ন্যাভিগেশন মেনু

জীবননগরে কৃষকের হাসি ফিরেছে সোনালী আঁশে


চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে অনুকুল আবহাওয়ার কারণে এ বছর পাটের ফলন যথেষ্ট ভালো হয়েছে। এদিকে সব সংশয় উড়িয়ে ভালো দাম পাওয়ায় দীর্ঘদিন পর কৃষকের মুখে হাসি ফিরেছে সোনালী আঁশে।

জীবননগর উপজেলায় মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টি কম হওয়ায় পাট জাগ দিতে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়েছিল পাটচাষীরা। পরবর্তীতে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় সেই সমস্যা কেটে গেছে।

কৃষকরা এখন পাট নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কোথাও খালবিল, পুকুর কিংবা ডোবায় পাট কেটে জাগ দেওয়ার জন্য ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। আবার বড় রাস্তা কিংবা গ্রামীণ রাস্তার পাশে বাঁশের খুঁটি পুঁতে তাতে সারি সারি করে শুকাতে দেওয়া হয়েছে পাট। কোথাওবা আবাদকৃত পাটগাছ কেটে জাগ দিয়ে সেখান থেকে পাটের আঁশ ছাড়ানোর কাজে ব্যস্ত। আবার কেউ কেউ আঁশ ছাড়ানো পাট শুকিয়ে ঘরে তুলছেন।

গ্রামাঞ্চলে এখন একটাই দৃশ্য চোখে পড়ে, সোনালি পাট নিয়ে ব্যস্ত কৃষক-কৃষাণীরা।

অনেক জায়গায় সড়কের দুই পাশে নারী ও পুরুষকে পাট শুকানোর কাজ করতেও দেখা যায়। আবার অনেকে অটোরিকশা, ভ্যান, আলমসাধুতে করে বাজারে পাট নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে গ্রামগঞ্জে এখন নতুন পাটের গন্ধ।

গত কয়েক বছর ধরেই পাটের দাম ভালো যাচ্ছে। এরমধ্যে গত বছর (২০২০ সাল) পাটের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। পাটকাটা মৌসুমের শুরুতেই প্রতিমণ পাট বিক্রি হয় দুই হাজার টাকা থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা দরে। পরে এটি ৩ হাজার ৫০০ এবং মৌসুমের শেষ পর্যায়ে হাটে প্রতিমণ পাটের দাম ৫ হাজার টাকা পৌঁছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ি, গত বছর প্রতিমণ পাটের গড় মূল্য হয়েছিল ৩ হাজার ৫০০ টাকা।

পাটচাষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাট চাষ করে তিন মাসের মধ্যে পাট ঘরে তোলা যায়। কম সময়ে, কম পরিশ্রমের ফসল পাট। প্রতি বিঘা জমিতে পাট চাষ করতে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতি বিঘা জমিতে ১০-১২ মণ পাট উৎপাদন হয়। এবার বাজারে পাটের মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। এতো দামে বিক্রির কারণে পাট চাষের খরচ বাদ দিলে অভাবনীয় মুনাফা পাচ্ছেন চাষীরা।

জীবননগর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, জীবননগর উপজেলায় এবার দুই হাজার ২০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। উপজেলার কৃষকরা এবার রবি-১ ও তোষা-৮ জাতের পাট চাষ করেছেন। প্রতি হেক্টর জমিতে পাট উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ দশমিক ৬ মেট্রিকটন। এ হিসেবে উপজেলায় এবার ৭ হাজার ২৭২ মেট্রিকটন পাট উৎপাদন হবে। বর্তমানে পাট কাটা ধোয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। বিভিন্ন হাট বাজারে পুরোদমে পাট বেঁচাকেনা চলছে। এ বছর পাটের রঙ ভালো হওয়ায় যে কোনও বছরের তুলনায় দাম অনেক বেশি।

জীবননগর উপজেলার আন্দুলবাড়িয়া, হাসাদাহ ও উথলী বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পাট নিয়ে এসেছেন বিক্রির জন্য। প্রতি মণ পাট বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। পাটের দাম শুরুতেই ভালো থাকায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে।

