ন্যাভিগেশন মেনু

কয়েক হাজার পরিবারের মুখে হাসি ফুটিয়েছে জরুরি খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি


স্বল্প আয়ের কারণে অনেক দিন ধরে আর্থিক সংকটে ভুগছিল সৈয়দ নূরের পরিবার। সামান্য জমির মালিক উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং ইউনিয়নের হরিণমারা গ্রামের এই পরিবারটি তাদের দৈনন্দিন খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছিল। তাদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা দূরে থাক, পরিবারটি তিনবেলা খাবার জোগাড় করতেই পারছিল না।

তবে প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া কক্সবাজার জেলার মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নতির লক্ষ্যে ইউএসএআইডি’র অর্থায়নে পরিচালিত একটি প্রকল্পের কারণে পরিবারটির অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।

নূরের পরিবার দক্ষিণাঞ্চলীয় এ জেলার টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার পাঁচ হাজার ২২৯টি পরিবারের মধ্যে একটি যারা ওয়ার্ল্ড ভিশন-বাস্তবায়িত জরুরি খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির (ইএফএসপি) সহায়তায় তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে।

নূর জরুরি খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির পাঁচটি কার্যক্রমের অন্যতম ‘কাজের বিনিময়ে অর্থ’র সঙ্গে যুক্ত যেখানে তিনি দিনে ছয় ঘন্টা কাজ করে মোটামুটি  অর্থ উপার্জন করেন। কাজের বিনিময়ে অর্থ কার্যক্রমে স্থানীয় সম্প্রদায়ের লোকদের অন্তর্ভুক্ত করে রাস্তা, খাল ও নর্দমা সংস্কার ও উন্নত করা হচ্ছে।

সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নূর বলেন, “পরিবারের আর্থিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত কাজ ছিল না আমার। কিন্তু আমি কাজের বিনিময়ে অর্থ কার্যক্রমে যোগ দেওয়ার পর আমার আর্থিক অনটনের দিন শেষ হয়েছে।”

ওয়ার্ল্ড ভিশনের তথ্য বলছে, কাজের বিনিময়ে অর্থ কার্যক্রমের ১১০টি প্রকল্পের আওতায় দুটি উপজেলায় ২২ কিলোমিটার রাস্তা, ৩ দশমিক ৩ কিলোমিটার নর্দমা এবং ১ দশমিক ০৭ কিলোমিটার খাল সংস্কার ও উন্নত করা হয়েছে এবং ১ হাজার ২৬৭ বর্গমিটার গ্রাউন্ড রেইজিং কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

কাজের বিনিময়ে অর্থ কার্যক্রম কেবলমাত্র স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাই করেনি, যোগাযোগও সহজ করেছে।

“সংস্কার কাজের আগে এই রাস্তাটি ছিল সরু মাটির রাস্তা। আমাদের জন্য চলাফেরা করা ছিল কঠিন। এখন এটি একটি প্রশস্ত ইটের রাস্তা। আমরা এটি পেয়ে খুবই খুশি,” বলছিলেন উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের নিদানিয়া গ্রামের একটি মাদ্রাসার খতিব মোহাম্মদ ইলিয়াস, যার এলাকায় আরেকটি রাস্তা সংস্কার করা হয়েছে।

জরুরি খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির ফিল্ড ম্যানেজার মো. আব্দুল বারেক বলেন, কর্মক্ষম ব্যক্তিদের পাশাপাশি প্রকল্প এলাকার প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক ব্যক্তিদেরও এ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যারা কোনও কাজ ছাড়াই কর্মক্ষম ব্যক্তিদের মতো একই পরিমাণ অর্থ পান।

তিনি বলেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে ওয়ার্ল্ড ভিশন অদক্ষ স্থানীয় লোকদের কর্মদক্ষতাও উন্নত করছে যারা ভবিষ্যতে আরও ভালো মূল্যে কাজ করতে পারবেন।

ওয়ার্ল্ড ভিশনের বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ক্রাইসিস রেসপন্স (বিআরসিআর)’র অধীন জরুরি খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির হেড অব পার্টি মো. রজব আলী বলেন, এ কর্মসূচির মাধ্যমে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার সবচেয়ে নাজুক স্থানীয় পরিবারগুলোর স্বল্পমেয়াদী খাদ্য নিরাপত্তা সঙ্কট সমাধানের এবং মধ্যমেয়াদী জীবিকা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

পরিবারের উপার্জন, জমির পরিমাণ ও কর্মরত সদস্যদের সংখ্যা এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং উপজেলা প্রশাসনের দ্বারা তথ্য যাচাইয়ের ভিত্তিতে নির্বাচিত ৫ হাজার ২২৯টি দরিদ্র পরিবারের প্রত্যেকটিই জরুরি খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাধীন কার্যক্রমগুলোর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।

