ন্যাভিগেশন মেনু

৭ ডিসেম্বর

এদিন দেশের বিভিন্ন জেলা পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়


বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসের ব্যাপক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর একটি ঐতিহাসিক দিন। আগেই ভারতীয় সেনা বাহিনী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত ‘মিত্রবাহিনী’র যৌথ আক্রমণে এদিনই কোন ঠাসা হয়ে পড়ে পাকিস্তানের দখলদার বাহিনী। এদিন বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়।

৭ ডিসেম্বর ইতিহাসের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে মিত্রবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা শেরপুর অঞ্চলকে শত্রু মুক্ত করেন। মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জগজিৎ সিং অরোরা হেলিকাপ্টারযোগে আসেন শেরপুর মহকুমায় ( বর্তমানে জেলা)। জগজিৎ সিং অরোরা  স্থানীয় শহীদ দারোগ আলী পৌর পার্ক মাঠে এক সংবর্ধনা সভায় শেরপুরকে মুক্ত বলে ঘোষণা দেন।

এ সময় মুক্ত শেরপুরে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এখানে দাঁড়িয়েই তিনি বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, মস্কো, আকাশবাণীসহ বিভিন্ন বেতার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আগামী ৭ দিনের মধ্যে ঢাকা মুক্ত করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন।

ঢাকা মুক্ত হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর। এসময় মিত্র বাহিনীর প্রধানকে শেরপুরের বিশিষ্ট নাগরিক মোহাম্মদ আলী মিয়া, ডাক্তার জামান, খন্দকার মজিবুর রহমান, মোজাম্মেল হক, পন্ডিত ফসিহুর রহমান প্রমুখ সংবর্ধনা দেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাসে বর্তমান শেরপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ৩০ থেকে ৪০টি খণ্ডযুদ্ধ সংগঠিত হয়। এসব যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে ৫৯ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। পাক হানাদার বাহিনীর নির্মমতার শিকার হয়ে নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে ১৮৭ জন, শেরপুর সদর উপজেলার সূর্যদী গ্রামে ৫২ জন, ঝিনাইগাতী উপজেলার জগৎপুর গ্রামে ২০ জন মুক্তিকামী মানুষ শহীদ হয়েছেন।

৪ ডিসেম্বর কামালপুরের ১১নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের মুহূমুর্হূ আক্রমণ ও গুলি বর্ষণের মুখে স্থানীয় পাকসেনারা পিছু হটে। ৫ ডিসেম্বর থেকে পাকসেনারা তল্পিতল্পা বেঁধে কামালপুর-বক্সিগঞ্জ থেকে শেরপুরের শ্রীবর্দী উপজেলা হয়ে শেরপুর শহর হয়ে জামালপুর অভিমুখে রওনা হয়।

অবশেষে পাকসেনারা ৬ ডিসেম্বর রাতের আঁধারে শেরপুর শহরের উপর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে জামালপুর পিটিআই ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। এরপর ৭ ডিসেম্বর মুক্ত হয় শেরপুর। 

স্বাধীনতা যুদ্ধের সুতিকাগার বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী চুয়াডাঙ্গা। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে চুয়াডাঙ্গা শত্রুমুক্ত করেন বাংলার মুক্তিসেনারা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাতে হানাদার বাহিনীর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞের পরই চুয়াডাঙ্গার হাজার হাজার মুক্তিপাগল দামাল ছেলেরা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন এলাকা থেকে আনসার, মুজাহিদ ও স্বেচ্ছা সেবকদের শহরের শ্রীমন্ত টাউন হলে একত্রিত করে চুয়াডাঙ্গা ট্রেজারি থেকে সকল অস্ত্র ও গোলাবারুদ তাদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা মজবুত করা হয়।

এদিকে, চুয়াডাঙ্গা শত্রুমুক্ত থাকার খবর শুনে আওয়ামী লীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ভারত গমনের উদ্দেশে একমাত্র সঙ্গী ব্যারিস্টার অমীর-উল-ইসলামকে নিয়ে ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গায় আসেন।

এসময় তিনি স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে আলেচনায় সার্বিক পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে চুয়াডাঙ্গাকে যুদ্ধকালীন সময়ের জন্য বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই সীমান্তবর্তী চুয়াডাঙ্গা জেলা মুক্ত থাকার সুবাদে ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ায় চুয়াডাঙ্গাই হয়ে ওঠে বাংলাদেশের রণাঙ্গনের অন্যতম যুদ্ধাঞ্চল।

