ন্যাভিগেশন মেনু

টেকসই উন্নয়নে প্রয়োজন যুবসমাজের সক্রিয় সম্পৃক্ততা ও অংশগ্রহণ


যুব সমাজ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি বৃহদাংশ। যুবসমাজের মেধা, সৃজনশীলতা, সাহস ও প্রতিভাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে একটি জাতির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। কারণ এই যুব সমাজের মধ্যে রয়েছে অদম্য সাহস আর অজেয় শক্তি।

এদেশের ইতিহাস স্বাক্ষী, দেশের সকল বিপ্লব আর আন্দোলনে এ দেশের তরুণরাই নেতৃত্ব দিয়েছে বারবার। শুধু তাই নয় বুকের তাঁজা রক্ত দিয়ে সেটি প্রমাণ করেছে এদেশের যুব সমাজ।

শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধে নয়, বিট্রিশ বিরোধী সংগ্রামেও যু্বরা বুকের রক্ত দিয়ে তাদের ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করতে চেষ্টা করেছে। যুবদের এই অদম্য আত্মত্যাগের কাহিনী শুধুমাত্র এদেশের মানুষকে অনুপ্রেরণা জোগায় না, বরং প্রতিনিয়ত বাঁধা ডিঙিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে উজ্জীবিত করে।

১২ আগষ্ট আন্তর্জাতিক যুব দিবস। জাতিসংঘ ১৯৯৯ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক যু্ব দিবস পালন করে। বিশ্বব্যাপি যুবদের কাজ, সমর্থন, এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলে তাদের নিজেদের দক্ষতাকে প্রকাশের সুযোগ করে দিতেই প্রতিবছর বিশ্বের প্রায় অনেক দেশেই আন্তর্জাতিক যুব দিবস পালন করা হয়। 

সারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও প্রতি বছর ১২ আগষ্ট আন্তর্জাতিক যুব দিবস উদযাপন করা হয়। যুবদের কথা, কাজ, উদ্যোগগুলোর পাশাপাশি তাদের অর্থবহ সম্পৃক্ততা ও তাদের সার্বজনীনতা সবার কাছে তুলে ধরা এবং স্বীকৃতি দেওয়া এ দিবসের মূল লক্ষ্য। 

আর্ন্তজাতিক যুব দিবস ২০২০ এর প্রতিপাদ্য বিষয় ‘গ্লোবাল অ্যাকশনের জন্য যুবদের সম্পৃক্ততা’। এ বছর স্থানীয়, জাতীয় এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে যুবদের প্রতিনিধিত্ব কিভাবে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো যায়, সেটাই এবছরের যুব দিবসের বিষয়বস্তু। 

বৈশ্বিক বিভিন্ন সংকটের কারণে বিশ্বের অনেক জনগোষ্ঠীই বর্তমানে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে সারা পৃথিবীব্যাপি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হলো কভিড-১৯ এর প্রার্দুভাব এবং জলবায়ু পরিবর্তন।

এখনও প্রায় সকল ক্ষেত্রে ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যুবদের সম্পৃক্ততা ও ক্ষমতায়নের অভাব রয়েছে। এই বিশাল সংখ্যক যুবদের অর্থবহ অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করতে পারলে তারা দেশের উন্নয়ন তথা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনীতির উৎকর্ষ সাধনে ভূমিকা রাখতে পারবে না, ফলে যুবদের সহযোগিতা নিয়ে দেশ তথা বিশ্ব এগিয়ে যেতে পারবে না।

রাষ্ট্রায়ত্ব, স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানেই যুবদের কাজ করার সুযোগ করতে তৈরি করতে হবে, যুবদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মাঝেও কভিড-১৯ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার লক্ষ্যে যুবদের অর্থবহ অংশগ্রহণ অতীব জরুরী। 

যুবদের সক্ষমতার প্রয়োগ ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের কর্মোদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তাদের প্রতিনিধিত্বকে নিশ্চিত করতে হবে। 

