ছোট্ট একটি কক্ষের মেঝেতে ৩টি বিছানা, বইখাতা সাটানো ছোট আকৃতির ২টি পড়ার টেবিল আর ২টি প্লাষ্টিকের চেয়ার সেখানে থালা-বাটি-গ্লাস রাখা। কক্ষটির মাঝখান বরাবর একটি দড়ি টাঙানো, এলোমেলো অগোছালো কাপড়-চোপড় ঝুলছে, কক্ষের মাঝখানে একটি প্লাষ্টিকের বালতি রাখা, সেখানে উপর থেকে পানির ফোঁটা পড়ছে টপ টপ শব্দে, মাথার উপর ছাদে(সিলিংএ) ফ্যানের বদলে ঝোলানো কালো রংয়ের পলিথিন। সেখান থেকেই পানি ঝরছে অবিরাম। অন্য একটি কক্ষের সিলিং সবুজ রংয়ের শ্যাওলায় আচ্ছাদিত সেখানে ঝুলন্ত ফ্যানটি না থাকলে বোঝার কোন উপায় নেই এটা ওই কক্ষের সিলিং অথবা অন্য কিছু। অন্য একটি কক্ষের সিলিংএর অধিকাংশ খসে পড়েছে অনেক আগেই, মরিচায় অধিকাংশই ক্ষয়ে পড়েছে। ভিতরের এমন জীর্ণদর্শা ভবনটির বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। কক্ষগুলির মধ্যে কেউ বা বসে পড়ছে, কেউবা দুপুরের খাবার খেয়ে আয়েসী ঘুমের চেষ্টায়।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের ঠিক পিছনটায় মাত্র বছর বিশেক পূর্বে চিকিৎসকদের আবাসন হিসেবে নির্মিত হয়েছিলো দ্বিতল বিশিষ্ট এই ভবনটি। বসবাস অযোগ্য ও পরিত্যক্ত হওয়ায় অনেক আগেই সেটি ত্যাগ করেন চিকিৎসকরা। সেখানেই অগত্যা আবাসনের ঠাঁই হয়েছে কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজের ৫ম বা শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের। যেখানে হঠাৎ কোন সুস্থ্য স্বাভাবিক মানুষ প্রবেশ করলে প্রাণ ভয়ে আঁৎকে উঠবেন অথবা দৌড়ে পালাবেন।
নাটোরের মেয়ে অনিতা বিশ্বাস। তিনি আক্ষেপ করে আজকের বাংলাদেশ পোস্টকে বলেন, বুক ভরা রঙিন স্বপ্ন নিয়ে কুষ্টিয়া মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এখানেও একটা সুন্দর ক্যাম্পাস পাবো। কিন্তু প্রথম দিনেই ক্যাম্পাসে এসে রহিমা-আফসার ছাত্রী হোষ্টেলে ঢোকার পর আমার সব স্বপ্ন ফিকে হয়ে যায়। প্রথম বছরটা কেটেছে আক্ষেপে। এখানে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমসহ আবাসনস্থলে চরম ভোগান্তির মধ্য দিয়ে আমরা ৫টি বছর শেষ করলাম। অস্বাস্থ্যকর ঝুঁকিপূর্ণ আবাসনে নেই পানীয় জল, সৌচাগার, স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের ব্যবস্থা, দেয়ালে নেই পলেস্তার, ছাদের পলেস্তার খসে পড়ায় আহত হচ্ছেন সহপাঠী শিক্ষার্থী। আমি চাই এমন মানবেতর ও ঝুঁকিপূর্ন জীবনের অবসান হোক আমাদের পরবর্তী জুনিয়র শিক্ষার্থীদের জন্য। অবিলম্বে তারা ফিরে যাক তাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে।
২০১১ সালে পরিত্যাক্ত জড়াজীর্ণ অবকাঠামো নিয়ে অস্থায়ী ক্যাম্পাসের যাত্রা শুরু কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজের। সর্বশেষ ৯ম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের নিয়ে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। ইতোমধ্যে শিক্ষা শেষে ৪টি ব্যাচ বেড়িয়ে যোগদান করেছেন স্বাস্থ্য সেবায়। এখানকার শিক্ষার্থীরা প্রিয় ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক স্বপ্ন ও আকাঙ্খা নিয়ে ভর্তির পর সীমাহীন দুর্ভোগ, নিকৃষ্টতম মানবেতর ও চরম ঝুঁকিপূর্ন জীবন-যাপন করছেন বলে অভিযোগ তাদের। ফিকে হয়ে গেছে তাদের ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক রঙিন স্বপ্ন। আশ্বাসের বানী শুনে আসছেন ভর্তির পর থেকে। এমন অবর্ণনীয় ভোগান্তিমুক্ত শিক্ষা মনোরম পূর্নাঙ্গ মেডিক্যাল ক্যাম্পাসে ফিরতে চান শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের পূর্নাঙ্গ ক্যাম্পাসে ফেরানোর দাবি জেলাবাসীর। সরেজমিন সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বললে তারা এসব চিত্র তুলে ধরেন।
