ন্যাভিগেশন মেনু

গুপ্তধন!


বেদে সম্প্রদায়ের লোক না হয়েও নিতান্ত পেটের দায়ে সাপ ধরাকে জীবিকা হিসেবে নিয়েছে শশাঙ্ক, তার অবস্থা হঠাৎ ফুলে ফেঁপে ওঠাতে কেউ কেউ ঈর্শ্বান্বিত হলো বটে, কিন্ত কেউই অবাক হলো না। অনেকেই ব্যাপারটা অদৃষ্টের খেলা বলে নিশ্চিত হলো। 

পূর্ব পুরুষের কোন সুকীর্তির ফল কিনা তা নিয়েও কিছুটা আলোচনা হলো রাস্তার মোড়ের দোকানের বৈকালিক আড্ডায়। হারাণবুড়ো খক খক করে কেশে এক দলা কফ ফেলে জানালো, ওর বাপটাও ছিলো ওর মতো হারামি। ওর ঠাকুর্দ্দা ভাল লোক ছিলো; সাধুসঙ্গ করতো। মতুয়াদের সাথে চলাফেরা ছিলো। সেই করতে গিয়েই তো সংসারে লক্ষ্য দিতে পারলো না। ছেলেটা বখে গেলো। পাশ থেকে নীরেণবাবু বললেন, তাই হবে; ঠাকুরদার সুকর্মের ফলই হবে। তা না হলে ওই শালা বখাটের এমন কপাল হয়?

গত বছর দু’য়েকে অর্থবিত্তে ফুলে ফেঁপে উঠেছে শশাঙ্ক। বাড়ীতে দালানের কাজে হাত দিয়েছে। 

গ্রামের বাজারের কাছে গাঙের বাঁক। সেখান থেকে একটা খাল উত্তর দিকে উঠে এসে পাড়াটার মধ্য দিয়ে বিলের মধ্যে এক সময় মরে গেছে। শুকনার মৌসুমে খালের মাথা থেকে শুকাতে শুকাতে এসে মাঝ বরাবর থামে। ভাদ্রের এক দুপুরে সেই খাল দিয়ে একটা ইট ভর্তি নৌকা গিয়ে শশাঙ্কদের উঠোনের কাছে থামলো। ইট ভর্তি  কোন নৌকা এই খালের ইতিহাসে কোনদিন ঢোকেনি; উৎসুক লোকজন ভীড় করলো এসে। এ পাড়ায় সব ঘর মাটির; খড়ের ছাউনি। সান বাঁধানো কোন পুকুর ঘাট নেই; পুকুরে পাশাপাশি দু’টো খেজুর গাছ ফেলা। ওটাই ঘাট। সেই পাড়ায় ইট ভর্তি নৌকা থামলো। দেখা গেল শশাঙ্কর শ্যালক রমেশ, যে কি না শশাঙ্কর ছায়াসঙ্গী, সেও আছে নৌকায়। শশাঙ্কের মা সব শুনে বললো, অ বা, তা আমারেও এট্টু ক’লি নে! শশাঙ্কের জবাব, এই তো ক’লাম । ছেলে মায়ের সাথে পরামর্শ করে নি আগে সেই অভিমান স্থায়ী হলো না আনন্দের তোড়ে। ছেলে পাকা বাড়ি করছে যে! 

সোনাগাঁ আর কড়ইতলার মাঝখানে বিরাট বিল। বর্ষার দিনে জলে তলিয়ে থাকে। তখন ধানের চাষ হয়। শীতের দিনে ধান কাঁটার পর আবার ধূ ধূ মাঠ। পায়ে চলার পথ সেই মাঠের মধ্য দিয়ে। মাঠের মাঝ বরাবর একটা প’ড়ো ভিটে। মল্লিকদের ভিটে বলেই লোকে জানে। সেখানে এক সময় সম্পন্ন গৃহস্থদের বসতি ছিলো। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররা আক্রমণ করে এই বাড়িতে। বাড়ির কর্তাসহ তিনজন খুন হয়। তারপর থেকে প’ড়ো ভিটে। মল্লিকদের কয়েকটি পরিবার শরণার্থী হয়ে ভারতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। অন্যরা কড়ইতলায় গিয়ে নতুন মল্লিকবাড়ি করেছে।

বছর খানেক ধরে অমাবস্যার রাতে সেই ভিটেয় পুজো দিয়ে আসছিলো শশাঙ্ক। সাপখোপ, মন্ত্রতন্ত্র নিয়ে তার কাজ। পুজো সে করতেই পারে। কিন্তু মল্লিকদের ভিটেয় এই পুজোর অন্য অর্থ আছে। কথিত আছে, এই ভিটেয় গুপ্তধন আছে। শশধর মল্লিককে রাজাকাররা অনেক যন্ত্রণা দিয়েছিলো সেই টাকার কলসের খোঁজ জানতে; বুড়ো বলে নি। যক্ষের পাহারা থেকে সেই ধন উদ্ধার করার জন্যই এইসব পুজো-আচ্চা। 

মঙ্গলবার সাপ্তাহিক হাটের দিন। সকালবেলায় হাটুরেরা মল্লিকদের ভিটের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখে মল্লিকদের পোতার পশ্চিমের দেয়াল ঘেঁষে বেশ খানিকটা জায়গার মাটি খোড়া। হাত দুয়েক গর্তর নিচের দিকে কিছুটা জায়গা ‘কাভর্’ হয়ে আছে। মসৃণ সেই জায়গা। দেখে মনে হয় কলসি বা এরকম কিছু ছিলো এখানে। পাশে ফুল বেলপাতা পড়ে আছে। কারো বুঝতে বাকী থাকলো না কাল রাতে এখানে পুজো দিয়ে গুপ্তধন তুলেছে শশাঙ্ক। 

