ন্যাভিগেশন মেনু

ঘুড়ি


ঠিক বামেও নয়, ঠিক ডানেও নয়। সূর্যের সজ্জিত করা এই চমৎকার আলোর রেখা সোজা গিয়ে একটি সাত বছরের ফুটফুটে বালকের চোখে পৌঁছে অদৃশ্য হয়ে গেল। বালকটির পরিচয়, সামির। সামির ছেলেটি কেবল নার্সারিতে উঠল। এর পেছনে একটি কারনও আছে। তার চার ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতা আর মোটা শরীর দেখে মনেই হবেনা যে সে এখনো ‘এ’ ফর অ্যাপল আর ‘বি’ ফর ‘বল’-এ পরে আছে। 

পশ্চিমাকাশে সূর্যাস্তের এক অসাধারণ প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি হয়েছে। লাল, নীল, হলুদ, ও গোলাপির মনোরম মিশ্রণের মাঝে পাখিদের ছুটাছুটি। কিন্তু এই চিত্ত-চমৎকারী দৃশ্য ছেড়ে তার দৃষ্টি পূর্ব দিকে স্থায়ী হয়ে রয়েছে। পশ্চিম দিকে সূর্য ডুবছে আর পূর্ব দিকে একটি বিরাট ‘চিল-ঘুড়ি’ উড়ছে। একজন প্রেমিক যেভাবে প্রেমিকার দিকে নিঃসন্দেহ ভাবে তাকিয়ে থাকে সেভাবে সামিরও সেই ঘুড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে, তবে তাদের মধ্যে কোন ভালবাসা নেই, বরং তার ভেতরে হালকা হালকা জেদ তৈরি হয়। 

“সামির বাবা, চলো নামি। সন্ধ্যাবেলায় ছাদে বেশিক্ষণ থাকতে হয় না”- সামিরের বাবা বললেন। মাথা নেড়ে সামির উত্তর দেয়। “তোমার মা আজকে দারুণ রান্না করেছে।” মোটাসোটা সামির খাবারের কথা শুনে আর দেরী করল না। সামিরের বাবার নাম জলিল উদ্দিন। তিনি পেশায় একজন ব্যাবসায়ী আর নেশায়-ধূমপান করেন। তার মায়ের নাম রেহানা বেগম এবং তার বাবা ও মা দুজনেই খুব খোলামনের মানুষ। জলিল উদ্দিন সাহেব তার ছেলেকে নিয়ে নিচে নেমে আসেন। সামির এখন কলিংবেল চাপবে। তার আঙ্গুল আর কলিংবেলের দূরত্ব প্রায় দুই সেন্টিমিটারের চেয়েও কম। সে কলিংবেলটি বলতে গেলে চাপ দিয়েই ফেলেছিল আর ঠিক তখনই তার চেয়ে ছোট একটি মেয়ে আর একজন জওয়ান তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সে ভয়ে হাত এদিক ওদিক করতে থাকে। কয়েক সেকন্ড পর সে নিজেই আবার খুশিতে লাফালাফি শুরু করে দেয়। একটু আগে যারা তাকে ভয় দেখিয়েছিল তারা হচ্ছে সামিরের চাচাতো ও ফুপাত ভাই-বোন। “যাও ভেতরে আরো আছে”, সামিরের বাবা হাসতে হাসতে বললেন। তার বড় ভাই সোহাগ ও ছোট বোন ইনু দরজা খুলতে না খুলতেই বাসায় তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। সামিরের তো কথাই নাই। খুশিতে সে ডিগবাজি দেওয়া শুরু করে। বাসায় আজ তার ফুপা-ফুপি, চাচা-চাচি সবাই এসেছেন। এর বিশেষ কারন হল তারা কাল ভোর বেলায় সামিরের দাদা বাড়ি যাচ্ছে। সামির নিজেকে আর সামলাতে পারলোনা, তাই সে সবার সামনেই একটি অসাধারণ নাচ দেয়। ইনুর বড় বোন টিনু আবার ‘ধুম্ মাচালে’ গানও ছেড়ে দিয়েছে। নাচ গান শেষে সবাই একটা করতালি দেন। 

