ন্যাভিগেশন মেনু

জুমের সোনালী ধানে জুমিয়ার মুখে সোনালী হাসি


পার্বত্য জেলা বান্দরবানে জুমের ধান কাটা শুরু হয়েছে। সবার মুখে হাসি। জুমিয়াদের এখন আনন্দ আর দলবেঁধে জুমের ধান কাটার ধুম পড়েছে।

চিম্বুক এলাকায় যামিনীপাড়ায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চাম পয় ম্রো তার তিন সন্তান নিয়ে জুমের ধান কাটতে ব্যস্ত।

তিনি এ বছর তিন আড়ি ধানের জুম চাষ করেছেন।

জুমের ফসল কেমন হয়েছে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর ভালো ফলন হয়েছে, আশাকরি ভালো ধান পাবো। দুইদিন ধরে ধান কাটতেছি আরও তিন দিন লাগতে পারে ধান কাটা শেষ করতে।

চাম পয় ম্রো'র তিন সন্তানের মধ্যে পাউলেং ম্রো এসএসসি পরীক্ষার্থী, তাইলেং ম্রো ষষ্ঠ ও লেংপাউ ম্রো ৫ম শ্রেণিতে পড়ে। তারা বলে, মাকে জুম কাটতে সাহায্য করতে পেরে খুবই খুশি।

লামা উপজেলার চিনডাক ম্রো পাড়া, রুমা উপজেলা পাইন্দু ইউনিয়নে থোয়াই বতং পাড়া, চান্দা হেডম্যান পাড়া,  বান্দরবান সদর উপজেলার হেব্রন পাড়া, মংপ্রু পাড়া, প্রু মং উ হেডম্যান পাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে  ঘুরে একই চিত্র দেখা যায়।

জুমে এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় ফলন ভালো হয়েছে। জুমে ধানের সাথে সাথীফসল হিসেবে তিল, যব, ভুট্টা, তুলা, কাঁকন, মরিচ, বেগুন, ঠান্ডা আলু, কুমড়া, মারফা, চিনাল, মিষ্টি কুমড়া, সাবারাং, ধনেপাতা, বিভিন্ন প্রকার আলু, কচুসহ প্রায় ৩০-৩৫ প্রকার সাথীফসল উৎপাদন করা হয়।

ধান কাটা ও মাড়াই শেষে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। তারপরও জুমিয়াদের চেহারায় চিন্তার ভাঁজ। কারণ, জুমে আর আগের মতো ধান উৎপাদন হয়না। অনেক ক্ষেত্রে ধানের বদলে সাথীফসলের আশায় জুম চাষ করা হয়।

লামা উপজেলার চিংডক পাড়ার কার্বারী চিংডক ম্রো ও কাইতন ম্রো বলেন, জুম চাষে এখন আগের মতো লাভ হয়না। বেঁচে থাকার তাগিদে তারপরও আমাদের জুম চাষ করতে হয়। জুম চাষ না করেও কোন উপায় নেই।

তংগঝিড়ি পাড়ার জুমিয়া রাম কুমার ত্রিপুরা, হেব্রন পাড়ার লালমুন হল বম বলেন এখন জুম চাষ করা হয় মূলত সাথীফসলের আশায়। কারণ, ধান যা পাওয়া যায় সাথীফসল থেকে তিন-চারগুন লাভ হয়। জুম তো প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে করতে হয়। এখন তো নিজস্ব পাহাড়েই জুম চাষ করেন, কারণ এখন প্রাকৃতিক বন গ্রামের কাছাকাছি কোথাও নেই। 

জয়মোহন পাড়ার কুঞ্জলিকা চাকমা বলেন, জুম থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন শাক-সবজি ফলমুল বিক্রি করে যথেষ্ট আয় উপার্জন করা যায়।

মংপ্রু ছড়া পাড়ার জুমচাষী মংপ্রু মারমা বলেন, জুম পাহাড়িদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর একটি বাজারের মতো। জুমে শুধু লবণ আর নাপ্পি (এক প্রকার শুটকি যা পাহাড়িরা খায়) ছাড়া সবকিছু পাওয়া যায়। অর্থাৎ বাজার থেকে শুধু লবণ আর নাপ্পি কিনে আনলেই হয়, অন্য কিছু কিনতে হয়না।

সকল জুমিয়ারা একবাক্যে স্বীকার করেন, বর্তমানে জুম চাষ অলাভজনক।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্টির একসময় শতভাগ জুম চাষের উপর নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে জুম চাষ অলাভজনক হওয়ার কারণে অধিকাংশ পাহাড়ি আর জুম চাষ করেন না।

বান্দরবান কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায়, এ বছর ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ১৪ হাজার ৫৮৬ জুমিয়া পরিবার ৮ হাজার ৭০৭ হেক্টর জমিতে জুম চাষ করেছেন। অথচ গত ২০২০-২০২১ অর্থবছরেও জুমিয়া পরিবার সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৪০৭টি এবং জুম চাষ করা হয়েছিল ৯ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে।

২০১৩ সালের বান্দরবান বোমাং রাজার দপ্তরের হিসাব মতে, বান্দরবান জেলার ৯৫টি মৌজায় ৯৩৬টি পাড়ায় ১৬ হাজার ২৯১টি পরিবার জুমচাষী ছিল।

বিশিষ্ট গবেষক লেখক কবি ইয়াঙ ঙান ম্রো বলেন, জুম চাষ প্রতিবছর এক জায়গায় করা যায় না। এটি চক্রাকারে করতে হয়। একবার জুম চাষ করার পর কমপক্ষে ৩-৫ বছর জমি পতিত রাখতে হয়। আর প্রাকৃতিক বনাঞ্চলেই জুম চাষ করতে হয়। দিন দিন প্রাকৃতিক বনাঞ্চল কমে যাচ্ছে। জুম চাষ অলাভজনক হয়ে উঠছে। এভাবে দিন দিন জুমের জায়গাও সংকুচিত হচ্ছে আর জুম চাষীও কমে যাচ্ছে। বর্তমানে শুধু খেয়েপরে বেঁচে থাকার তাগিদে জুমিয়ারা জুম চাষ করেন।

এসসি/সিবি/এডিবি/