ন্যাভিগেশন মেনু

জেগে ওঠার সময় এখনই, ধর্ষণসহ সকল সহিংসতার বিরুদ্ধে


বর্তমান বিশ্বে নারী-পুরুষের সমতা একটি আধুনিক ও সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র গড়ার অন্যতম অনুষঙ্গ। এই সমতাপূর্ণ সমাজের ব্যাখা নিয়ে আমাদের সমাজে রয়েছে ধুম্রজাল। সেই সাথে পৃথিবীর মানুষ সভ্যতার আলো পেয়েছে, সে অনেক যুগ হলো, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বদৌলতে মানুষ নিজের প্রতিভাকে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, এমন একটি সন্ধিক্ষণে এসেও আমাদেরকে ভাবতে হচ্ছে নারীর প্রতি সহিংসতার মতো অমানবিক বিষয় নিয়ে।

এক শ্রেণির মানুষ নারীকে এখনো ভাবে যৌন লিপ্সা নিবারণের ভোগ্য বস্তু হিসেবে! আমাদের মানসিকতায় এখনো অনেক দৈন্যতা রয়ে গেছে। সেটা হলো নারীকে একজন মানুষ হিসেবে ভাবার ক্ষেত্রে! এটা আমাদের বড় ধরণের একটা মানসিক দৈন্যতা! নারীর অধিকার মানে মানবাধিকার, নারীর অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত না হলে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না, এই সহজ কথাটাই আমরা অনেকেই বুঝতে চাই না।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ নারী এবং মেয়েরা নানা মাত্রার লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে। ২০১৫ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (Bangladesh Bureau of Statistics) সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭০ শতাংশের বেশি বিবাহিত মহিলা বা মেয়েরা সঙ্গীদের থেকে নানা মাত্রার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক বলেছে যে তাদের সঙ্গীরা তাদেরকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে, এবং তবুও বেশিরভাগই বলেছে যে তারা কখনও কাউকে কিছু বলেনি এবং তিন শতাংশেরও কম ভুক্তভুগী আইনি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

এ বছর, বাংলাদেশ লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা সম্পর্কিত দুটি যুগান্তকারী আইনগুলির বার্ষিকী উদযাপিত হয়েছে: নারী-ও-শিশু নির্যাতন দমন আইন (Women and Children Repression Prevention Act), ২০০০ এবং পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০। তবে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে যে,  নারী এবং মেয়েরা প্রায়শই এই আইনের অধীনে অর্থবহ আইনি প্রতিকারের সন্ধান করতে পারেন না এবং নির্যাতনকারীদের খুব কমই বিচারের আওতায় আনা যায়।

নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সম্পর্কিত মাল্টি-সেক্টরাল প্রোগ্রামের দেওয়া তথ্য অনুসারে, নারী ও মেয়েদের জন্য সরকারের নয়টি ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের কোনো একটির মাধ্যমে আইনী মামলা দায়ের করা ১১ হাজারের বেশি নারীর মধ্যে কেবল ১৬০টি ঘটনায় সফলভাবে দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে-যা প্রায় এক শতাংশ।

সেই সাথে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক জরিপে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশের ২৭টি জেলায় চলতি বছরের এপ্রিল মাসে চার হাজার ২৪৯ জন নারী এবং ৪৫৬ টি শিশু পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। বাল্যবিবাহ হয়েছে ৩৩টি। ২৪টি সহযোগী সংগঠনের মাধ্যমে ২৭ জেলার ৫৮ উপজেলার ৬০২টি গ্রাম ও ৪টি সিটি কর্পোরেশনের ১৭ হাজার ২০৩ জন নারী ও শিশুদের সাথে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, স্বামীর হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৮৪৮ নারী, মানসিক নির্যাতনের শিকার দুই হাজার আট, যৌন নির্যাতনের শিকার ৮৫ জন এবং অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৩০৮ জন নারী। এর বাইরে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন চার জন নারী, হত্যা করা হয়েছে এক জনকে এবং যৌন হয়রানি করা হয়েছে ২০ জন নারীকে।