কুষ্টিয়া গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম বলেন, ওইসব ভবন অনেক আগেই বসবাস ও ব্যবহার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীরা কিভাবে থাকে সেটা কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবেন। তাছাড়া কুষ্টিয়া মেডিক্যালের শিক্ষার্থীদের হোষ্টেল নির্মাণ সংক্রান্ত কোন বিষয়েই আমি কিছু বলতে পারব না। যেহেতু নির্মাণ প্রকল্পের সময় সম্প্রসারণ প্রস্তাবনাটি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় সবে মাত্র সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প পরিবীক্ষন ও মূল্যায়ন কমিটি আইএমইডির টিম কয়েকদিন পূর্বে এসে তদন্ত করে গেছেন। উনাদের রিপোর্টের উপর নির্ভর করছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি নির্দেশনা দেন। সে কারণে সুরাহা কবে হবে তার কোন নির্দিষ্ট টাইম ফ্রেম এ মুহুর্তে বলতে পারব না।
কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা: সরোয়ার জাহান বলেন, ‘কুষ্টিয়ায় মেডিক্যাল কলেজের যাত্রা শুরুর কালে তাৎক্ষণিক ভাবে নিরুপায় হয়েই শিক্ষার্থীদের এসব জড়াজীর্ণ আবাসনে রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম এটা সাময়িক সময়ের সমস্যা। কিন্তু প্রকল্পের নির্মাণকাল নিয়ে এমন দীর্ঘসূত্রীতার কারণে আজ সকল ধর্যের সীমা পেরিয়ে গেছে। প্রিয় সন্তানদের এমন পরিত্যক্ত আবাসন বা অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ জীবন-যাপন কোন অভিভাবকই মেনে নেবেন না। দ্রুত এই অবস্থার স্থায়ী নিরসন দাবি করছি।
বিষয়টি নিয়ে কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ডা. আমিনুল ইসলাম বলেন, দেখুন আমার ছাত্র-ছাত্রীদের দুর্ভোগ কষ্টের বিষয়ে আমরা অবগত। ওরা ওদের মূল ক্যাম্পাসে চলে গেলে সব দুর্ভোগ লাঘব হয়ে যাবে। ওখানে ইতোমধ্যে ছাত্রদের আবাসনের জন্য নির্ধারিত ১টি এবং ছাত্রীদের জন্য ১টি হোষ্টেল নির্মাণ কাজের প্রায় ৯৫% সম্পন্ন হয়েছে। চাইলে এখনই ওখানে শিক্ষার্থীদের উঠিয়ে দেয়া যায়, কিন্তু সেটাও হবে ঠিকাদার সংশ্লিষ্ট গণপূর্ত বিভাগের কাছে হস্তান্তর করার পর। এই কাজটিও আটকে আছে ঠিকাদারের সামান্য কিছু বিল বাকী থাকার কারণে। সেটাও এখন নির্ভর করছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের উপর।
কেন নির্ধারিত সময়ের তিনগুন বেশী সময় এবং অর্থব্যয়ের পরও এমন অবস্থা হলো প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অতীতে কি হয়েছে বা হয়নি সেসব নিয়ে এখন আর ঘাটাঘাটি না করি। আগামী দিনে কিভাবে দ্রুততম সময়ে আমরা সকল সমস্যার সমাধানে পৌছতে পারি সেটাই এখন মূখ্য। তবে আশা করছি খুব শীঘ্রই আমরা সমাধানে পৌছাবো। এর বাইরে এ মুহুর্তে আর কিছু বলতে পারব না।
আই আই/ এস এ/ওআ