ন্যাভিগেশন মেনু

কুকুর প্রজাতি ইশারায় কাফি


হাত থেকে রুটি কিংবা অন্য যে কোনো খাবার ফেলে দিয়ে ইশারা করলেই লেজ নাড়তে নাড়তে একেবারেই অচেনা কুকুরটি বুঝে যায়, আপনি কী বোঝানোর চেষ্টা করছেন।

অথচ, কুকুরটির চোখে চোখ রাখেননি আপনি, তাকে ‘আ আ চুক চুক’ করে ডাকেনওনি। কুকুরটি আগে আপনাকে দেখেনি। আপনিও তাকে দেখেননি এর আগে।

সে কারণে প্রশিক্ষণ দেওয়া তো দূরের কথা। শুধু আঙুলের ইশারা করেছিলেন। অচেনা কুকুরটি বুঝে গেল আপনার ইশারা, ইঙ্গিতের অর্থ। আমাদের সঙ্গে কুকুরের সম্পর্কের সমীকরণ, রসায়ন নিয়ে একটি অভিনব গবেষণায় এটাই দেখালেন ভারতের যাদবপুরের অনিন্দিতা।

মোহনপুরের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার), কলকাতা’-র অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর অনিন্দিতা ভদ্র। তার গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন সাইকোলজি’তে গত ১৭ জানুয়ারি।

গবেষকরা এই প্রথম দেখালেন, আমাদের না চিনে, না জেনেও মানুষের ইশারা, ইঙ্গিত বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না রাস্তার কুকুরদের।

আর সেগুলো তারা মনেও রাখতে পারে। যার অর্থ, আমাদের জটিল ইশারা, ইঙ্গিতগুলি বোঝার সহজাত ক্ষমতা রয়েছে কুকরদের।

যা এত দিন জানতে পারা যায়নি। কারণ, এযাবৎ সব গবেষণাই হয়েছে পোষা কুকুরদের নিয়ে। যাদের ট্রেনিং দেওয়া হয় আমাদের ইশারা, ইঙ্গিত রপ্ত করার জন্য।

তারা এও দেখালেন, আমাদের ইশারা, ইঙ্গিতে যদি তারা ঠকে যায় একবার, তাহলে আর সে পথ মাড়ায় না পরে। তখন আমাদের ইশারা, ইঙ্গিত দেখে, বুঝেও সে সব উপেক্ষা করে রাস্তার কুকুর। ঠকে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) একটি সমীক্ষার পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে রাস্তার কুকুরের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। তার সবটা রয়েছে উন্নয়নশীল ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোতে।

তার মধ্যে ভারতেই রয়েছে কম-বেশি তিন কোটি রাস্তার কুকুর। যাদের মানুষ ভয় পায়। মাঝেমধ্যে আক্রান্তও হয় অনেকে, যেনতেন প্রকারে তাদের হঠিয়ে দিতে চাওয়ার জেরে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। রাস্তার কুকুরের কামড়ে ভারতেই ফি-বছরে গড়ে মৃত্যু হয় অন্তত ২০ হাজার মানুষের। যাদের বেশির ভাগই শিশু।

সে কারণে রাস্তার কুকুরদের চেনা, বোঝাটা আমাদের খুবই দরকার। এটাও জানা দরকার, তারা আমাদের কতটা বোঝে। জানা দরকার, আমাদের ইশারা, ইঙ্গিত তারা কতটা বুঝতে পারে, তেমন কিছু শেখানো না হলেও।

 আর সেটা সম্ভব হলে নিজেদের বাঁচাতে আর রাস্তার কুকুর মারতে হবে না আমাদের। এঁটোকাঁটা, বিয়েবাড়ির ফেলে দেওয়া খাবারদাবার ছুঁড়ে দিতে গিয়ে আর রাস্তার কুকুরদের হাতে আমাদের আক্রান্ত হতে হবে না।

গবেষকের দাবি, এর ফলে মানুষ ও রাস্তার কুকুরের শান্তিতে সহাবস্থান সহজতর হবে।

অনিন্দিতা ও তার ছাত্রছাত্রীদের গবেষণাই প্রথম দেখাল, শুধু শেখাচ্ছি বলেই যে কুকুর শেখে, তা কিন্তু নয়। মানুষকে চেনার, বোঝার একটা সহজাত ক্ষমতা রয়েছে কুকুরের।

তাই একেবারেই অচেনা, অজানা একটি রাস্তার কুকুরও আমার, আপনার ইশারা, ইঙ্গিত চট করে বুঝে ফেলতে পারছে। কী বলতে চাইছি ইশারা, ইঙ্গিতে তা বোঝানোর জন্য রাস্তার কুকুরদের কিন্তু আলাদা ভাবে ‘ট্রেনিং’ দেওয়ার দরকার হচ্ছে না।

অনিন্দিতারা এও দেখালেন, আমাদের ফন্দিগুলির ফাঁদে পা দেওয়ার অভিজ্ঞতা থেকেও শিক্ষা নিতে পারে রাস্তার কুকুর। তাই তাদের দ্বিতীয় বার ‘বোকা’ বানানো যায় না। সে যে ঠকেছিল, সেটা মনে রাখতে পারে।

অনিন্দিতার কথায়, দেখেছি, আমাদের ইশারা, ইঙ্গিত বোঝার ক্ষমতা প্রাপ্তবয়স্ক রাস্তার কুকুরের থাকলেও সেই ইশারা মেনে তাদের এগনোর সম্ভাবনা কিন্তু ৫০ : ৫০।

