ন্যাভিগেশন মেনু

করোনা পজেটিভ থেকে এখন তারা নেগেটিভ


বিশ্বব্যাপী করোনা তাণ্ডব চলছে। প্রাকৃতিক নাকি মানুষের তৈরী জীবাণু অস্ত্র সেটা নিয়েও যুক্তি-পাল্টাযুক্তি চলছে। আমাদের দেশেও করোনার কারণে এক মাসের অধিক সময় ধরে সাধারণ ছুটি চলছে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। সব জায়গায় বাড়তি সতর্কতা। আমাদের দেশে যারা করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়েছিলেন, অনেকেই সুস্থ হয়ে গেছেন। অর্থাৎ পজিটিভ থেকে নেগেটিভ হয়েছেন। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। করোনা পজেটিভ থাকার সময় কিভাবে তারা আইসোলেশনে থেকেছেন, কিভাবে নিয়ম মেনে চলেছেন কিংবা যেসব ওষুধ খেয়েছেন ইত্যাদি। এই বিষয়গুলো আমাদেরও জানা দরকার, কারণে এতে করে সকলেই সচেতন হতে পারবেন। মনের মাঝে লুকিয়ে থাকা ভয়ও কিছুটা দূর হবে।

আজিজুর রহমান, খুলনাঃ অবসরপ্রাপ্ত এই ব্যাংক কর্মকর্তার জ্বর, কাশি ছিল। কিন্তু গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট ছিল না। ১৩ এপ্রিল তিনি নমুনা পরীক্ষা করতে দেন এবং ১৪ এপ্রিল তার করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়।

করোনা পজিটিভ শনাক্ত হওয়ার পর খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে বাসায় আইসোলেশনে থাকার পরামর্শ দেন এবংওষুধ লিখে দেন। তিনি প্রতিদিন সকালে ও রাতে একটি করে অ্যান্টিবায়োটিক জি ম্যাক্স এবং তিন বেলা তিনটি নাপা, কোনো কোনোদিন ৪টি নাপাও খেয়েছেন। এছাড়া যথারীতি ডায়াবেটিস ও প্রেসারের ওষুধ খেতেন। দিনে ২/৩ বার গরম পানির ভেপ নাকে-মুখে টানতেন। গরম পানির ভাপ নিলে তখন কাশি কমে যেতো, শরীরও ভালো লাগত।

পরিবারের সদস্যদের তার রুমের মধ্যে আসা বারণ ছিল। একটি আলাদা একটি কক্ষে থাকতেন। ৬ ফুট দূরত্বে থেকে পরিবারের সদস্যরা খাবার দিতেন। প্লেট-গ্লাসও কাউকে ধরতে দিতেন না। গত ২০ এপ্রিল এবং ২২ এপ্রিল দুই দফায় নমুনা পরীক্ষার পর ফলাফল করোনা নেগেটিভ আসে।

আহসান হাবিব,বগুড়াঃ পুলিশ কনস্টেবল আহসান হাবিব ১৩ এপ্রিল আদমদীঘি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নমুনা পরীক্ষা করান এবং তিন দিন পর ১৬ এপ্রিল করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে। এরপরই তাকে বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি করা হয়।

আহসান হাবিব বলেন, ‘যেহেতু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই আমার জ্বর ছিল, তাই আগের চিকিৎসকের দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ি আমি ডোকোপা (ডক্সোফাইলিন), ফেনাডিন (ফেক্সোফেনাডিন), নাপা (প্যারাসিটামল) ও গ্যাসট্রিকের ওষুধ খেয়েছি। এগুলো শেষ হলে হাসপাতাল থেকে দেওয়া ওষুধগুলো খেয়েছি। তা ছাড়া হাসপাতালে অ্যাজিথ্রোমাইসিন (জিম্যাক্স), মন্টিলুকাস্ট (মন্টিকাশ), প্যারাসিটামল ও গ্যাসট্রিকর ওষুধ সেবন করতে দেওয়া হয়েছিল।’

তিনি আরও বলেন, করোনাভাইরাস আক্রান্ত হলে কোনোভাবেই আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। বরং মনে সাহস রেখে চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত গরম পানি খেতে হবে। গরম পানির সঙ্গে লবণ মিশিয়ে ঘন ঘন কুলকুচি করতে হবে।

পরবর্তীতে ২১ এবং ২৩ এপ্রিল আবারও আহসান হাবিবের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পর পর দুটি পরীক্ষায় ফলাফল নেগেটিভ আসায় তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়।

ডা. জাহিদুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জঃ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলামের নমুনা ৬ এপ্রিল সংগ্রহের পর ৮ এপ্রিল ফলাফল করোনা পজিটিভ আসে।

