ন্যাভিগেশন মেনু

ঝালকাঠিতে নদী ভাঙনে হুমকির মুখে শতাধিক স্থাপনা


ঝালকাঠিতে দীর্ঘদিন ধরে নদী ভাঙন রোধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই বিষখালী নদীর তীব্র ভাঙনে ইতোমধ্যেই বিলীন হয়ে গেছে বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ি, সাইক্লোন শেল্টার, মসজিদ, বাজারসহ শতশত হেক্টর কৃষি জমি।

ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে আরও বেশকিছু স্থাপনা। আকস্মিক ভাঙনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

ভাঙন রোধে ১০ বছর ধরে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন কার্যকরী পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।

সরেজমিন দেখা গেছে, জেলার সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর ভাঙনে হুমকির মুখে বাসস্ট্যান্ড, সাইক্লোন শেল্টার, বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার, সড়কসহ প্রায় ২০টি গ্রাম। এরইমধ্যে এ ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে জেলার প্রায় অর্ধশত গ্রাম। বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে হাজার হাজার পরিবার।

সুগন্ধা নদীর ভাঙনের মুখে পড়েছে ঝালকাঠি শহরের কৃষ্ণকাঠি বাসস্ট্যান্ড ও কুতুবনগর মাদরাসাসহ এলাকার বসতবাড়ি। এর আগে এ এলাকায় এক রাতে আকস্মিক ভাঙনে নদীগর্ভে চলে গেছে বসত বাড়িসহ গাছপালা। একইভাবে জেলা শহরের একমাত্র বাসস্ট্যান্ডটি যে কোনো সময় নদীতে বিলীন হওয়ার পথে।

সদর উপজেলার পোনাবালিয়া ইউনিয়নের পোনাবালিয়া, দেউরি, আতাকাঠি, দিয়াকুল, মানকি, ভাওতিতাসহ কয়েকটি গ্রামের দুই শতাধিক পরিবারের বসতবাড়ি বিষখালী নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এসব গ্রামের প্রায় দেড় হাজার একর আবাদি জমি নদীতে ভেঙে যাওয়ায় শত শত কৃষক বেকার হয়ে পড়েছেন।

এলাকাবাসী জানায়, ভাওতিতা গ্রামের অধিকাংশই নদীর ভেতরে চলে গেছে। ভাঙনকবলিত কৃষকরা পরিবার নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। প্রতিদিন ইউনিয়নটির ভাঙনের পরিধি বেড়েই চলেছে।

পশ্চিম দেউরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফারুক হোসেন জানান, নদী তীরের বেড়িবাঁধটি না হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসতে পারে না। এ ইউনিয়নের সাইক্লোন শেল্টারের পিলার এখন নদীর ভেতরে।

নলছিটি উপজেলার হদুয়া মাজার ও বন্দর রক্ষা প্রকল্পটির কাজ শেষ হলেও এলাকাবাসীর অভিযোগ, বরাদ্দকৃত টাকার বেশিরভাগ লুটপাট হয়েছে। নলছিটি পৌরসভার মল্লিকপুর থেকে সারদল গ্রাম পর্যন্ত সুগন্ধা নদীর তীব্র ভাঙন আরও তীব্রতর হচ্ছে। অথচ এ ভাঙন রোধে কর্তৃপক্ষের কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এ ভাঙনের মুখে পড়েছে মসজিদসহ বসতবাড়ি ও আবাদি জমি।

নলছিটির হদুয়া এলাকার বাসিন্দা কাসেম সিকদার বলেন, ‘জায়গাজমি বহু আগেই গেছে, গত বছর বাড়ি গেছে; দোকানটাও গেল। এখন আমার আর কিছুই নাই, এই বিষখালী আমার সব খাইছে।’

নলছিটির ভবানীপুর গ্রামের স্কুলশিক্ষক আশ্রাফুল ইসলাম বলেন, ‘যে গতিতে নদী ভাঙছে, তাতে ভবানীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও চাঁনপুরা প্রাথমিক বিদ্যালয় অচিরেই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। সরকার যদি কোনো পদক্ষেপ না নেয় তবে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষা করা যাবে না।’