একবার ইশারা মেনে একটা বাটির দিকে গিয়ে খাবার পেলে পরের বার তারা ইশারা মানে। কিন্তু ইশারা মেনে খাবার না পেলে পরের বার আর বিশ্বাস করে না সেই মানুষকে।

ইতিহাস বলছে, আমাদের (আদিম মানব ও আধুনিক মানুষ) সঙ্গে প্রায় ১৫ হাজার বছরের সম্পর্ক কুকুরের। বিবর্তনের পথে নেকড়ে থেকে বিশেষ একটি শাখা বেরিয়ে এসে কুকুর হওয়ার প্রায় পরপরই।

নেকড়ে থেকে কুকুর এসেছে মানুষের হাত ধরেই। মানে, মানুষই নেকড়েদের কোনো না কোনো ভাবে পোষ মানিয়ে কুকুর তৈরি করেছে।

গবেষকরা পরীক্ষা চালিয়েছিলেন প্রাপ্তবয়স্ক ১৬০টি রাস্তার কুকুর নিয়ে। মানুষের ইশারা বোঝার ক্ষমতা কতটা প্রবল রাস্তার কুকুরদের, সেটা বুঝতেই এ পরীক্ষা চালিয়েছিলেন গবেষকরা।

এক জন গবেষক মাঠের একটি জায়গায় রেখে আসেন দু’টি বাটি। কিছুটা দূরত্বে। একটি বাটিতে ছিল কাঁচা মুরগির মাংস। অন্য বাটিতে শুধুই মাংসের গন্ধ ভালভাবে মাখানো ছিল।

কিন্তু তাতে কোনো মাংসের টুকরো ছিল না। এবার দু’টি বাটির মধ্যে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আরেকজন গবেষক কোনো একটি বাটির দিকে আঙুল দেখালেন। সামনে দাঁড়ানো পথের কুকুরদের চোখে চোখ না রেখেই। দ্বিতীয় গবেষকেরও জানা ছিল না কোন বাটিতে মাংস রয়েছে আর কোন বাটিতে সেটা নেই।

তারা দেখেছেন, কুকুরদের অর্ধেক গবেষকদের ইশারায় কোনো সাড়া দিল না। বরং সন্দেহের চোখে তাকাল। হয়তো অতীতে এমন পরিস্থিতিতে পড়ে ঠকতে হয়েছে।

কুকুরদের বাকি অর্ধেক অংশ কিন্তু গবেষকদের ইশারায় সাড়া দিয়েছিল। আর তারা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক গবেষকের আঙুলের ইশারা দেখে একটি বাটির কাছে পৌঁছেছিল।

অনিন্দিতার ব্যাখ্যা, ইশারা দেওয়ার সময় যেহেতু কুকুরদের দেখেননি গবেষক, তাই অচেনা কুকুররাও তাঁর চোখের ভাষা বোঝার সুযোগ পায়নি। তারা বাটির দিকে এগিয়েছিল শুধুই সেই গবেষকের আঙুলের ইশারা বুঝে। এতেই বোঝা যাচ্ছে, অচেনা পথের কুকুররাও আমাদের ইশারা, ইঙ্গিত বুঝতে পারে, তাদের আগেভাগে কিছু না শেখানো হলেও।

গবেষকরা এর পর আরও একটি পরীক্ষা করেন। ইশারা এক বার দেখিয়েই তা বন্ধ করেন। আবার কিছুক্ষণ পর ইশারা করেন। তাতেও দেখা গেছে, গবেষকদের ইশারা দেখেই বাটির কাছে পৌঁছে গিয়েছিল পথের কুকুররা।

অনিন্দিতার ব্যাখ্যা, এটা বোঝাচ্ছে, ওরা আমাদের ইশারা, ইঙ্গিতগুলো কেমন, সেটা একবার দেখার পর মনেও রাখে। ফলে ইশারা বন্ধ করে দিলেও তারা বাটির দিকেই এগিয়ে গিয়েছিল।

পরীক্ষায় পাওয়া গেছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ। গবেষকের ইশারার সূত্র ধরে কোনো পথের কুকুর কোনো বাটির কাছে গিয়ে মাংসের টুকরো না পেয়ে থাকলে, তাকে দ্বিতীয়বার ইশারা করে আর টেনে আনা যায়নি।

অনিন্দিতার ব্যাখ্যা, এটা প্রমাণ করছে, ওরা ঠকে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছে। তার পর ওরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর ঠকবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাভাবিক পরিবেশে, তাদের নিজস্ব মহলে প্রাণীদের আচরণে নানা ধরনের বৈপরীত্য (ডাইভার্সিটি) দেখা যায়। তাই পরিবেশের সঙ্গে কেউ রি-অ্যাক্ট করে, কেউ করে না। বা, কেউ অন্যভাবে করে।

সেটা করে তাদের নিজের নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। এটা গবেষণাগারে প্রাণীদের উপর পরীক্ষায় ততটা আশা করা যায় না। যা ফের প্রমাণিত হল অনিন্দিতারা খোলা মাঠে রাস্তার কুকুরদের উপর পরীক্ষা চালানোয়। ইশারায় যারা সাড়া দেয়নি, তারা নিশ্চয়ই আগে ঠকেছে। বা কোনোভাবে দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছে।

এস এস