ন্যাভিগেশন মেনু

খালেদা জিয়ার পাঁচ জন্মদিন ঘিরে যতো বিতর্ক


মানুষ বড় হলে মন ও মানসিকতার উন্নতি হয়- এটাই আমরা চিরকাল দেখে আসছি। কিন্তু ব্যতিক্রম দেখা গেলো কেবল বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন ঘিরে।

আসল জন্মদিনে কবে, সেটা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক আছে। তিনি যে বাঙ্গালির শোক দিবস হেয় করতেই এই বিতর্ক সৃষ্টি করতে চেয়েছেন তা ঢের বোঝা  যায়। নইলে কেন তিনি এই দিনটিকে তার  জন্মদিন পালন করছেন।  বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং অনলাইনে তার  অন্তত পাঁচটি জন্মদিনের উল্লেখ পাওয়া যায়।

প্রতিটি দাবির পক্ষেই দলিলও রয়েছে। ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ তারিখে দৈনিক বাংলা পত্রিকায় সরকারি বার্তা সংস্থা- বাসস থেকে পাঠানো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জীবনীতে তার জন্মদিন উল্লেখ করা হয় ১৯৪৫ সালের ১৯ আগস্ট।

ম্যাট্রিক পরীক্ষার মার্কশিট অনুসারে বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন ১৯৪৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। বিয়ের কাবিননামা অনুসারে তাঁর জন্মদিন ১৯৪৪ সালের ৯ আগস্ট।

পাসপোর্ট অনুসারে তাঁর জন্মদিন ১৯৪৬ সালের ৫ আগস্ট। ২০০০ সালের ভোটারের তথ্য বিবরণী ফরমে খালেদা জিয়ার জন্মদিন উল্লেখ করা হয় ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট।

১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর দৈনিক বাংলায় বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন হিসেবে ১৯৪৫ সালের ১৯ আগস্ট উল্লেখ করা হলেও সেই দৈনিক বাংলাতেই ১৯৯৩ সালে প্রথম তাঁর জন্মদিন ১৫ আগস্ট হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

সে বছর থেকেই ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন শুরু করেন তিনি। তবে প্রথমে তা ছিল নিছক ঘরোয়া। বিরোধী দলে যাওয়ার পর ১৯৯৬ সাল থেকে ১৫ আগস্ট ঘটা করে জন্মদিন উদযাপন শুরু করেন বেগম খালেদা জিয়া।

তারপর প্রতিবছর ১৫ আগস্ট প্রথম প্রহরে রীতিমত কেক কেটে আয়োজন করে পালিত হয়ে আসছে বেগম জিয়ার জন্মদিন।১৫ আগস্ট কেউ জন্ম নিতে পারবেন না, কারো জন্মদিন হতে পারবে না;এমন কোনো কথা নেই। অনেকেরই জন্মদিন নিয়ে নানা বিভ্রান্তি আছে।

বিশেষ করে প্রকৃত জন্মদিনের সাথে সার্টিফিকেটের জন্মদিনের অমিল আছে, এমন লোকের সংখ্যা অগনিত।

যেমন কারো  জন্ম হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১১ আগস্ট। কিন্তু কেন জানিসার্টিফিকেটে তার জন্মদিন ১৯৭৭ সালের ৩১ মার্চ লেখা হয়েছে। এটা ধরে নেয়া যায়, চাকরি-বাকরির সুবিধার জন্যই তিনি বয়স কমিয়েছেন। অবশ্যই এটা অপরাধ।    

কিন্তু একজন বিখ্যাত ব্যক্তি- বাঙালির জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদত দিনেই কেন বেগম খালেদা জিয়া তার জন্মদিন পালন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। 

তা সহজেই  বোঝা যায়। একটা জাতির শোক দিবসে তিনি তাকে উপহাস করে ফুর্তি করতে চান। এটা হীন মানসিকতা। অন্যের  একাধিক জন্মদিন নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই।

কিন্তু বাংলাদেশের দুইবারের (কারো মতে তিনবার) সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন, বড় আয়োজনে উদযাপিত হওয়ার মত উপলক্ষ্য।

তাই তার একটা তর্কমুক্ত নির্দিষ্ট জন্মদিন থাকা দরকার। প্রকৃত জন্মদিনের সাথে সার্টিফিকেটের জন্মদিনের ফারাক থাকাটা দোষের কিছু নয়। সবাই প্রকৃত জন্মদিন পালন করে।

আর দালিলিক কাজে সার্টিফিকেটের জন্মদিন অনুসরণ করে। কিন্তু কারো পাঁচটি জন্মদিন থাকা সত্যিই বিভ্রান্তিকর। বেগম খালেদা জিয়ার চারটি জন্মদিনের পক্ষে দালিলিক প্রমাণ থাকলেও এখন যেটা পালিত হচ্ছে, সেই ১৫ আগস্টের পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।

আর যদি সত্যিই ১৫ আগস্টই তার জন্মদিন হয়, তাহলে সেটা তার জন্মের প্রায় ৫০ বছর পর আবিস্কার হলো কেন? ১৯৯৩ সালের আগে ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালনের কোনো তথ্য কি কারো কাছে আছে?

