টিতে প্রচলিত ওষুধ বিজ্ঞানে উত্তর ছিল না, যতক্ষণ না স্যামুয়েল হ্যানিম্যান কর্তৃক ১৭৯০ সালে আরোগ্য নীতি (রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতা যে বস্তুর আছে, সেই বস্তুই আরোগ্য করতে পারে) দ্বারা অনুসন্ধান করা হয়েছে। এই নীতি একটি প্রাকৃতিক বিষয়। চিকিৎসা জগতে আরোগ্য নীতি বাস্তবায়নে হ্যানিম্যান নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তবে এটি আধুনিক ওষুধের ওপর প্রথম আক্রমণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকগণ এই নীতিকে কখনই মেনে নেয়নি তার একমাত্র কারণ তারা ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ও বিক্রেতাদের প্রদেয় আর্থিক সুযেগ-সুবিধা গ্রহণ করে থাকেন। রোগীর আরোগ্য তাদের নিকট গৌণ। এমনকি আরোগ্য শব্দটিই অ্যালোপ্যাথিতে নেই। 

হোমিওপ্যাথিতে ঔষধ প্রয়োগ করতে হয় সুনির্দিষ্টভাবে অসুস্থ অংশের ওপর, সুস্থ অংশে কখনই নয়। এ জন্যে শরীর ও মনের পরিবর্তন ও উভয়ের মধ্যে যথাযথ সংযোগ সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে মানসিক পরিবর্তনই প্রধান। কিন্তু অ্যালোপ্যাথিতে শারীরিক পরির্তনের গুরুত্ব বেশী, মানসিক পরিবর্তন নগন্য।

বস্তুকে সূক্ষ্ম অংশে বিভক্ত করে অনৌষধি বাহকের মধ্যে বিস্তৃতি ঘটানো ও তার মধ্যে পূর্বাহ্নে অকল্পনীয় ও নতুন আরোগ্যদায়ী শক্তির উন্মেষ ঘটানো এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। এ বিষয়টি সহজ ও সরল কিন্তু অ্যালোপ্যাথগণ তা বুঝতে চায় না কারণ এটি তাদের মতের বিপরীত।

বস্তুর মধ্যে লুকিয়ে থাকা শক্তির উন্মেষ ঘটিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি। কী সেই শক্তি, কী তার সুনির্দিষ্ট ক্রিয়া তা জানার জন্য সুস্থ মানুষকে বেছে নিয়েছিলেন তার পরীক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে। ওষুধের রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতা জানার এ এক অভিনব পদ্ধতি। যেহেতু মানুষের মন সর্বাপেক্ষা উন্নত, তাই সেই মনের অধিকারী মানুষই বলতে পারবে ওষুধের ক্রিয়ায় অনুভুতির কী ধরণের পরিবর্তন সাধিত হয়। এ ক্ষেত্রে ল্যাবরেটরির রাসায়নিক পরিবর্তনের কোন প্রয়োজন হয় না। কিন্তু অ্যালোপ্যাথগণ পশু-পাখীর শরীরে ওষুধ পরীক্ষা করেন এবং কোষ-কলার রাসায়নিক পরিবর্তন দেখেন। মনের তথা অনুভুতির পরিবর্তন তারা জানতে পারেন না। সম্ভবও নয়। 

হোমিওপ্যাথি এমন একটি বিজ্ঞান যা জানা যেতে পারে। এখানে কারও বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করার কেনও সুযোগ নেই; তাকে অবশ্যই এটি জানতে হবে বা এটি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকতে হবে; তাকে অবশ্যই এটি বুঝতে হবে না হলে বুঝতে ব্যর্থ হবে। হোমিওপ্যাথি বোঝা এত সহজ নয় যেমটি কেউ মনে করেন; তবে এটি অন্যান্য বিজ্ঞানের চেয়ে কঠিন বিষয়ও নয়। যারা বুঝতে ইচ্ছুক তাদের মধ্যে এই বোধগম্যতা সম্ভব।

হোমিওপ্যাথি রোগের নয়, রোগীর চিকিৎসা করে। রোগ প্যাথলজি দ্বারা চিহ্নিত করা হয় কিন্তু এটি হোমিওপ্যাথিতে অপ্রয়োজনীয়। রোগী কোন রোগ নয় বরং তার ইচ্ছাশক্তি, উপলব্ধি এবং চেতনা দ্বারা প্রকাশিত একটি জীবসত্ত্বা। প্যাথলজি দ্বারা দৃশ্যত এটি সম্ভব নয় তবে হোমিওপ্যাথির মাধ্যমে সম্ভব। এটি প্রত্যেক রোগীর একটি মানসিক প্রতিকৃতি তৈরী করে যা সুস্থ মানবদেহে প্রমাণিত কোন একটি ড্রাগের প্রতিরূপ। রোগীতে সেই ওষুধটি প্রয়োগ করা হলে রোগী আরোগ্য লাভ করে। বিষয়টি সহজ, সরল ও অনুরূপ তবে যারা বুঝতে আগ্রহী নন তাদের জন্য কঠিন। 

সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে যে, একজন চিকিৎসকের দায়িত্ব হলো রোগীকে আরোগ্য করা। হ্যানিম্যানও তাই-ই মনে করতেন। কিন্তু অ্যালোপ্যাথিতে রোগী আরোগ্য হয় না, রোগ সাময়িকভাবে চাপা পড়ে, কষ্টকর লক্ষ্মণসমূহ আপাতত দূর হয়। প্রকৃতিসৃষ্ট লক্ষ্মণাবলীকে স্থুল মাত্রায় অনেকগুলি ওষুধ প্রয়োগ করে দূর করতে পারলেই চিকিৎসক মনে করে রোগী সুস্থ হয়ে গেছে। রোগীও তাতে আত্মপ্রসাদ লাভ করে। 

আরোগ্যনীতি বোধগম্য না হওয়ায় অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকগণ প্রাকৃতিক শক্তির অপব্যবহার করে। প্রকৃতিও সেই সব রোগী ও চিকিৎককে একটি ভ্রান্ত অবস্থানে উন্নিত করে। ফলে, অচিরেই তা ফিরে আসে অনেকগুলি জটিল সমস্যা নিয়ে। তখন তারা অন্য একটি নাম ধরে রোগীর চিকিৎসা করেন। এটিও একটি ভ্রান্ত ধারণা। এভাবে রোগীর অবস্থা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠে।

হোমিওপ্যাথি প্রকৃতি বিরুদ্ধ এই সকল মতবাদকে স্বীকার করেনা বরং প্রাকৃতিক আরোগ্যনীতিকে চিকিৎসা পদ্ধতির ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে। তাতে শরীর ও মনের ভারসাম্য বজায় থাকে। কিন্তু অ্যালোপ্যাথিক ওষুধে শরীরের পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। ফলে অধিক সংখ্যক অজানা ভাইরাস সেখানে জড়ো হয়ে নতুন রোগ সৃষ্টি করে। প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস মহাশূন্য থেকে রোগজীবাণু বহন করে নিয়ে আসছে আর সেই সব ভারসাম্যহীন রোগীর দেহে প্রবেশ করছে। যার যে মাত্রায় ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয় সে অনুপাতে আগত ভাইরাস প্রবেশ করে। সে অবস্থায় রোগীর কোষ-কলায় যে পরিবর্তন হয়ে যায় তা আর আগের মতো থাকে না। এগুলিই নতুন রোগ নামে পরিচিত হচ্ছে। 

মাঝে মাঝে এইসব ভাইরাসের কিছু একটা নমুনা শনাক্ত করার পর মেডিকেল জার্নালে সেসব তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। তখন চেষ্টা চলে সেই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করার কলা-কৌশল। এক পর্যায়ে তাতে কৃতকার্যও হয়। কিন্তু ততক্ষণে সে ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীগণ অন্য কোন নতুন রোগে ভুগতে  থাকে। এভাবেই চলে নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব, নতুন প্যাথলজি আর তার চিকিৎসা। প্রকৃত সত্য কী তা মানুষ আজও জানতে পারছে না বা জানতে দেওয়া হচ্ছে না। এভাবেই চলছে। এর শেষ নেই। মানুষেরও কষ্টের শেষ নেই।

আগে অনেক বছর পর পর নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব হতো আর বর্তমানে ৩-৪ বছরে বা তারও কম সময়ে নতুন রোগের সৃষ্টি হয়ে চলেছে। এগুলি হচ্ছে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের কারণে। তাই, আজ চিকিৎসা বিজ্ঞান ক্রমাবনতির শীর্ষবিন্দুতে অবস্থান করছে। সার্জারি ছাড়া অ্যালোপ্যাথি সাধারণ মানুষের কাছে গুরুত্ব হারিয়েছে। 

জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশেষ করে অ্যালোপ্যাথিতে চরম উন্নত পশ্চিমা দুনিয়া আজ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। তারাও করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত হওয়ার কোন পথ খুঁজে পাচ্ছে না। অকাতরে মানুষ মারা যাচ্ছে, প্রতিকারের কোন বিধান নেই।