তারপর রাতারাতি ফুলে ফেঁপে ওঠে সে। পাকা দালান করে বাড়িতে, ধানী জমি কেনে কড়ইতলার বিলে, এমনকি বাসও কেনে দু’টো। গ্রামের মানুষ দেখেনি, তবে জানে তার মালিকানার বাস চলে যশোর- নড়াইল রুটে। বাসের গায়ে লেখা ‘মা মনসা পরিবহন’। সে নিজে চলাফেরা করে মোটর সাইকেলে।

রাত প্রায় এগারোটার দিকে গ্রামে পুলিশ আসে। গ্রামের মেম্বারকে নিয়ে শশাঙ্কদের বাড়িতে যায়, সার্চ শুরু করে। ঘুমভাঙা মানুষে ভরে যায় শশাঙ্কদের উঠোন। এ ওর দিকে তাকাচ্ছে, ফিসফিস করছে সম্ভাব্য কারণ নিয়ে। অনেকের ধারণা, তার পরিবহন ব্যবসার কোন ব্যবসায়িক শত্রæতার জের ধরে কিছু একটা হয়েছে। অন্য কোন বাস মালিক তাকে ফাঁসিয়েছে কিছুতে। অনেকে বলছে, সাপের বিষের কারবার করে তো, কিছু একটা ঘাপলা আছে। কেউবা বলছে, এত টাকা হয়েছে, থানা-পুলিশ কি ভাগ না নিয়ে ছাড়বে? কারো বা মত, গুপ্তধন সরকারী কোষাগারে জমা না দেয়াই তার অপরাধ। অনেকেই মেম্বারের দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু তিনিও কিছু জানেন না। দারোগা সাহেব তাকে শুধু জানিয়েছেন, শশাঙ্কর বাড়ীতে সার্চ হবে। তাকে উপস্থিত থাকতে হবে। বাকী কথা সার্চের পরে হবে।

ঘরের বাক্স পেটরা খোলার-ভাঙার শব্দে শশাঙ্কর ছোট ছেলেটা কান্না জুড়ে দিয়েছে। সবমিলে হুলুস্থুল অবস্থা।

এরই মধ্যে শশাঙ্ক আর রমেশকে নিয়ে পুলিশের আরেকটি দল আসে। পুলিশের প্রথম দলটি তেমন কিছুই বলেনি কাউকে। দ্বিতীয় দলটি আসার পরে জানা যায়, শশাঙ্ককে ধরা হয়েছে চুকনগর থেকে। সাথে ব্যাগভর্তি জাল টাকা। আরো জাল টাকার সন্ধানে এই অভিযান। কোনভাবে খবর পেয়ে বাড়ীর কিছু যাতে সরাতে না পারে তাই সাথে সাথে পুলিশ এসেছে। বাড়ীর প্রায় সব ঘর সার্চ হলো; কিছুই পাওয়া গেল না।

দোতলা থেকে নেমে আসার মুখে দারোগার নজরে পড়ে সিঁড়ির নিচের ঘরে মজবুত দরজা। শশাঙ্ক নমষ্কারের ভঙ্গিতে কপালে হাত ঠেকিয়ে জানায়, ওটা ‘মা-মনসার ঘর’। অর্থাৎ তার সাপ রাখার ঘর। পুলিশ সদস্যদের কেউ ভিতরে যেতে সাহস দেখালো না।

অবশেষে থানার পাশের নদীতে আস্তানা গাড়া বেদে নৌকা থেকে দু’জন সাপুড়েকে নিয়ে আসা হলো এই ঘর সার্চ করার জন্য। ভোর নাগাদ ওই ঘর সার্চ করা শুরু করে বেদে দ’ুজন। সার সার মাটির হাঁড়ি। মুখে মাটির সরা। তার উপরে গামছা দিয়ে বাঁধা। কোন কোন হাড়িতে সাপ। গোখরোর মত ভয়ঙ্কর সাপ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দারোগা-পুলিশ আর উঠোন ভর্তি উৎসুক জনতা। 

বেশিক্ষণ লাগলো না। আধাঘন্টার মধ্যে একের পর এক সাপ রাখার মাটির হাঁড়ি ভর্তি গাদাগাদা জাল টাকা পাওয়া গেল সেই ঘরে।

সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, তাহলে কলস যে তুললো মল্লিকদের ভিটে থেকে!

গাড়ীতে উঠতে উঠতে দারোগা সাহেব বললেন, শালার বুদ্ধি দেখছস, জাল টাকা ঢাকার জন্যে গল্পডা কি’রম ফাঁদছে হারামজাদা। দারোগার কথা শুনে দুই কনস্টবলের মধ্যে চোখাচোখি হয়; মুচকি হাসি বিনিময় হয়। সেটা দারোগা সাহেবের চোখ এড়ায় না। তিনি ঝাড়ি দেন, হাসস কেন রে? হাসির কী হইলো? 

তার মনে খচখচ করতে থাকে, এ ব্যাঙ্গ শশাঙ্কর গুপ্তধন প্রসঙ্গে, নাকি তার পুবাইলের হাউজিং ব্যবসা প্রসঙ্গে।