ন্যাভিগেশন মেনু

চিনের বিরুদ্ধে কেন এমন মিথ্যা প্রচারযুদ্ধ?


মোএনামুল হাসান

মহান বিপ্লবী চেয়ারম্যান মাও সেতুং-এর নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালের পয়লা অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী চিন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে পশ্চিমা বিশ্বের পুঁজিবাদী শক্তিসমূহ কখনও তাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেনি। অধিকন্তু, চিনের রাজনৈতিক ও আদর্শিক বিরোধীরা দেশটিকে একঘরে করে রেখে, এর অগ্রযাত্রা রুখে দিতে সদা তৎপর থেকেছে। সেজন্য চিন সর্বদাই পশ্চিমাদের মিথ্যা ও বানোয়াট প্রচার-অভিযানের শিকার হয়ে আসছে। তবে চিন, সকল অপপ্রচারকে দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করে, নিজের অভিষ্ঠ লক্ষে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। ফলে, একসময় যে-চিন সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, সে আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি।

চিনের প্রতিপক্ষরাও কিন্তু থেমে থাকেনি, ধমে যায়নি এক পলকের জন্যও। সমাজতান্ত্রিক দেশটির বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালাতে গিয়ে, চিনের পাল্টা কৌশল ও দৃঢ়তার কাছে বারবার মার খেয়েও, কখনও ধৈর্যচ্যুত হয়নি। তারা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন নতুন কৌশল ও ফন্দি এঁটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় পশ্চিমারা আজ চিনের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্বক মিথ্যা প্রচারযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ওই যুদ্ধের অংশ হিসেবে, পাশ্চাত্যের সুপ্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমগুলো চিনে তথাকথিত 'মুসলিম নির্যাতনের' কল্পকাহিনী প্রচার করে বেড়াচ্ছে। এসব গাঁজাখুরি মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যম বিশ্বের প্রায় দু'শ কোটি মুসলমানকে চিনের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। দু্:খজনক হলেও সত্য যে, পশ্চিমা গণমাধ্যমের মিথ্যা প্রচারণা অনেক সরলমনা মুসলমানকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছে। কারণ, এসব গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী, যে-কারোর পক্ষেই চিনে কোনো মসজিদ খুঁজে পাওয়া একেবারে দুষ্কর হবে। বাস্তবতা যদিও একেবারে ভিন্ন।

গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে চিনে আসার আগে, পশ্চিমা গণমাধ্যমের মিথ্যাচার দ্বারা আমিও খানিকটা প্রভাবিত হয়েছিলাম। আমার মনে প্রশ্নে জেগেছিল: আসলেই কি চিন সকল মসজিদ গুড়িয়ে দিয়েছে? কিন্তু চিনে আসার পরদিনই আমি বিস্মিত হলাম; যখন আমি আমার বাসার পাশেই মুসল্লিতে পরিপূর্ণ একটি মসজিদ দেখতে পেলাম! পরে যখন জানতে পারলাম যে, কেবল বেইজিং শহরেই রয়েছে ৮৩টি মসজিদ, তখন আমার আর বুঝতে কষ্ট হলো না যে, পশ্চিমা গণমাধ্যমের 'চিনে মুসলিম নির্যাতনসংশ্লিষ্ট' সংবাদগুলো 'ইরাকে মারণাস্ত্র থাকার সংবাদের' মতোই সর্বৈব মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তারপরেও আমি বিষয়টি নিয়ে আরও পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা এবং সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে থাকলাম। চিনের বিভিন্ন প্রদেশ ঘুরে সেসব স্থানের চিনা ও বিদেশি মুসলমানদের (বিশেষ করে দীর্ঘ কাল ধরে চিনে বসবাসরত বাংলাদেশি মুসলমান) সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, তাঁরা নির্বিঘ্নে তাদের ধর্ম পালন করে আসছেন। শুধু তাই নয়, চিনা মুসলমানরা হাজার বছর ধরে অমুসলিম চিনাদের সঙ্গে খুবই শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে আসছেন। অনেক মসজিদের ইমাম আমাকে জানিয়েছেন যে, চিন সরকার বাধা দেওয়ার পরিবর্তে, বরং মসজিদগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা করে থাকে, যা অনেক মুসলিম দেশেও বিরল ঘটনা।