হোমিওপ্যাথির মতে কোনও প্যাথোজেন, কোন জীবাণু, কোনও ব্যাকটেরিয়া বা কোনও ভাইরাস আমাদের নি:শর্তে আক্রমণ করতে পারে না। আমাদের প্রাণশক্তির কোথাও কোনও দূর্বলতা থাকলেই কেবল আক্রমণ করতে পারে। জীবনীশক্তি অদৃশ্য। এটি আমাদের মনের স্থুল অংশ যা মস্তিস্ক, স্নায়ুতন্ত্র এবং হরমোনের সাথে যুক্ত হয়ে বাহ্যিক জগতের সাথে আমাদের ইন্দ্রিয়ের অঙ্গগুলিকে সংযুক্ত করে এবং সমস্ত আভ্যন্তরীণ কার্য সম্পাদন করে। 

যদি আমরা ভয়ংকর জটিলতায় ভুগি তখন অ্যাড্রিনালিনের পরিমান বেড়ে যায়, অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। জীবনীশক্তিও দূর্বল হয়ে যায়। ফলে উদ্বেগ, হতাশা, পেটের আলসার, রক্তচাপ, থাইরয়েড সমস্যা, মাসিক সমস্যা, লিউকোরিয়া, মুখের আলসার, হৃদরোগ, নিউমোনিয়া, অ্যাপেন্ডিসাইটিস, ডায়াবেটিস, হাঁপানি, পাগলামী এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। চুড়ান্ত পর্যায়ে মন শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেলে মৃত্যুও হতে পারে। তাই প্রতিটি রোগ সে যাই হোক না কেন বিভিন্ন উপসর্গ অর্থাৎ লক্ষ্মণ দ্বারা নিজেকে প্রকাশ করে। এই লক্ষ্মণগুলি রোগীর প্রবণতা অনুযায়ি ভিন্ন ভিন্ন হয়। 

রোগীর প্রবণতা অনুযায়ি তার কোষের মাইটোকনড্রিয়ার ডিএনএ (এমটি ডিএনএ) গঠিত হয়। আবার এমটি ডিএনএ’র পরিবর্তন হলে রোগীর প্রবণতাতেও পরিবর্তন হয়। রোগ লক্ষ্মণ চাপা পড়লে অর্থাৎ লক্ষ্মণের পরিবর্তন হলে এমটি ডিএনএ’রও গঠনগত পরিবর্তন হয়। সুতরাং লক্ষ্মণ এবং এমটি ডিএনএ’র গঠন পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত।

হোমিওপ্যাথিতে রোগীর লক্ষ্মণ অনুযায়ি চিকিৎসা দেওয়া হয কারণ এখন  পর্যন্ত  এমটি ডিএনএ’র প্যাথলজি উন্নত হয়নি। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে,  এমটি ডিএনএ’র প্যাথলজি ছাড়াই হোমিওপ্যাথগণ সফলভাবে রোগীর চিকিৎসা করে আসছেন। এক্ষেত্রে সাধারণ প্যাথলজির কোন প্রয়োজন হয় না। যখন এমটি ডিএনএ সংক্রান্ত প্যাথলজি বিকাশ ঘটবে তখন হোমিওপ্যাথি আর নব উদ্ভাবিত প্যাথলজির মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠবে। কিন্তু এই মুহুর্তে হোমিওপ্যাথি পৃথিবীর যে কোন চিকিৎসা পদ্ধতির চেয়ে অনেক উন্নত। 

অন্যান্য অসুস্থ ব্যাক্তিদের মতো করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদেরও হোমিও ওষুধ প্রয়োগে সফলভাবে চিকিৎসা করা যেতে পারে। কিন্তু করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা যেভাবে চলছে তাতে অ্যালোপ্যাথি ভিন্ন অন্য কোন চিকিৎসকের পক্ষে বিশেষ করে হোমিওচিকিৎসকদের সেখানে পৌঁছে চিকিৎসা দেওয়ার অধিকারই নেই। কারণ, অ্যালোপ্যাথরা হোমিওপ্যাথদের চিকিৎসক মনে করেন না। 

তবে সুযোগ পেলে দেখা যেতো হোমিওপ্যাথি প্রকৃতই কার্যকরী কী না? এর কার্যকারিতা না থাকলে হোমিওপ্যাথিকে উচ্ছেদ করে দেওয়া উচিত। 

কাজেই, এই মহামারিতে রোগীর আরোগ্যবিধানে হোমিওপ্যাথদের এক মহান দায়িত্ব পালন করার সুযোগ দেওয়ার জন্যে সরকারের নিকট আবেদন করছি।

করোনায় আক্রান্ত রোগীর সম্ভাব্য ওষুধগুলি হচ্ছে - অ্যাকোনাইট ন্যাপিলাস, অ্যাপিস মেল, আর্সেনিক এলবাম, এন্টিম টার্ট, এন্টিম ক্রুড, বেলেডুনা, ব্রাইয়োনিয়া এলবা, কার্বো ভেজ, জেলসিমিয়াম, ইনফ্লুয়েঞ্জিনাম, লবিলা ইনফ্লেটা, অপিয়াম, ফসফরাস, সালফার, ভিরেট্রাম ভিরিডি।  

