ন্যাভিগেশন মেনু

করোনায় আক্রান্ত ডা. নুজহাত চৌধুরীর আবেগঘন স্ট্যাটাস


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) লিভার বিভাগের প্রধান ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল ও তার স্ত্রী ডা. নুজহাত চৌধুরী এবং তাদের ১৪ বছরের অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে সূর্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

বুধবার (১৭ জুন)  দুপুরে  ডা. মামুন আল মাহতাব আজকের বাংলাদেশ পোস্টকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন ডা. নুজহাত চৌধুরী। আজকের বাংলাদেশ পোস্ট পাঠকদের জন্য তা হুবহু তুলে ধরা হলো।

তিনি লিখেছেন- আমার ছেলেটা হবার সময় অপারেশন টেবিলে কিছু একটা সমস্যা হয়েছিল। আমার মনে আছে হঠাৎ তীব্র ব্যথা বুকে শুরু হলো, এত তীব্র যে আমি দম নিতে পারছিলাম না। মনে হল কেউ যেন হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে আমার হৃদপিন্ডকে - সে চলতে পারছে না। আমি শুনতে পারছিলাম মনিটরের ছন্দময় ‘টি .. টি..’ শব্দ পরিবর্তন হয়ে দ্রুত বাজতে শুরু করলো তারস্বরে ‘- টিটিটিটি’।  শুনতে পেলাম আমার ডাক্তার চিৎকার করে বলছেন ‘অক্সিজেন আনো, অক্সিজেন আনো’। দেখলাম আমার স্পাইনাল এ্যানাসথেশিয়া যিনি দিচ্ছিলেন তিনি জোরে জোরে আমার গালে বাড়ি দিচ্ছিলেন আর বলছিলেন ‘শম্পা দেখি তাকাও, তাকাও।

জেগে থাকো, শম্পা শম্পা ..।’ আমার চোখটা তার মুখের উপর স্থির হল, দেখলাম তিনি দরদর করে ঘামছেন, তার কপালের ঘাম বড় বড় ফোঁটা হয়ে গড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ সবকিছু স্থির হয়ে গেল। আমার এ্যনাস্হেশিয়ার ডাক্তারের ‘শম্পা শম্পা’ ডাক, মনিটরের টিটিটি শব্দ, ওটির হৈচৈ, চিৎকার সব ধীরে ধীরে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যেতে লাগলো। আমি যেন দূর থেকে সব শুনতে পারছিলাম। ধীরে ধীরে সব শান্ত হয়ে গেল, আমার আর কোন ব্যথা ছিল না। কী এক অদ্ভুত স্তব্ধ স্থিত অবস্থা, সব শান্ত, কী যে শান্তি! আমি বুঝতে পারলাম আমি সিঙ্ক করে যাচ্ছি, আমার আল্লাহর কাছে যাবার সময় এসেছে।আমি যেতে প্রস্তুত বোধ করলাম।

আমি আমার স্রষ্টার কাছে নিজেকে সমর্পণ করার জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত বোধ করলাম। কোন পিছুটান বোধ করলাম না। আমার মেয়েটা এই গল্প শুনলে একটু দুঃখ পায়। কারণ মেয়েটার বয়স তখন সাড়ে ছয় বছর। জানি না, হয়ত মনের গভীরে জানতাম তার একটা খুব যত্নশীল বাবা আছে, তাই হয়ত তাকে নিয়ে আমার দু:চিন্তা হয় নি। অথবা হয়ত যাবার সময়টাই এমন। শুধু তুমি আর তোমার স্রষ্টার বন্ধন। জানি না। এসব কিছুই আমার মনে আসে নাই তখন। শুধু মনে হয়ে ছিল যে আমার আল্লাহর কাছে যাবার ডাক এসেছে। And I was so ready to go! I was so ready to go and submit myself to my Lord. শুধু শেষ একটা মিনতি ছিল আল্লাহর কাছে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার গর্ভের সন্তানটি তখনও বের হয়নি। যাবার আগে আমি আমার জীবনের শেষ প্রার্থনা করলাম আল্লাহর কাছে, “আল্লাহ, শুধু আমার বেবীটা আউট হতে দাও”।এখন ভাবলে একটু হাসিও পায়। শেষ দোয়াটাও বাংলা, ইংলিশ আর ডাক্তারী শব্দ মিলিয়েই করেছি! আবার ভাবি, মা কী জিনিষ!

নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও সন্তানের জীবন ভিক্ষা করে সে! এই প্রার্থনার পরে কিছুক্ষণ সব নিস্তব্ধ। এরপরে আর কিছু মনে নেই আমার।আমার ছেলের প্রথম কান্না আমি শুনি নাই অথবা শুনলেও মনে পড়ে না। গত রবিবার আমার COVID-19 -এর PCR test রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। তার একদিন আগে স্বপ্নীল সংক্রমিত হয়, আমাদের বিশ্বাস তার আশেপাশের কিছু মানুষের অসচেতনতার কারণে। করোনা সংক্রমণে খুব কম শতাংশ মানুষই মৃত্যু মুখে পতিত হয়। কিন্তু কিছু মানুষ কেন যে হঠাৎ করে খারাপ অবস্থায় চলে যাচ্ছেন তার সঠিক ব্যাখ্যা ডাক্তাররাও শতভাগ আস্থার সাথে দিতে পারছেন না। আমার সমস্ত জীবন-মৃত্যুর চিন্তার সাথে কিভাবে যেন আমার ছেলেটা জড়িয়ে যায়। সূর্য খুব আমার গা-ঘেষা ছেলে। ওর বয়স এখন ১৪ বছর। এখনও সারাক্ষণ গা ঘেঁষেই থাকে। হয়ত ভুল বললাম। এখন আমিই সারাক্ষণ ওর গা ঘেঁষে থাকি। ১৪ বছরের অভ্যাস এই মহামারীতেও ত্যাগ করতে পারি নাই। এই ভুলেই হয়ত আজ আমার ছেলেটাও করোনা পজিটিভ হয়ে গেছে। এই একটাই আমার দু:খ।হয়ত ডাক্তারের সন্তান হবার মাশুল দিচ্ছে সূর্য। বিশেষ করে যেদিন আমি ও সূর্য করোনা পজিটিভ হবার সংবাদ পেলাম সেদিনই শুনলাম একজন প্রবীণ চিকিৎসককে পিটিয়ে হত্যা করেছে রোগীর স্বজন।সেই খবর শুনে আমার রোগাক্রান্ত ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার মা হিসেবে খুব দু:খ হয়েছে।আপনাদের সকলকে আস্বস্ত করার জন্য জানাচ্ছি, আমাদের কারো কোন উপসর্গ নাই। আমি ও স্বপ্নীল আপনাদের দোয়া ও ভালবাসায় অভিভূত। এত মানুষ তাদের শুভকামনা জানিয়েছেন, সবাইকে ধন্যবাদটুকু দেবার সুযোগ হয়নি। তবে জানবেন ফোন, ফেস বুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ অথবা পরিবারের সদস্যদের কাছে - যারা যেভাবে দোয়া ও শুভকামনা জানিয়েছেন - এসবই আমাদের গভীরভাবে কৃতজ্ঞ ও আপ্লুত করেছে। কাকরাইল মসজিদে দোয়া হয়েছে, নন্দন কানন বৌদ্ধ বিহারে প্রার্থনা হয়েছে।পূজা মন্ডপে পূজা হয়েছে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সকলে যার যার মত করে শুভাশীষ পাঠিয়েছেন। এতিমখানায় দোয়া হয়েছে, আমার দেশের বাড়ী খয়েরপুরের মানুষ অনেকে আমাকে হয়ত দেখেনই নাই কোন দিন। অথচ, তারা আজ পবিত্র জুম্মার দিন মসজিদে দোয়া করেছেন।

আমরা কাউকে কিছু বলিনি, মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়ে করছেন। রোগীরা স্মরণ করছেন। কেউ আমাকে বলেছেন যে, আপনি আমার সন্তানের চোখের দৃষ্টি রক্ষা করেছেন, আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করবেন। স্বপ্নীলের রোগীরা কাঁদছেন, বলছেন আমাদের বেঁচে থাকার জন্য হলেও আল্লাহ আপনাকে সুস্থ করে দিন।আমার মা-বোন বলছেন, বিগত ৩৫-৪০ বছর যোগাযোগ নাই এমন মানুষও তাদের ফোন করছেন।এত মানুষের ভালবাসা!! এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে। আপনাদের সকলের প্রতি আমার গভীর কৃতজ্ঞতা ও আপনাদের সবার জন্য আমার অপার ভালবাসা। আল্লাহ আপনাদের সবার মঙ্গল করুন।এবারের এই বিশ্ব যুদ্ধে অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে সন্মুখ সারির যোদ্ধা ডাক্তাররা। আমি বা স্বপ্নীল ডাক্তার হিসেবে সেই সেবায় যুক্ত ছিলাম যার যার ক্ষেত্রে - এটাই পরিতৃপ্তি, এটাই সন্তুষ্টি। যদি সুস্থ হয়ে ফিরে আসি- আবার একইভাবে আপনাদের সেবা করবো আশাকরি, ইনশাআল্লাহ। সবার জন্য শুভকামনা। দোয়া করবেন আমাদের জন্য, বিশেষ করে আমার বাচ্চাটার জন্য।

ওআ/