ন্যাভিগেশন মেনু

নারীর ক্ষমতায়ন এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে প্রশিক্ষণের ভূমিকা


ব্যক্তি সীমাবদ্ধতা ও বিষয়ভিত্তিক ইস্যুতে যে কোনো প্রশিক্ষণেরই একটা নিজস্ব ভূমিকা রয়েছে। প্রশিক্ষণ মানুষকে নিজের ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে সরে গিয়ে তাকে একটা নতুন প্ল্যাটফর্ম দেয়, যেখানে গিয়ে সে স্বাধীনভাবে নিজের জীবন দর্শন ও অবস্থানকে নিরুপণ করতে পারেন। 

সে নিজে বা নিজের কমিউনিটির মানুষ কতটুকু পশ্চাৎপদ অবস্থায় আছে, সেটিকে নতুন করে জানা ও উপলব্ধি করার সুযোগ ঘটে। বিশেষ করে প্রশিক্ষণে কিছু বিষয় থাকে যেগুলো নতুন করে ভাবতে শেখায়, নিজেকে পরিবর্তিত রূপে তৈরি করার জন্য অনুপ্রাণিত করে। 

প্রশিক্ষণ সবাইকে তার নিজস্ব জ্ঞান, দক্ষতা ও আচরণ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমাদের সমাজ বাস্তবতায় কিশোরী ও নারীরা আরও বেশি পিছিয়ে আছে। তাদের পশ্চাৎপদতার কারণগুলো আমাদের সমাজের অনেক গভীরে গ্রোথিত। পদে পদে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন রয়েছে। যেগুলো কে ডিঙিয়ে একজন নারীর পক্ষ্যে তার সকল প্রতিভা বিকশিত করা এখনো একটা বড় চ্যালেঞ্জ। 

স্বাস্থ্যগত বিষয়ের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে সাধারণত প্রজনন অঙ্গের কিছু পার্থক্য ছাড়া উল্লেখ্যযোগ্য কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু আমাদের সমাজের একজন নারী ও পুরুষ যে সকল বদ্ধমূল ধারণা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্য দিয়ে বড় হয়, সেটিই নারী পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান স্বাস্থ্যগত সমস্যার পার্থক্যকে বড় করে তুলে। আর ফলশ্রুতিতে একজন পুরুষ তার সমাজসৃষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নিজেকে বলবান একজন সুঠাম দেহের অধিকারী হিসেবে ভাবতে শুরু করে। অন্যদিকে একজন নারী নিজেকে একজন দুর্বল স্বত্তার মানুষ ও শারীরিক নানা প্রতিকূলতার কারণে রুগ্ন দেহের অধিকারী হিসেবে ভাবতে শুরু করে। 

কিন্তু এটি তো হবার কথা নয়। বিধাতা তো জন্মের ক্ষেত্রে কোন বৈষম্য করেননি, তাহলে মানুষ বা সমাজসৃষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কৃতির কারণে কেন নারীকেই শুধু এই প্রতিকূল অবস্থার শিকার হতে হবে?

শুরুতেই যদি নারীর মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বলি, বহুদিন হয়ে গেছে এই পৃথিবীর মানুষ সভ্যতার আলো পেয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির ছোঁয়ায় চাইলেই মানুষ নিয়মিত বিশ্বের সর্বাধুনিক তথ্য পাচ্ছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাসিকের মতো একটা প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক শরীরবৃত্তীয় বিষয় নিয়ে আমাদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও ট্যাবুগুলো সত্যি যেকোন বিবেকবান মানুষকে ব্যাথিত করবে। 

শুধু তাই নয়, কোন নারী যদি এই দৃষ্টিভঙ্গি ও ট্যাবুগুলো পরিবর্তনে কোন ইতিবাচক উদ্যোগ নেয়, সে ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যায়, ওই নারীকে হেয়প্রতিপন্ন করতে এক শ্রেণীর মানুষ উঠে পরে লেগে যায়, শুধু তাই নয়, অশ্লীল শব্দের প্রয়োগ করে ও ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে তাকে অবদমিত এমনকি তার জীবনকে পর্যন্ত বিপন্ন করতে চায়।

সে ক্ষেত্রে একজন নারী দৃঢ়চিত্তের না হলে, সোশ্যাল মিডিয়ার এই প্রপাগান্ডার ও সমালোচনার বিরুদ্ধে টিকে থেকে নিজের মনোবলকে সুদৃঢ় রাখা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু সাধারণত আমাদের সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের পরিবারেই এক বা একাধিক নারী রয়েছেন, ওই নারীর প্রজনন বা যৌন স্বাস্থ্যের কোন সমস্যা হলে ওই পুরুষ সদস্যটিকেই ছুটতে হয়। পুরুষ সদস্যটিকেই পারিবারিকভাবে দুরবস্থা ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু সমস্যা হলো, নারীর প্রজনন ও যৌন স্বাস্থ্যের বিষয়গুলোকে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা লোক চক্ষুর অন্তরালে দেখতেই বেশি অভ্যস্ত। 

পুরুষের মতো নারীর স্বাস্থ্যের সমস্যাগুলো সমাজে সবার সামনে বলার মতো সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়নি। নারীর মনের গহীনের নিরব কথাগুলো নারীদের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। কষ্ট আর যন্ত্রণার মধ্যে দিনগুলো পার করে। কখনো কখনো এই নিরবতা অনাকাঙ্খিত মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনে। 