“সামির বাবা, একটু এদিকে আসো তো, তোমার জন্য বড় একটা সারপ্রাইজ আছে”, রেহানা বেগম ডাকেন। সামির অতি আগ্রহের সাথে দৌড়িয়ে আসল। এরপর হঠাৎ করে তার বাবা পেছন থেকে হাজির হয়ে তাকে চমকে দেয়। তার বাবা তার জন্য একটি বিরাট ‘চিল-ঘুড়ি’ এনেছে, যেটা সে এখন তার দাদা বাড়িতে ওড়াতে পারবে। সামির তখন যেই ঘুড়িটা দেখে ছিল, সেই ঘুড়িটার চাইতে তার ঘুড়িটা আরো চকমকে, রঙ্গিন ও তার মতই হাসিখুশি। সে খুশিতে তার বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরল। অন্যদিকে সোহাগের ছোট ভাই সালিম তার ঘুড়ি দেখে আনন্দে সমগ্র বাড়ি দৌড়াতে থাকে। 

গভীর রাত। ঘড়ির কাঁটা ঠিক বারটার ঘরে গিয়ে এক সেকন্ডের জন্যে একটু বিশ্রাম নিলো, এরপর আবার সে তার অবিরাম গতিতে ফিরে এল। সামির, সোহাগ ও সালিম একসাথে সামিরের বিছানায় শুয়ে আছে। বাসায় সামির বাদে সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে। সে বিছানা থেকে উঠে জানালার ধারে এসে দাঁড়ায়। সে তার চোখ দু’টো জানালার বাহিরে ছুড়ে দিল। শত শত মেঘের মাঝপথ দিয়ে এক টুকরো চাঁদ তার দিকে উঁকি দেয়। সে মনে মনে ভাবতে লাগল, “একদিন আমার ‘চিল-ঘুড়ি’-টা এই চাঁদেরও উপরে উড়বে, আর পুরো আকাশ জুড়ে তার বিরাজ করবে।” এই ভাবতে ভাবতে সে বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পরে।