এদিন মুক্ত হয় মাগুরা জেলা। এর একদিন আগে ৬ ডিসেম্বর মুক্ত হয় যশোহর জেলা।জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয় তৎকালীন মহকুমা শহর মাগুরা। উড়তে থাকে স্বাধীন দেশের মানচিত্র খচিত পতাকা। ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সারাদেশের ন্যায় মাগুরার সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

শহরের নোমানী ময়দানে ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর সঙ্গে প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে তোলে। এক পর্যায়ে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাক সেনারা মাগুরার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দখলে নিলে মুক্তিযোদ্ধারা শহর ছেড়ে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

মাগুরা শহরের পিটিআই, ওয়াপদা ভবন, জেলা পরিষদ বাংলো, আনছার ক্যাম্প, দত্ত বিল্ডিং দখল করে পাকসেনারা ঘাঁটি স্থাপন করে। পরবর্তী স্থানীয় রাজাকার, আলবদরদের সহযোগীতায় তারা মুক্তিকামী মাগুরাবাসীদের ধরে এনে অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।

অসংখ্য মুক্তিকামী মাগুরাবাসীকে হত্যার করে তারা নবগঙ্গা নদীর ঢাকা রোড ব্রিজ ও বর্তমান পল্লীবিদ্যুৎ অফিসের পাশে পারনান্দুয়ালী ক্যানেলে মরদেহ ফেলে দেয়। ৬ ডিসেম্বর আকাশ পথে মিত্র বাহিনীর বিমান হামলা এবং স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের মুখে পাকসেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে।

৭ ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী মাগুরা শহরে প্রবেশ করে পাকবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্প ও গোলা বারুদ দখল করে নেয়। প্রাণ ভয়ে পাকবাহিনী মাগুরা জেলা ছেড়ে পার্শ্ববর্তী কামারখালী হয়ে ফরিদপুরের দিকে চলে যায়। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধাবাসী পায় মুক্তির স্বাদ।

৪ ডিসেম্বর মুক্ত হয় গাইবান্ধার ফুলছড়ি থানা। ৬ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় সুন্দরগঞ্জ। একে একে মুক্ত হয় সাদুল্যাপুর, সাঘাটা ও পলাশবাড়ি থানা।  ১৯৭১ এর এই দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রিমূখী আক্রমনের মুখে দখলদার পাকবাহিনী সাতক্ষীরা জেলা ছাড়তে বাধ্য হয়।

ঐ দিন বীরের বেশে এই মাটির সন্তানরা বাংলাদেশের অর্জিত লাল সবুজের পতাকা কাধে নিযে স্বগৌরবে সাতক্ষীরায় বাংলার পতাকা উত্তলোন করে।  ১৯৭১ সালের এইদিনে শত্রুমুক্ত হয় নোয়াখালী জেলা। মুক্তিসেনারা

একাত্তর সালের এইদিন জেলা শহর মাইজদীতে রাজাকারদের প্রধান ঘাঁটির পতন ঘটিয়ে নোয়াখালীর মাটিতে উড়িয়ে ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় পতাকা।

ভারতের ৩৮০ জন সৈন্যকে সম্মাননা: বাংলাদেশ সরকার একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভারতের ৩৮০ জন সৈন্যকে সম্মাননা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানিয়েন বিদেশমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।

শুক্রবার রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বাংলাদেশকে ভারতের কূটনৈতিক স্বীকৃতির ৪৮তম বার্ষিকী উপলক্ষে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, পর্যায়ক্রমে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে সেদেশের সকল শহীদদের সম্মাননা দেবে সরকার।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক অটুট রয়েছে। ভবিষ্যতে এ সম্পর্ক আরও নিবিড় হবে। চক্রান্তকারীরা এ সম্পর্ক বিনষ্ট করতে পারবে না।মন্ত্রী আরও বলেন, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত আমাদের এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল। যুদ্ধের জন্য আমাদের সংগ্রামী জনতাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

এ যুদ্ধে ভারত অংশ নিয়েছিল। যুদ্ধে ভারতের প্রায় ১৭ হাজার সৈন্য শহীদ হয়েছিল, অনেকে আহত হয়, এটি ভোলার নয়। বাংলাদেশ ও ভারতের সৈন্যদের কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজিত হয়।

ভারতীয় হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলী বলেন, একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি হয়। সোনালি অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে দু’দেশের সম্পর্ক তৈরি হয়। এ সম্পর্ক অটুট থাকবে।

ওআ/ এস  এস