কিন্তু এই দৃশ্যপট কি আমাদের প্রত্যাশিত হওয়া উচিত?  কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তরগুলো সাধারণত আমরা খুঁজি না বা এই প্রশ্নগুলোর বিপরীতে বিদ্যমান অবস্থার পরিবর্তনে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে ভাবতে ইচ্ছুক নই। কিন্তু আমাদের এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। কারণ আবহকাল ধরে চলে আসা সংস্কৃতিগুলো আমাদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারই ফসল, আর এই সত্যটা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, আমাদের আরও উপলব্ধি করতে হবে, এই সংস্কৃতিগুলো নারী প্রগতির ক্ষেত্রে চরম বাঁধা সৃষ্টি করে, নারীর সম্ভাবনা ও প্রতিভা বিকাশের পথে অন্যতম অন্তরায়। 

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের কিশোরী ও নারীরা আরও বেশি পিছিয়ে আছে। কারণ, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়ি পাবর্ত্য জেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলো পর্যাপ্ত নাগরিক সুযোগ-সুবিধা এখনো অধরা। জরুরী প্রয়োজনে অ্যাম্বুলেন্স কিংবা মাসিকের সময় ব্যবহৃত একটা সামান্য স্যানিটারি প্যাড ক্রয় করাটাও অনেক ক্ষেত্রে দুঃসাধ্য ব্যাপার।

প্রকৃতির সাথে মিতালি করেই চলে এই সকল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ তথা কিশোরী ও নারীদের জীবন-জীবিকা। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি তারা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের দ্বারা পরিচালিত হলেও, সেই সামাজিক প্রথাগুলোর মধ্যেও নারীকে অবদমিত বা নিগৃহিত করার কিছু সংস্কৃতি লুকিয়ে আছে। যেগুলো সাধারণ দৃষ্টিতে দৃশ্যমান নয়। আর এ সকল দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক প্রথা, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা যুগের পর যুগ নারীকে শৃঙ্খলমুক্ত হতে দেয়নি। এর বদৌলতে নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ চলছেই। 

আশার কথা হলো, নারীর এই সকল বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০১৯ সাল থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় সিমাভি নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের সহযোগিতায় স্থানীয় ১০টি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে ‘‘আমাদের জীবন, আমাদের স্বাস্থ্য, আমাদের ভবিষ্যৎ” নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটি প্রকল্প এলাকার ১২ হাজার কিশোরী ও যুবতী নারী সম্পৃক্ত করণের মাধ্যমে তাদের জীবনে প্রজনন ও যৌন স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা ও দক্ষতা তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে, পাশাপাশি সহিংসতা ও নির্যাতনমুক্ত জীবন গঠনের লক্ষ্যে সার্বিকভাবে কাজ করছে প্রকল্পটি। 

সর্বোপরি প্রকল্পের লক্ষ্য হচ্ছে প্রকল্প এলাকার কিশোরী ও নারীদের জীবনে একটি স্থায়িত্বশীল ইতিবাচক পরিবর্তন আনা। যার মাধ্যমে তারা তাদের জীবনে সামাজিক কুসংস্কার ও সকল প্রকার নেতিবাচক প্রভাবমুক্ত হয়ে একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করবে।

এই প্রকল্পটি গার্লস ক্লাবের মাধ্যমে কিশোরী ও যুবতী নারীদের জীবনের ও শরীরের সকল গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে আনন্দদায়ক ও নিরাপদ পরিবেশে জীবন দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছে। তাদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে, তারা যেন নিজের শরীর সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানে, এবং নিজের শরীর সম্পর্কে জেনে বুঝে যেন নিজের পছন্দ অনুযায়ি সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারেন এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে সঠিক চিকিৎসাটি সম্পর্কে পাওয়ার কথাটি দাবী করতে পারে সে লক্ষ্যে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় তাদের প্রশিক্ষিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। 

সেই সাথে এই প্রক্রিয়ার পাশাপাশি এই প্রত্যাশিত অবস্থায় উন্নীত করতে যে সকল সমমনা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান জড়িত আছে, তাদের সবাইকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরির প্রচেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। 

সর্বোপরি, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রকল্পের কর্মীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার, জেন্ডার বেজড ভায়োলেন্স, মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটছে। কিন্তু দীর্ঘদিনের এই মনস্তাত্ত্বিক ধ্যান-ধারণা বা কুসংস্কার পরিবর্তন করতে হলে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। 

শুধুমাত্র একটি প্রকল্পের মাধ্যমে হয়তো এই চিরাচরিত অবস্থার সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়, তাই এই উদ্যোগকে সফল করতে প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সেবার বিনিময় ও সহযোগিতার সুসমন্বয়। আমরা বিশ্বাস করি, নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণে অর্জিত হবে আমাদের আগামীর স্বপ্ন। আর এটি বাস্তবায়নে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও গণমাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকা ও এগিয়ে আসার বিকল্প নেই।

সুমিত বণিক

জনস্বাস্থ্যকর্মী ও প্রশিক্ষক (বেসরকারি অধিকার ভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা)

ই-মেইল- [email protected]