‘কাজের বিনিময়ে অর্থ’ ছাড়া জরুরি খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির অন্যান্য কার্যক্রমগুলো হলো ‘আয় বর্ধন কার্যক্রম (আইজিএ)’, ‘জীবিকা’, ‘নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে পুরুষের সংশ্লিষ্টতা’, ও ‘পুষ্টি’।

আইজিএ দরিদ্র পরিবারগুলোকে স্থানীয় পর্যায়ে ছোট আকারের উৎপাদন শুরু করতে এবং বাজারে তাদের প্রবেশ নিশ্চিত সাহায্য করেছে, যার মাধ্যমে পারিবারগুলোর আয় বেড়েছে, খাদ্যে গ্রহণে বৈচিত্র্য এসেছে এবং তাদের সঞ্চয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে। স্থানীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে ছয় ধরনের ব্যবসাকে আইজিএ-তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেগুলো হলো দেশি মুরগি পালন, টার্কি পালন, ছাগল পালন, শূকর পালন, মুখোশ তৈরি এবং শুঁটকি মাছ প্রক্রিয়াকরণ।

টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের আলী আকবর পাড়ার গৃহবধূ সাকেরা বেগম মুরগি পালনের জন্য আইজিএ কার্যক্রম থেকে অনুদান হিসাবে ১৫ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। সেই ছোট ব্যবসার মুনাফা ও অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তিনি এখন গড়ে তুলেছেন মাঝারি আকারেরে একটি মুরগি ও কবুতরের খামার।

তিনি বলছিলেন, “এখন আমি খামার থেকে মাসে প্রায় ১০ হাজার টাকা আয় করি। এখন আমাদের আর কোনও আর্থিক অনটন নেই।"

‘জীবিকা’ কার্যক্রমের আওতায় পরিবারগুলোকে বীজ বপন, বীজতলা তৈরি, কৃত্রিম পরাগায়ন, সেক্স ফেরোমন ফাঁদ এবং জৈব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং আধুনিক পদ্ধতিতে গৃহসংলগ্ন জমিতে চাষাবাদের জন্য কৃষি সরঞ্জাম কিনতে নগদ অনুদান দেওয়া হয়েছে। এ কার্যক্রমের কারণে পরিবারগুলো বিকল্প আয়ের উত্স তৈরি হয়েছে, যা তাদের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ এবং পরিবারের সদস্যদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করেছে।

জরুরি খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাধীন ‘নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে পুরুষের সংশ্লিষ্টতা’ কার্যক্রমের লক্ষ্য হলো সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্যের অবসান ঘটানো এবং নারীর অধিকার এবং পরিবারের প্রতি পুরুষের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করার মাধ্যমে পারিবারিক শান্তি নিশ্চিত করা।

স্থানীয় লোকজন জানান, জামাই-বউ নামে অধিক পরিচিত এ কার্যক্রমে স্থানীয় এক হাজার ৪৯৪টি দম্পতি যুক্ত হওয়ার পর এলাকায় নারীর প্রতি সহিংসতা অনেকাংশে কমেছে।

রাজাপালং ইউনিয়নের রুদ্র পাড়া গ্রামের বাসিন্দা আপন রুদ্র বলছিলেন, “নারী অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়ার আগে আমি আমার স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার করতাম। ওয়ার্ল্ড ভিশন পরিচালিত কর্মশালাগুলোতে যোগদানের পর এখন আমি জানি আমার স্ত্রীর সাথে আমার কেমন আচরণ করা উচিত… এবং আমি তাকে গৃহস্থালির অনেক কাজে সাহায্য করি।”

আপন রুদ্র যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন পাশে বসা তার স্ত্রী সহাস্যে মাথা নেড়ে তাতে অনুমোদন দেন।

জরুরি খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির ‘পুষ্টি’ কার্যক্রম পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি এবং সেগুলো তৈরির বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে স্থানীয়দের জীবনযাত্রার উন্নতিতে অবদান রেখে চলেছে।

দিলওয়ারা বেগম, একজন মা যিনি ওয়ার্ল্ড ভিশনের পুষ্টিবিদদের কাছ থেকে প্রথমে খাবার তৈরি শিখেছেন এবং এখন অন্যদের তা শিখাচ্ছেন, বলেন “এই অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষেরই পুষ্টিকর খাবার তৈরির বিষয়ে জ্ঞানের অভাব ছিল। এমনকি তারা খিচুড়ি তৈরি করতেও জানত না। এখন তারা জানে কী খেতে হবে এবং কীভাবে সেগুলি তৈরি করতে হবে।”

জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, জরুরি খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি সফল প্রমাণিত হয়েছে। রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, “এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখেছে ইএফএসপি।”