উত্তরদাতা চার হাজার ২৪৯ শিশুর মধ্যে ৪২৪ জন শিশু পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে। বাল্যবিয়ে হয়েছে ৩৩টি এবং অন্যান্য সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৪২টি। শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪টি, ধর্ষণ চেষ্টা করা হয় ১৬ জনকে, অপহৃত হয়েছে দুই জন, যৌন হয়রানির শিকার ১০ জন এবং ত্রাণ নেওয়ার সময় শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১০টি। জরিপে অংশ নেওয়া এক হাজার ৬৭২ জন নারী এবং ৪২৪ টি শিশু আগে কখনো নির্যাতনের শিকার হয়নি। শিশুদের মধ্যে শতকরা ৯২ ভাগ তাদের বাবা-মা ও আত্মীয়দের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে। আর নারীরা বেশির ভাগই স্বামীর হাতে।

উপরোক্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বর্তমান সমাজে ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা একটি মারাত্মক ব্যাধি হিসেবে পরিণত হয়েছে। এ ব্যাধি থেকে সমাজ, দেশকে মুক্ত করতে সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। গণমাধ্যমে প্রকাশিত মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশের ৮৮৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ৪১ জন। সেই হিসেবে চলতি বছর প্রতিমাসে গড়ে ১১১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

এসব অধিকাংশ ঘটনারই সুষ্ঠু বিচার হয় না, অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, আইনের শাসনের অভাবের কারণে দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না। একটি ঘটনা ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর আমরা প্রতিবাদে সোচ্চার হই। প্রশাসন সক্রিয় হয়। অথচ অসংখ্য ঘটনা ফেসবুক কিংবা গণমাধ্যমের আড়ালে থেকে যাচ্ছে, আমরা জানতেও পারছি না।

তাই যেকোনো সত্য ঘটনার প্রতিবাদ করতে হবে, ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেনো না ঘটে, সেজন্য বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও আইনের শাসনের অভাবের বিরুদ্ধে নিয়মিত প্রতিবাদ করতে হবে। পাশাপাশি মূল্যবোধ, বিচারকার্যে রাজনৈতিক প্রভাব, নৈতিকতা ও সামাজিক অবক্ষয়ও দায়ী। এছাড়া যৌন বিষয়ক শিক্ষা ও পারিবারিক শিক্ষার অভাব, আকাশ-সংস্কৃতির সর্বগ্রাসী বিস্তার এ ধরণের অপরাধের প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। রয়েছে প্রযুক্তির অপব্যবহারও।

আশার কথা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে ‘আমাদের জীবন, আমাদের স্বাস্থ্য, আমাদের ভবিষ্যৎ’ প্রকল্পের মাধ্যমে ১২ হাজার কিশোরী ও যুবতী নারীকে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে নারীদের এ সকল বিষয়ে জীবন দক্ষতা ও সচেতনতাবৃদ্ধির পাশাপাশি সহিংসতামুক্ত সহায়ক পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে একটি সমন্বিত উদ্যোগ বাস্তবায়িত হচ্ছে।

এ ধরণের সামাজিক ব্যাধির উত্তরণে বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি একজন মানুষ হিসেবেও, নারীর প্রতি এ ধরণের সহিংসতা ও সকল প্রকার অমানবিকতার বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাড়াতে হবে এবং প্রতিরোধ করতে হবে। সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের সম্মিলিত প্রয়াসই পারে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপকর্মের অবসান ঘটাতে।

রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশ, ধর্ষকের চারণভূমি হতে পারে না। আওয়াজ তুলতে হবে। সোচ্চার হতে হবে সকল প্রকার নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে। আসুন, জেগে উঠি, ধর্ষণসহ সকল প্রকার সহিংসতার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি, একসাথে...এখনই।


সুমিত বণিক

প্রশিক্ষক ও জনস্বাস্থ্য কর্মী

[email protected]     


এস এ /এডিবি