খালেদা জিয়ার ১৫ আগস্ট উদযাপন যতটা না জন্মদিন, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক। ৭৫এর ১৫ আগস্টের পর মুশতাক-জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার সময়ে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিলেন বঙ্গবন্ধু।

২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবার যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্য্যে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দিনটি পালন শুরু হয়।

১৫ আগস্ট এখন জাতীয় শোক দিবস। জাতীয়ভাবে ১৫ আগস্ট পালন শুরুর পর ১৯৯৬ সালে বেগম খালেদা জিয়াও মহা আড়ম্বরে জন্মদিন পালন শুরু করেন। এটা ঠিক বিএনপির প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ। আর এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না, আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করতেই শোক দিবসে খালেদা জিয়ার কেক কাটার আয়োজন।

কিন্তু আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করতে বঙ্গবন্ধুকে খাটো করতে হবে কেন? তাতে কি বঙ্গবন্ধু খাটো হয়েছেন। বরং বেগম জিয়া ধিকৃত হয়েছেন দেশবাসীর কাছে। অথচ  সর্বজন বিদিত বেগম খালেদা জিয়ার সংসার টিকিয়ে রাখতে অবদান রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

মেজর জিয়াকে অনেকটা বাধ্য  করা হয়েছিল এ ক্ষেত্রে।  তাই বেগম জিয়ার তো বঙ্গবন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার কথা।

অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে খালেদার  মুখে ১৯৯৬ সাল আগে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কোনো বাজে কথা বলতে শোনা যায়নি। কিন্তু ইদানিং তিনিও তার ছেলে তারেক রহমানের সাথে সুর মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হেয় করে কথা বলছেন।

কিন্তু খালেদা জিয়া কার বুদ্ধিতে হঠাৎ করে ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন শুরু করলেন  এবং নানামুখী সমালোচনার পরও সেটা চালিয়ে গেলেন,সেটা একটা বিস্ময়।

আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠতা, বাঙালির জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদত দিনটিকে উদ্দশ্য করে বেগম জিয়া জন্মদিন পালন করছেন। এটা প্রতিশোধ মূলক হিসেবে বেগম জিয়ার জন্মদিন পালন করা।

বিএনপির এ প্রতিশোধ বড় নোংরা, নিষ্ঠরতা। তবে তবে এটা না করলেই ভালো করবেন বেগম খালেদা জিয়া। এটা ঠিক জিয়াউর রহমান তাঁর ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে আওয়ামী  লীগকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর খুনীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বাসিত করেছেন। নিজের শাসনামলে বঙ্গবন্ধুকে নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকতে নিজেকে কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি।

নিজেকে বঙ্গবন্ধুর সমান দাবির তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা তাকে বঙ্গবন্ধুর সমান করতে উঠে পড়ে লাগে। গলাবাজি করে, কাউকে ছোট বড় করা যায়  না ।

ইতিহাসে যার যার অবস্থান নির্ধারিত। টুঙ্গীপাড়ার অজপাড়াগায় কবর দিয়ে, ২১ বছর নিষিদ্ধ রেখেও যেমন বঙ্গবন্ধুকে একটুও খাটো করা যায়নি, মুছে ফেলা যায়নি।

জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুই তাকে সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান নিয়োগ দিয়েছিলেন।

 বেগম জিয়াকে বলি- আরেকজনকে খাটো করে কখনো নিজেকে বড় করা যায় না। যিনি বড়, তিনি আপন মহিমায় বড়। বহুবছর ধরেই নানা মহল থেকে ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন না করার জন্য বেগম জিয়ার প্রতি অনুরোধ জানানো হচ্ছিল।

এমনকি বিএনপির ভেতরের শুভচিন্তার ধারক একটি মহলও এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করে আসছিল। কিন্তু অনেকদিন ধরেই বিএনপি অশুভ চিন্তার খপ্পরে আছে।

তবে এবার শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ‘দেশের চলমান সংকট, বন্যা পরিস্থিতি ও নেতা-কর্মীদের জেল-গুম-খুনসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায়’ এবার বেগম জিয়া জন্মদিন পালন করছেন না।

