ন্যাভিগেশন মেনু

দু-একজনের ভুল বনাম হাজারো ম্যাজিস্ট্রেটের অবসাদহীন ছুটে চলা


সামিউল মাসুদ

ফজরের আজানের পরপরই রাস্তার দুপাশে কাঁচাবাজার বসা এই গঞ্জের ঐতিহ্য। সাত-সকালে প্রশাসন, পুলিশ বা সেনাবাহিনীর কারও কি এতো নজর দেওয়ার সময় আছে? ব্যাপারটা জানার পর জেলার এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট শিহাব সেখানে হাজির। বাজার কমিটির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদেরকে এমনভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে জায়গা করে দিয়েছেন, যাতে ক্রেতারাও দূরত্ব ও নিজস্ব সুরক্ষা বজায় রেখে কিনতে পারেন। একই সমস্যা আরেকটি জায়গায়, কিন্তু সেখানে সমস্যাটা আরও গুরুতর। কারণ, সেখানে রাস্তা এতই সরু যে, ক্রেতাদের গায়ে গা লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। কাছেই ভেতরে একটি স্থায়ী কাঁচাবাজার। সেখানে লোক যায় না। বাজার কমিটি এবং এই অস্থায়ী লোকদের ‘জান বাঁচানো ফরজ কাজ’ বুঝিয়ে ওই অস্থায়ী বাজারকে বন্ধই করে দিয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেট ফারাশিদ। জনস্বার্থ বৃহত্তর স্বার্থ বলে কথা।

দিন শেষে সন্ধ্যা বেলা গ্রামের মানুষ মনে করে চায়ের দোকানে একটু আড্ডা না দিলে সারাটা দিনই বৃথা। সেখানেও ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবরা হাজির। দোকান বন্ধ করে সবাইকে সেখান থেকে বাসায় ফেরত! অটোতে গাদাগাদি করে একাধিক যাত্রী? নামুন, অন্য অটোতে যান। এছাড়া হাসপাতালে পিপিই ও সার্জিক্যাল মাস্ক সরবরাহ, কোয়ারেন্টিনের জন্য অতিরিক্ত বেড সংযোজন এসব তো রয়েছেই। কেউ-কেউ নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে মাস্ক বানিয়ে নিয়েছেন।

প্রতিটি উপজেলার ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ও গ্রাম পর্যায়ের মানুষদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে চলছে ত্রাণ বিতরণ। যারা দূরবর্তী তাদেরকে নিজ হাতে বাড়িতে-বাড়িতে গিয়েও চলছে ত্রাণ বিতরণ। অনেক উপজেলায় চলছে মিনি ট্রাকে করে বাড়িতে-বাড়িতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নির্ধারিত মূল্যে বিক্রির বিশেষ উদ্যোগ। উদ্দেশ্য একটাই-দেশের মানুষগুলো বেঁচে থাকুক।

এভাবে ছুটে চলছে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটরা। ভোর থেকে শুরু, রাত অবধি। কেউ বাড়িতে-বাড়িতে গিয়ে ত্রাণ সাহায্য পৌঁছে দিচ্ছেন। কেউ ত্রাণ কিংবা অত্যাবশ্যকীয় পণ্য কিনতে গেলে কীভাবে, কত দূরত্বে দাঁড়াবেন, তা রঙ দিয়ে মার্ক করে দিচ্ছেন। কেউ অন্যদের সঙ্গে নিজেও মাইকিং করছেন। তাতেও কাজ না হলে লেগেই থাকছেন যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে মোটিভেট করে ঘরে ফেরানো না যায়। চরম অবাধ্যতা করলে তাকে জরিমানাও করছেন। অর্থাৎ আইন প্রয়োগের পূর্বে তারা যথেষ্ট পরিমাণ Social Reformation বা Mobilization এর কাজ করে চলেছেন।

আমরা হতাশ হয়ে অনেক সময় বলে ফেলি, বাঙ্গালি অনেকাংশে ঠিক সভ্য মানুষের মতো আচরণ করতে শেখেনি- এখন আমাদের করোনা যোদ্ধারা শুধু করোনা প্রতিরোধের কার্যক্রমই না, তার চেয়ে বড় যে কাজটি করছেন তা হলো Social Mobilization বা সমাজ মানসিকতার পরিবর্তন। এ কাজটি কতো কঠিন তা ঘরে বা অফিসের এসিতে বসে বড় বড় তত্ত্বকথা বা আদর্শিক ভাবনা, মতামত দিয়ে পরিবর্তন সম্ভব নয়। নিজে নেমে কয়েকদিন এসব যোদ্ধাদের পাশে থেকে দেখতে হবে। তা হলে চুন থেকে পান খসলেই পুরো গোত্রের বিরুদ্ধে সমালোচনার আগে বোঝা যেত- না ঘুমানো, রোদে পোড়া, একনাগাড়ে দিনভর পরিশ্রম, ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলে যাওয়া, বৈশাখি ভাতা বিসর্জন দেওয়া এই মানুষগুলোর আসলে প্রণোদনা কী?

প্রণোদনা একটাই- দেশের মানুষগুলো বাঁচুক।

এই যুদ্ধে আরও রয়েছেন সেনাসদস্য ও পুলিশ, কিছু স্থানীয় প্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবক। তারাও নিবিড়তায় সম্পৃক্ত। বাকিদের কথা আর নাই বা বললাম।

লেখক: অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি), মুন্সীগঞ্জ।