দীর্ঘ কাল ধরে চিনে বসবাসরত বিদেশি মুসলমানরা নিশ্চিত করেছেন যে, তাঁরা নিয়মিত মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করেন। এমনকি, তারা তাদের কর্মস্থলে চিনা সহকর্মীদের সামনেই নামাজ আদায় করেন! এর জন্য তাদের কখনও কোনো বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি। এ ছাড়া, চিনের প্রায় প্রতিটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও অফিস—যেখানে মুসলিম শিক্ষার্থী বা কর্মী আছেন—সেখানে হালাল ক্যান্টিনের ব্যবস্থা রয়েছে। কেবল মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য চিন সরকার চারটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে থাকে।

গত রমজান মাসে পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল যে, চিনে মুসলমানদের রোজা রাখতে দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চিনের মুসলমানরা অত্যন্ত উৎসবমূখর পরিবেশে রমজান উদ্যাপন করেছেন। তারা ইফতারির ঠিক পূর্বমুহূর্তে মসজিদে গিয়ে সকলে একসঙ্গে ইফতার করেছেন; মাগরিবের নামাজ আদায় করে মসজিদের ডাইনিংয়ে রাতের খাবার শেষ করে এশা ও তারাবির নামাজ আদায় করে বাসায় ফিরেছেন। এমন উৎসবমূখর রমজান উদ্‌যাপন অনেক মুসলিম দেশেও সচরাচর দেখা যায় না। রমজানশেষে চিনা ও বিদেশি মুসলমানদের একসঙ্গে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ঈদুল ফিতর উদযাপন করতেও দেখা গেছে। প্রায় দশ হাজার মুসল্লির অংশগ্রহণে বেইজিং-এর সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় নিউচিয়ে মসজিদে। দীর্ঘ আট মাসের বেশি সময় চিনে অবস্থান করে বুঝতে পারলাম, পশ্চিমা গণমাধ্যমের 'চিনে মুসলিম নির্যাতনসংশ্লিষ্ট' সংবাদগুলো সর্বৈব মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। চিনের সরকার কিংবা জনগণের কেউই মুসলমানদের শত্রু নয়। অধিকন্তু, চিনের সংবিধান মুসলমানদেরকে ধর্মচর্চার পাশাপাশি সংগঠন করা ও নিজস্ব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করেছে। মুসলমানরা এই অধিকারসমূহ নির্বিঘ্নে ভোগও করে যাচ্ছেন।

অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে: মুসলমানরা এহেন স্বাধীনতা ভোগ করা সত্ত্বেও, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো চিনের বিরুদ্ধে কেন এমন মিথ্যা প্রচারযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় যে, বিশ্বসভায় চিনের উত্থানকে রুখে দিতেই এই প্রচারযুদ্ধ। কারণ, চিনের উত্থানের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে এর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। আর মুসলমানরা চিনের এই প্রবৃদ্ধির এক বিশাল অংশীদার। একে আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে, চিন অধিকাংশ মুসলিম দেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক ও গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন-অংশীদার। চিনের সিংহভাগ জ্বালানির উৎসও কয়েকটি মুসলিম দেশ। অনেক মুসলিম দেশের কৌশলগত অবস্থানও রয়েছে চিনা পণ্যের যাতায়াত-পথে। এ ছাড়া, প্রায় দু'শ কোটি মানুষের মুসলিম-বিশ্ব চিনা পণ্যের এক বিশাল বাজার। এসব কারণেই পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো মুসলিম নির্যাতনের মিথ্যা কাহিনী প্রচার করে, বিশ্বের সরলমনা মুসলমানদের চিনের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

পশ্চিমাদের এহেন অসৎ ও হীন মতলব বুঝতে মুসলমানদের বেশি কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তাঁরা যদি কেবল ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া ও প্যালেস্টাইনসহ অন্যান্য মুসলিম দেশে পশ্চিমা গণমাধ্যমের ভূমিকা খতিয়ে দেখেন, তাহলেই সবকিছু দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার হয়ে যাবে। তখন তারা বুঝতে পারবেন যে, লাখো মুসলিমের রক্তে পশ্চিমা গণমাধ্যমের হাত কতটা রঞ্জিত। তাই কোনো মুসলমানেরই উচিত হবে না চিনের বিরুদ্ধে পশ্চিমা প্রচারযুদ্ধে বিভ্রান্ত হওয়া। সেসঙ্গে তাদের এও বুঝতে হবে যে, বিশ্বসভায় চিনের উত্থানই কেবল মুসলমানদেরকে আরও যুদ্ধ, ধ্বংস ও রক্তপাত থেকে রক্ষা করতে পারে।

লেখক বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ পোস্ট এর চিন প্রতিনিধি । লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় চিন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা বিভাগের ওয়েব সাইটে।