তবুও আমরা বুঝতে পারি, রাজনৈতিক কারণে বা চক্ষুলজ্জায় পুরো সত্যটা বলতে না পারলেও, এটা একটি শুভ বার্তা। আশা করি এই বার্তা,গোটা রাজনীতিতেই একটি শুভ আবহ ছড়িয়ে দেবে।

দেরিতে হলেও বেগম খালেদা জিয়া একটি আত্মঘাতী ভুল শুধরে নিতে যাচ্ছেন বলে তাকে ধন্যবাদ। বিএনপি একদিন নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে,বঙ্গবন্ধু কোনো দলের নয়, তিনি জাতির পিতা।

বঙ্গবন্ধুর সাথে তুলনা করলে জিয়াউর রহমানকে খাটোই করা হয়। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার  জন্মদিন অন্যান্যবার ১৫আগস্টের প্রথম প্রহরে কেক কেটে দিনটি পালন করলেও এবার কেক নাকাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।

তবে শুক্রবার (১৬ আগস্ট)  খালেদা জিয়ার কারামুক্তি, রোগমুক্তি ওদীর্ঘায়ু কামনায় দেশের সব জেলা ও উপজেলায় দোয়া-মাহফিল অনুষ্ঠিতহবে বলে জানিয়েছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবিররিজভী।

তিনি বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ে দোয়া-মাহফিলহবে।খালেদা জিয়া,  ইস্কান্দার মজুমদার ও তৈয়বা মজুমদার দম্পতিরতৃতীয় সন্তান।

ভুয়া কাগজপত্রে অসদুপায় অবলম্বন’ করে বঙ্গবন্ধু হত্যার দিনে জন্মদিন পালন করে যাওয়ায় সাবেক বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কয়েক বছর আগে ঢাকা মহানগর হাকিম মহম্মদ মাজাহারুল ইসলামের আদালতে মামলাটি দায়ের করেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গাজী জহিরুল ইসলাম।

আবেদনকারীর অভিযোগ, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা হারিয়ে খালেদা জিয়া মিথ্যা কাগজপত্র তৈরি করে ১৫ অগস্ট জাতীয় শোক দিবসে জন্মদিন পালন শুরু করেন। কেবল জাতির পিতাকে অসম্মান করে স্বাধীনতাবিরোধী-সহ দেশবিরোধীদের হাস্যরসের খোরাক যোগাতে এ জন্মদিন পালন শুরু করেন তিনি। যা জাতির সঙ্গে স্পষ্ট প্রতারণা।

আবেদনকারী গাজী জহিরুল ইসলামের দাবি, বিভিন্ন মাধ্যমে খালেদা জিয়ার পাঁচটি জন্মদিন পাওয়া গেলেও কোথাও ১৫ আগস্ট  পাওয়া যায়নি।

এ অবস্থায় তিনি পাঁচটি জন্মদিনের একটিও পালন না করে ১৯৯৬ সাল থেকে ১৫  আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বার্ষিকীর জাতীয় শোক দিবসে আনন্দ উৎসব করে জন্মদিন পালন করে আসছেন।

শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সুনাম ক্ষুণ্ণ করার জন্য তিনি শোকের ওই দিনে জন্মদিন পালন করেন।

এতে উল্লেখ করা হয়, তাঁর জন্মদিন ১৯৪৫ সালের ১৯ আগষ্ট। মামলার নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে, খালেদা জিয়ার একাধিক জন্মদিন নিয়ে ১৯৯৭ সালের ২২ আগস্ট এবং ১৯৯৭ সালের ২৭ আগস্ট বেশ কিছু সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রচারিত হয়।

সেখানে লেখা হয়, এসএসসি পরীক্ষার মার্কশিট অনুযায়ী খালেদা জিয়ার জন্মদিন ১৯৪৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর।

এ ছাড়া খালেদা জিয়ার কাবিন নামায় জন্মদিন উল্লেখ করা আছে, ১৯৪৪ সালের ৯ আগস্ট এবং সর্বশেষ ২০১১ সালের তার মেশিন রিডেবল পাসপোর্টে তার জন্মদিন উল্লেখ করা হয়েছে ৫ আগস্ট ১৯৪৬।

১৯৯৭ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত খালেদা জিয়া এ ভাবে ভূয়া জন্মদিন পালন করে জাতিকে বিভ্রান্ত করেছেন।

বাদীর আইনজীবী দুলাল মিত্র জানান, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলায় বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১৯৮ ধারায় ১৫ আগস্ট জালিয়াতির মাধ্যমে মিথ্যা জন্ম দিনকে সত্য বলে প্রচার করে তা পালন করা এবং ৪৬৯ ধারায় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সুনাম নষ্ট করার অভিযোগ করা হয়েছে।

এ মামলায় ৫ জনকে সাক্ষী করা হয় বলেও জানান দুলাল মিত্র।