বিষখালী নদীর ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে রাজাপুর উপজেলার মঠবাড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও লঞ্চঘাট, বড়ইয়া ইউনিয়নের কাঁচারিবাড়ি বাজার, চল্লিশকাহনিয়া ও মানকিসুন্দর গ্রাম, নলছিটি উপজেলার হদুয়া দরবার শরিফ, দেউরি সাইক্লোন শেল্টার, ভবানীপুর লঞ্চঘাট ও বাজার, বৈশাখীয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদরাসা, চাঁনপুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বেশকিছু স্থাপনা।

রাজাপুর বাঁদুরতলা এলাকার বাসিন্দা মোশারফ হোসেন বলেন, ‘বাড়িঘর আগেই নদীতে গেছে, গত এক সপ্তাহে বাঁদুরতলা লঞ্চঘাট এলাকায় বেশকিছু দোকান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাঙনের মুখে রয়েছে। এ ছাড়া বাদুরতলা বাজারটি গত পাঁচ বছরে একাধিকবার জায়গা পরিবর্তন করা হয়েছে। বর্তমানে বাজারটি আরও ভেঙে যাচ্ছে।’

এ বিষয়ে রাজাপুর উপজেলার মঠবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, ‘বিষখালী নদীর ভাঙনে দোকান, বসতবাড়ি ও ফসলি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে শতাধিক পরিবার। আমরা তাদের সাধ্যমতো সহায়তা করছি। তবে দ্রুত নদীভাঙন ঠেকাতে না পারলে আরো অনেক পরিবার সর্বস্ব হারাবে।’

কাঁঠালিয়ায় বিষখালী নদীতে স্থায়ী বেড়িবাঁধ না থাকায় বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে কাঁঠালিয়া উপজেলা পরিষদ, অফিসপাড়া, লঞ্চঘাট, আউরা হাট, কচুয়া খেয়াঘাট, আমুয়া বন্দর, চিংড়াখালী বাজার ও আওরাবুনিয়া বাজারের বহু স্থাপনা ভাঙন হুমকিতে রয়েছে। এছাড়া প্রায় প্রতিদিনই বিলীন হচ্ছে শত শত একর কৃষি জমি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, স্থায়ী বেড়িবাঁধ না থাকায় কাঁঠালিয়া উপজেলা পরিষদের কোলঘেঁষা লঞ্চঘাট থেকে বড় কাঁঠালিয়া পর্যন্ত নদী তীরের তীব্র ভাঙনে হুমকিতে রয়েছে উপজেলা পরিষদ সহ অফিসপাড়া।

এছাড়া কাঁঠালিয়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাঁঠালিয়া পাইলট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস, নদী তীরবর্তী বসতবাড়ি ও বহু স্থাপনাও হুমকিতে রয়েছে। বিলীন হচ্ছে শত শত একর কৃষিজমি।

জেলা পরিষদ সদস্য মো. শাখাওয়াত হোসেন অপু বলেন, 'কাঠালিয়ার আমুয়া থেকে জাঙ্গালিয়া পর্যন্ত ৩১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ না হওয়ায় আমরা বন্যার সময় খুবই অসহায় অবস্থার সম্মুখীন হই। ঘরবাড়ি ও কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।'

কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, বাঁধ না থাকায় প্রতিদিন স্বাভাবিক জোয়ারে বিষখালী নদীর পানি উপজেলায় প্রবেশ করে প্রতিনিয়ত তলিয়ে যাচ্ছে আবাদি জমি। এতে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিষখালী নদীর তীরে একটি টেকসই বেড়িবাঁধ হলে কৃষকরা উপকৃত হবেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুফল চন্দ্র গোলদার জানান, বিষখালী নদীতে বেড়িবাঁধ না থাকায় জোয়ার আসলেই ভাঙন অংশ দিয়ে পানি ঢুকে পড়ে। বিষয়টি জেলা প্রশাসকসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। ছোট ছোট ভাঙন মেরামত করেছি। তবে শিগিগরই বেড়িবাঁধ নির্মাণের চেষ্টা চলছে।