ডা. জাহিদের মতে, আমি আক্রান্ত হবার পরও অনেকটা সুস্থ ছিলাম। তবে প্রায় সব উপসর্গই ছিল না। বাড়িতে আইসোলেশনে থেকেই আমি সুস্থ হয়েছি। আমার পরিবারের কিংবা কারও সংস্পর্শেই আইসোলেশনে থাকা অবস্থায় যাইনি। আমার করোনার সব উপসর্গ, যেমন- জ্বর, খুসখুসে কাশি, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, পেট খারাপ, সবই ছিল। শুধু গলাব্যথা ছিল না। এসব উপসর্গ নিয়েই আমি একা আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা চালিয়ে গেছি। আমি জ্বরের নিয়মিত ওষুধ সেবন করেছি। বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ও পেট খারাপের ওষুধ সেবন করেছি। অ্যান্টিবায়োটিকও গ্রহণ করেছি। আমি প্রতিদিন গোসল করেছি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থেকেছি। গরম পানি পান করেছি। এবং আদা খেয়েছি।

পরবর্তীতে ১৮ এপ্রিল ও ২০ এপ্রিল দুইবার তার নমুনা সংগ্রহ করা হলে দুটিতেই করোনা নেগেটিভ ফলাফল আসে।

শাহ আলম, বগুড়াঃ ২৯ মার্চ ঢাকা থেকে ট্রাকে করে রংপুর যাচ্ছিলেন দিনমজুর শাহ আলম। পথে তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আতঙ্কিত হয়ে ট্রাকে থাকা অন্য যাত্রীরা তাকে জোর করে বগুড়ার মহাস্থানগড়ে নামিয়ে দেন। কয়েকটি হাসপাতালের পর তাকে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১ এপ্রিল এবং ৫ এপ্রিল শাহ আলমের নমুনা পজিটিভ আসে।

এবং সেখানে পরীক্ষা করার পর করোনা পজেটিভ ধরা পড়ে। শাহ আলমের কভিড-১৯ এর সব ধরনের উপসর্গই ছিল। এর মধ্যে শ্বাসকষ্ট বেশি ছিল। 

শাহ আলম বলেন, প্রথম পাঁচদিন আমার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। দুই-তিনদিন কিছুই খেতে ইচ্ছা করেনি। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে রুচি ফেরে।

শারীরিক অবস্থা উন্নতি হলে ১৩ এপ্রিল শাহ আলমের নমুনা রাজশাহীতে পাঠানো হয় এবং নেগেটিভ ফলাফল আসে। ২১ এপ্রিল নমুনা পুণরায় রাজশাহী এবং ২২ এপ্রিল বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেলে পাঠানো হয়। এবারও ফলাফল নেগেটিভ আসে। বর্তমানে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ।

মুন্সিগঞ্জে ৭০ বছরের বৃদ্ধাও করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন। এখানে মনের জোরটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে করোনাকালের এই সময়ে কিছু অমানবিক বিষয় সকলকে ব্যথিত করেছে। আমি নিজেই অনেক বাড়িওয়ালার মুখে শুনেছি, খুব গর্ব করে বলে আমার তিন তলায় অমুক নিউরোলজিস্ট থাকে, আমার পাঁচ তালায় অমুক শিশু বিশেষজ্ঞ থাকে। তাদের কোথাও সিরিয়াল দেয়া লাগে না। এই করোনাকালের সময় সেই ডাক্তাররা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের সেবা দিচ্ছে। প্রত্যেকটা বাড়িওয়ালার উচিত ছিল, এই সময়ে ডাক্তারদের নিয়ে আরও বেশি গর্ববোধ করা। অথচ অনেকেই এখন ডাক্তার, নার্সদের বাসা ছেড়ে দিতে বলছেন। এখন যদি কোন বাড়িওয়ালা করোনায় আক্রান্ত হয়, তাহলে তিনি চিকিৎসার জন্য কোথায় যাবেন, কার কাছে যাবেন?

করোনাভাইরাস আক্রান্ত হবার পর অনেকেই এলাকাবাসী দ্বারা বিভিন্ন রকম অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন। সারাবছর একসাথে থেকেও এখন ভিন্নরূপ। যে ডাক্তার সবাইকে সেবা দিতে দিতে নিজে আক্রান্ত হলো, এখন সেই ডাক্তারের বাড়িতে এলাকার মানুষ ঢিল মারে কারণ ডাক্তার করোনা পজেটিভ। এতটা অমানবিক, কান্ডজ্ঞানহীন মানুষ কিভাবে হয়?

বিপদের সময় সবাই একসাথে থাকতে হয়। আর করোনা পরীক্ষা করলে যে কারো পজিটিভ আসতে পারে। আশিভাগ মানুষের তো কোন লক্ষণই প্রকাশ পায় না। এমনিতেই সেরে যায়। তাই অন্যকে নিয়ে আক্রমণাত্মক হবেন না। মানবিক হোন, মনে সাহস রাখুন। ইনশাআল্লাহ সকল বিপদ কেটে যাবে।

লেখকঃ রিয়াজুল হক, যুগ্ম-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।