পরদিন সকাল ৬টায় তাদের রওনা দেওয়ার কথা কিন্তু এখন সাতটা বেজে তিরিশ মিনিট পার হয়ে গেছে। প্রত্যেকবারের মত এবারো জলিল সাহেবের তৃতীয়বারের মত শেষবার শৌচাগারে যেতে  হল। শেষ পর্যন্ত তারা ৮টায় রওনা দেয়। দু’টো বড় বড় মাইক্রোবাসে সবাই উঠে পরে। আসলে এত লোকজন এর আগে কখনোই হয়নি। অনেকটা ঠেলে ঠুলে যখন গাড়ি ময়মনসিংহ রোডে একটি রেস্তুরায় থামল তখন সবাই মধাহ্নভোজ করে নিল।খাওয়া-দাওয়া শেষে সালিম তাদের ড্রাইভার কামাল আংকেলকে জিজ্ঞাসা করে, “আংকেল আর কতক্ষণ লাগবে?” “মামা রাস্তায় যে জাম, যাইতে যাইতে মনে হয় সন্ধ্যা লাইগা যাইব,” কামাল আঙ্কেল উত্তর দেন। আর ঠিক তাই হল। পুরো দশ ঘণ্টা পর সামির তার দাদাবাড়িতে পা দিতে পেরেছে। আজকে তো আর ঘুড়ি ওড়ানো হবেনা তাই সে নাস্তা পানি করে জলদি জলদি ঘুমিয়ে পরে সকাল সকাল উঠবে বলে। পরদিন ভোরে তাদের টিনের বাড়ির সামনে উঠানের মাঝখানে সামিরকে দৌড়াতে দেখা যায়। হাতে তার প্রিয় ‘চিল-ঘুড়ি। অনেক দৌড়ঝাপ, আর পরিশ্রম করার পর সে নিজেই তার ‘চিল-ঘুড়ি’ উড়া শিখে ফেলল। দক্ষিণা বাতাসের জোড়ে চিল সামনে এগোতে থাকে, মনে হচ্ছে যেন একটা বিমান রানওয়ে থেকে উড্ডয়ন করছে। বাতাসের জোড় আস্তে আস্তে দিগুণ হয় আর সঙ্গে তার ঘুড়িটাও দিগুণ গতিতে উপরে উঠতে থাকে। একটা সময় এসে তার চিল ওই সীমাহীন আকাশে স্থায়ী হয়ে দাঁড়ায়। নীল আকাশের নিচে তার চিল অন্য আরো দুটো চিল আর ছোট ছোট রং-বেরং-এর পাখিদের সাথে ডানা মেলছে। সামির খুব খুশি। সে এখন হাত-পা ছড়িয়ে পাখিদের মত ভঙ্গি করে উড়ছে। হঠাৎ করে বাতাসের তীব্রতা বেড়ে যায়। সামির না বুঝেই সুতা ছাড়তে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে সে বুঝতে পারল যে, সে তার ঘুড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। সে ঘুড়ির নাটাই ফেলে পাগলের মতো সুতা টানতে থাকে, কিন্তু তাতে কোনই লাভ হয়না। বাড়িতে সবাই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে, আর ওইদিকে সামির কারও কথা না ভেবে ঘুড়ির পেছনে দৌড় দেয়। দশ মিনিট পার হয়ে যায় কিন্তু তার পা একবারও থামেনা। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে দৌড়াতে থাকে। সামনে যে একটা বিরাট পুকুর সেটা তার মোটেও খেয়াল নেই।

সামির জন্ম হওয়ার ঠিক এক বছর এক দিন পর তার বড় ভাই আমির এই পুকুরেই ডুবে মারা যায়। আমির তো তাও সাঁতার কাটতে জানত কিন্তু সামির তো সেটাও পারেনা। সেইদিন থেকে এই পুকুরের আশপাশে সবার আসাযাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। আজ ছয় বছর পর তারা এই গ্রামে এসেছে।

এতক্ষণে সামিরের হুঁশ হয়েছে, কিন্তু ততক্ষণে কাদামাটিতে তার পা পিছলে যায়। যেহেতু তার পা আর অর্ধেক শরীর পানির নিচে, সে কোনমতে হাতের সাহায্যে উপরে উঠার চেষ্টা করে। ভেজা মাটির কারনে সে আরো নিচে নামতে থাকে। এবার সে তার সর্বশক্তি দিয়ে যত জোড়ে সম্ভব চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করে। সাত বছর ধরে চেষ্টা করার পরও যদি কোন ফল না পায় তাহলে এই মুহূর্তে না পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছুনা। চার ফুট দুই ইঞ্চি ফুটফুটে সামির জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত একটা টুঁ শব্দও করেনি। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সে পানির গভীরে চলে যায়। আশপাশে কোন শব্দ নেই। আকাশ ও পাতাল দুটোই নীরব। এক মাইল দূরে সামিরের সেই চিল ধীরে ধীরে আসমান ত্যাগ করতে থাকে। 

পরদিন সকালে সামিরের খবর সবজাগায় ছড়িয়ে পরে। এরপর রিপোর্টাররা তা পেপারে ছাপিয়ে দেন। খবরের কাগজে উল্লেখ করা ছিল যে, “ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার নিগুয়ারি গ্রামে সামির উদ্দিন (৭) নামের একটি ছেলে পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করে। গত শনিবার সকালে সে নিখোঁজ হয়। গতকাল রবিবার ভোরে তার লাশ একটি বটগাছের পাশের পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়।”


তাসনিমুল আলম খান সামিন

ক্লাস- ১০

স্কুল-স্কলাস্টিকা [মিরপুর]