উপজেলা চেয়ারম্যান মো. এমাদুল হক মনির বলেন, 'দায়িত্ব নেওয়ার পর দেড় বছর আগে বেড়িবাঁধ নির্মাণের বিষয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর কাছে সরাসরি গিয়ে চিঠি দিয়ে এসেছি। তিনি চিঠিটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী বরাবর পাঠিয়েছেন। শিগিগরই বেড়িবাঁধের সমাধান হবে বলে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন।'

নদীভাঙনের উল্লেখিত প্রকল্পের প্রস্তাবগুলো কবে নাগাদ বাস্তবায়ন হতে পারে এ প্রসঙ্গে ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বোর্ড উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মুশফিকুর রহমান শুভ জানান, ঝালকাঠির সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর ভাঙন থেকে রক্ষাকল্পে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ শেষে ব্লক স্থাপন ও খনন কাজের জন্য ৬৯৫ কোটি টাকার একটি প্রস্তাব পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর প্রকল্পটি সাবমিট করা হলে মন্ত্রণালয় থেকে তা পুনঃনিরীক্ষণের জন্য মন্ত্রণালয় ফেরত পাঠায়। পুনঃনিরীক্ষণ শেষে গত ২২ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ে পুনরায় সাবমিট করা হয়।

তিনি জানান, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে গত ৩ মার্চ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে প্রকল্পটি প্রেরণ করা হয়। তা বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের যাচাই কমিটির সভায় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে। এরমধ্যে ঝালকাঠি সদর উপজেলা ও নলছিটি উপজেলায় ১১.৪৮৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ এবং ব্লক স্থাপনের জন্য প্রস্তাবণা রয়েছে। সেই সাথে ভাটারাকান্দা এলাকার বিপরীতে কিস্তাকাঠি এলাকায় সুগন্ধা, বিষখালী ও গাবখান নদীর মোহনায় জেগে ওঠা বিশাল চরের ১.২ কিলোমিটার খনন কাজ করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনার প্রস্তাবনাও রয়েছে। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৯৫ কোটি টাকা।

অপরদিকে একইভাবে রাজাপুর উপজেলার ১.৫ কিলোমিটার নদীতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও ব্লক স্থাপনের জন্য ৯৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরে একই সাথে প্রস্তাবনায় দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও জানান, জেলার ৪ উপজেলার ৪.৮৫৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কার অতিগুরুত্বপুর্ণ হয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৪০কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। এরমধ্যে ঝালকাঠি সদর উপজেলায় ৬.৪৮৪ কিলোমিটার, নলছিটি উপজেলায় ৭.৯৫ কিলোমিটার, রাজাপুর উপজেলায় ১৩.৫ কিলোমিটার, কাঁঠালিয়া উপজেলায় ১২ কিলোমিটার রয়েছে।

উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মুশফিকুর রহমান জানান, ঝালকাঠি জেলার নদী তীরবর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়া বেড়িবাঁধের সংস্কারের জন্য অতি গুরুত্বপুর্ণ রয়েছে পুর্ণভাঙন কবলিত ১.৭ কিলোমিটার, পুর্ণসংস্কারের অতি প্রয়োজন ২ কিলোমিটার এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত সংস্কারের প্রয়োজন ৩.৬৫০ কিলোমিটার। এ ছাড়াও জেলার নদী তীরবর্তী বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ঝালকাঠি জেলার ১১টি নদীর ৮৮কিলোমিটার দৈর্ঘ্য তীরবর্তী এলাকায় কোনও বেড়িবাঁধ নেই। পোল্ডারিং (নদী তীরবর্তী বেড়িবাঁধ বেষ্টিত) ব্যবস্থাপনায় বাধ নির্মাণের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। যা যাচাই কমিটির সভার অপেক্ষায় রয়েছে। বরাদ্দ পেলেই যথাযথ প্রক্রিয়ায় কাজ শুরু করা হবে।

এ এস/এমআইআর/এডিবি