প্রতিশেধক হিসেবে: 

ভয়শুন্য হলে- জেলসিমিয়াম, ইনফ্লুয়েঞ্জিনাম, অপিয়াম।

ভীতু প্রকৃতির হলে- আর্সেনিক এল্বাম, একোনাইট, ফসফরাস ব্যবহার করা যেতে পারে। ওষুধের শক্তি হবে ০/১। তবে, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ প্রয়োগ করা উচিত নয়। মনে রাখতে হবে, একসঙ্গে একটিমাত্র ওষুধই প্রয়োগ হতে পারে।

খাদ্যের বিষয়ে শতর্ক থাকতে হবে। মাংস (দেশী মুরগি বাদে), ডিম, চিংড়ি, ইলিশ মাছ, মুশুর ডাল, তামাক-জর্দা-ধুমপান, বেল, তেলে ভাজা সমস্ত খাবার, কনফেকশনারি, কাঁচা পেঁয়াজ, কাঁচা রসুন, চিনি এবং কর্পূর এড়ানো উচিত।

টক দই এবং পেঁপে প্রতিদিন সকালে ও দুপুরে নিয়মিত খেতে হবে। কখনই শসা, শাক, পাকা কলা, দই, পেঁপে সন্ধায় বা রাতে খাওয়া যাবে না। রাতের খাবার ৯ টার মধ্যে শেষ করা উত্তম। তাজা টমেটো, শাক ও তাজা শসা ডায়রিয়া বা আমাশয় থাকলে এড়িয়ে চলা উচিত। এসিডিটি থাকলে কুসুম গরম পানিতে লেবু সামান্য একটু লবণ মিশ্রিত করে দিনে ৫-৬ বার সেবন করলে উপকার পাওয়া যাবে। টক জাতীয় ফল প্রতিদিন কিছু হলেও খাওয়া উচিত। মাংস, ডিম, চিংড়ি, ইলিশমাছ, মুশুর ডাল, তামাক-জর্দা-ধুমপান, কনফেকশনারী, চিনি এগুলি সাধারণ সর্দি-কাশিতেই এড়িয়ে চলা উচিত, করোনার জন্য তো অবশ্যই এড়িয়ে চলা উচিত। 

করোনাভাইরাসের হুমকি পরিবারের মানুষকে একত্র করেছে ব্যাক্তিগত সুরক্ষা বজায় রেখে। সাধারণ প্যাথলজি ভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি ও যুদ্ধাস্ত্রের ব্যর্থতা বোঝার জন্য এই হুমকি একটি পাঠ। এটি মোহগ্রস্ত মানুষকে সামুহিক মানসিক গভীর তন্দ্রাভাব থেকে জাগ্রত করবে। আমাদের মনের সচেতনতা বাড়াবে। সাধারণ মানুষ আরও যৌক্তিক হয়ে উঠবে। তারা ব্যায়বহুল চিকিৎসা পদ্ধতির দিশেহারা করুণ অবস্থা দেখে হতাশ হয়েছে। কম খরচে এবং প্রকৃত আরোগ্য চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি আকৃষ্ট হবে। আর সেই পদ্ধটি হবে হোমিওপ্যাথি কারণ এটি আমাদের মনকে শক্তিশালী করে। ফলে, আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। মানুষ এটাই চায় যা অ্যালোপ্যাথি দিতে পারে নাই। 

সুতরাং, চুড়ান্তভাবে হোমিওপ্যাথি একটি নিরাময়ের চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে এগিয়ে আসবে যদিও বেশীরভাগ বিজ্ঞানীই হোমিওপ্যাথির বিপক্ষে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই বাধাই হবে হোমিওপ্যাথির অগ্রযাত্রার পাথেয়। সাধারণ মানুষ যখন অ্যালোপ্যাথি থেকে ত্রাণ পাবে না তখন তারা হোমিওপ্যাথির প্রতি আকৃষ্ট হবেই। এটা কেউ রদ করতে পারবে না। তারা অ্যালোপ্যাথিকে ভয় করবে এবং হোমিওপ্যাথির আওতায় আশ্রয় নিবে কারণ হোমিওপ্যাথিতে অসুস্থ ব্যাক্তির সঠিক চিকিৎসা পাওয়া যায়। এমনকি  চরম বিপদের দিনেও তাদের সুরক্ষা দিতে পারে। 

তাই, হে মানুষ, আপনারা সচেতন হোন, নির্ভিক হোন, সুস্থ থাকুন এবং করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করুন। আপনাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। জয় আপনাদের হবেই।

লেখক: প্রফেসর ড. পরেশ চন্দ্র মোদক

কৃষি পরিসংখ্যান বিভাগ

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

ইমেইল: [email protected]