আন্তর্জাতিক যুব দিবস ২০২০ সালে যুবদের স্থানীয়, জাতীয় এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে সম্পৃক্ততাকে গুরুত্বসহকারে অনুধাবন ও বিবেচনা করছে। তাদের অপর্যাপ্ত অংশগ্রহণের ফলে সমাজে ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে অসম অবস্থার পাশাপাশি অদক্ষ নেতৃত্বের উন্মেষ ঘটে। আর এর ফলে যুব সমাজের মধ্যে রাষ্ট্র, সমাজে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে এক ধরণের অনীহা তৈরি হয়। ফলে যুব সমাজের মধ্যে প্রগতির বদলে হতাশার জন্ম নেয়। সমাজ-চরিত্রের নৈতিক ও গণতান্ত্রিক উত্তরণ বিঘ্নিত হয়। 

বাংলাদেশের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি জেলার পিছিয়ে পড়া যুব জনগোষ্ঠীর অনগ্রসরতার হার আরও বেশি। তার মধ্যে কিশোরী ও যুবতী নারীদের অবস্থান আরো নাজুক। 

দুর্গম পাহাড় আর অরণ্যে যেখানে এখনও পরিপূর্ণ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা অধরা স্বপ্ন। সেই সাথে পুরুষদের তুলনায় নারীর জীবনের সাথে যুক্ত রয়েছে সামাজিক কুসংস্কার আর বদ্ধমূল ধারণা। যেগুলো নারীকে তার শারীরিক ও মানসিক স্বকীয়তা প্রকাশে বাঁধা দেয়। কিশোরী ও যুবতী নারী এখনো তার শরীর ও স্বাস্থ্য নিয়ে কাঙ্খিত মাত্রায় সচেতন নয়। তার নিজ শরীরের প্রতি এখনো স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। 

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ও নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এখানকার যুবতী নারীদের প্রগতির পথে অন্তরায়। তারা এখনো নিজের স্বাস্থ্য সমস্যায় অন্যের মুখাপেক্ষী। স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোও পুরোপুরি নারী বান্ধব হয়নি। ফলে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবার অভাবে প্রতিনিয়ত অসুস্থ্যতা নারীকে তার পূর্ণ স্বকীয়তা প্রকাশে বাঁধাগ্রস্থ করে। ফলে পূর্ণ স্বকীয়তা নিয়ে সমাজে, রাষ্ট্রে নিজের প্রতিভা বা দক্ষতার প্রমাণ রাখতে পারছে না। 

এ অবস্থার উত্তরণে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলায় ২০১৯ সাল থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে সিমাভি নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের সহযোগিতায় স্থানীয় ১০টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলার ১২ হাজার কিশোরী ও যুবতী নারীদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে আমাদের জীবন, আমাদের স্বাস্থ্য, আমাদের ভবিষ্যৎ (ওএলএইচএফ) শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। 

আশার কথা হলো, এ প্রকল্পের আওতায় নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সহায়ক পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি স্বাস্থ্যগত সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য জীবন দক্ষতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে। ফলে তারা নিজের স্বাস্থ্য পরিচর্যা বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি নিজের স্বাস্থ্যের অধিকার আদায়ে অধিকার সচেতন হবে এবং নারীর সামগ্রিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি স্থায়িত্বশীল পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করছে প্রকল্পটি।

আমরা প্রত্যাশা করি, সারাদেশের ন্যায় পার্বত্য অঞ্চলের কিশোরী ও যুবতী নারীরা উন্নয়নের মূল ধারায় যুক্ত হবেন, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের উন্নয়ন পরিকল্পনায় তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি বাস্তবমুখী উন্নয়ন কর্ম পরিকল্পনা তৈরি হবে। 

সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের ফলে পার্বত্য জেলার কিশোরী ও যুবতী নারীরাও সমাজ ও দেশের উন্নয়নে সমভাবে অংশীদার হতে পারবেন। যার ফলে সকলের অংশগ্রহণে বিনির্মাণ হবে এক সমতাপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা। যেখানে লিঙ্গ পরিচয় নয়, নিজের দক্ষতা আর প্রতিভা দিয়ে তারা এগিয়ে নিয়ে যাবে প্রিয় স্বদেশকে। 

সেই সাথে সমাজ পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল আধুনিক যুব প্রজন্ম হিসেবে তৈরি হওয়ার পাশাপাশি ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটিও অর্জন সহজ হবে বলে বিশ্বাস করি।   

এডিবি/

লেখক: সুমিত বণিক, জনস্বাস্থ্যকর্মী ও প্রশিক্ষক।

Email : [email protected]