জীবননগর উপজেলার নিধিকুন্ড গ্রামের পাটচাষী মিজানুর রহমান জানান, তিনি দুই বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছিলেন। এতে তার খরচ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। দুই বিঘা জমিতে প্রায় ২৪ মণ পাট হয়েছে। তিনি সেই পাট বাজারে নিয়ে প্রতিমণ দুই হাজার ৮০০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। এতে তার বেশ লাভ হয়েছে।

মাধবপুর গ্রামের পাটচাষী আবুল কাশেম জানান, সোয়া দুই বিঘা জমিতে পাট চাষ করতে তার খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। ওই জমিতে ১৮ মণ পাট হয়েছে। প্রতিমণ দুই হাজার ৯০০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। এতে তার খরচ বাদে ৩৭ হাজার ২০০ টাকা লাভ হয়েছে।

ধোপাখালী গ্রামের পাটচাষী মাধব বলেন, 'আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার ফলনও হয়েছে ভালো। শুরুতে দাম পাবো না বলে ভেবেছিলাম। এখন বাজারে প্রায় দ্বিগুণ দামে পাট বিক্রি করছি। গত ৫-৭ বছরেও এতো বেশি দামে পাট বিক্রি করতে পারিনি। এ ছাড়াও আরও অন্তত ২০ হাজার টাকার পাটকাঠি জ্বালানি হিসেবে বিক্রি করতে পারবো। এবছর পাটের দ্বিগুণ দাম পেয়ে কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে।'

উথলী গ্রামের কৃষক মোমিন হোসেন বলেন, এক বিঘা জমিতে পাট চাষ করে উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে ২০ হাজার টাকা লাভ হয়েছে। এছাড়া জ্বালানী হিসেবে পাটখড়ির ব্যপক চাহিদা রয়েছে।

উপজেলার একতারপুর গ্রামে এখন প্রতিমণ নতুন পাট বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৮০০ টাকা দরে। এই দামে পাট বিক্রি করে ওই গ্রামের কৃষক লিয়াকত সিকদার বেজায় খুশি। মুখের হাসিটা আরও চওড়া করে তিনি বলেন, এর আগে কখনও এতো দামে পাট বিক্রি করিনি।

সন্তোষপুর গ্রামের পাট ব্যবসায়ী আব্দুল হান্নান বলেন, করোনা মহামারির মধ্যে আগের যে কোনও সময়ের তুলনায় পাটের বেশ ভাল দাম পাচ্ছেন কৃষক। বছরের কেনাবেচাও শুরু হয়েছে চড়া দামেই। বিভিন্ন এলাকায় প্রতিমণ পাট বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। দেশের ইতিহাসে এর আগে এতো দামে পাট বিক্রি হয়নি।

হাসাদাহ বাজারের পাটের আড়তদার লিয়াকত হোসেন বলেন, হাটে পাট আসতে শুরু হয়েছে। দাম গত বছরের তুলনায় বেশ ভালো। দাম এভাবে থাকলে কৃষকরা লাভবান হবেন।

জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন আক্তার বলেন, এবার পাটের ভালো ফলন হয়েছে। কৃষকরা বর্তমান পাটের বাজার দর অনুযায়ী উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে ভালো লাভ পাচ্ছেন। পাটের দাম এ রকম থাকলে আগামী বছর কৃষকরা আরও ব্যাপকভাবে পাট চাষে উদ্বুদ্ধ হবেন।

এবার পাটের সর্বোচ্চ দাম উঠেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এতো দাম কখনও ছিল না। গত দুই বছর থেকে পাটের দাম খুব ভালো যাচ্ছে। এতে কৃষকের পাট চাষে আগ্রহ বেড়েছে। ফলে উপজেলায় পাট আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, পলিথিন ব্যবহারের পরিবর্তে সর্বক্ষেত্রে পাটের ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাজ করছে সরকার। এতে আমাদের পরিবেশ রক্ষা পাবে, পাশাপাশি সম্ভাবনাময় সোনালি পাটের হারানো গৌরব আবারও ফিরে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

এসকে/সিবি/এডিবি/