ন্যাভিগেশন মেনু

নির্মলদা’র জন্মদিনে ফুলেল শ্রদ্ধা । আশীষ কুমার দে


বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট, লেখক ও বামপন্থী রাজনীতিবিদ প্রয়াত নির্মল সেনের জন্মদিন আজ। ১৯৩০ সালের ৩ আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার দিঘিরপাড় গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বংশীয় উপাধিসহ পারিবারিক নাম নির্মল কুমার সেনগুপ্ত। তবে নির্মল সেন নামেই সর্বত্র পরিচিত এবং তিনি নিজেও কখনও ‘নির্মল কুমার সেনগুপ্ত’ লিখতেন না; তাঁর নাম লিখতেন ‘নির্মল সেন’।

তাঁর বাবার নাম সুরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ও মায়ের নাম লাবণ্যপ্রভা সেনগুপ্তা।সুরেন্দ্রনাথ কোটালীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনের গণিত শিক্ষক ছিলেন। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে নির্মল সেন ছিলেন চতুর্থ। ১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে আলাদা দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হওয়ার কয়েক মাস আগে ১৯৪৬ সালের শেষের দিকে নির্মল সেনের পরিবার পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে যায়। তবে প্রিয় মাতৃভূমির টানে তিনি থেকে যান  দেশে।

নির্মল সেন কোটালীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনার পর টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতি এম ই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যায়ন করেন। এরপর তিনি তাঁর পিসির বাড়ি পার্শ্ববর্তী বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠি বি এম একাডেমিতে ভর্তি হন এবং এখান থেকে ১৯৪৪ সালে প্রবেশিকা (এসএসসি) পাস করেন। ১৯৪৬ সালে বরিশালের ব্রজমোহন (বি এম) কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে সেখানেই বিএসসিতে ভর্তি হন। 

বি এম কলেজে পড়া অবস্থায় নির্মল সেন রাজনৈতিক কারণে গ্রেপ্তার হন এবং কারাবন্দি অবস্থায় বিএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। তবে অকৃতকার্য হন তিনি। পরবর্তী সময়ে ফের গ্রেপ্তার হওয়ার পর ১৯৬১ সালে জেলখানায় থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বিএ পাস করেন। এরপর ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ও পরবর্তী সময়ে বাংলায় এমএ পাস করেন করেন তিনি।

নির্মল সেনের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬১ সালে সাংবাদিকতার মাধ্যমে। ওই বছর তিনি দৈনিক ইত্তেফাকে সহকারি সম্পাদক পদে যোগদান করেন। ১৯৬২ সালে যোগ দেন দৈনিক জেহাদ পত্রিকায়। এরপর ১৯৬৪ সালে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় যোগদান করেন তিনি। 

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকা ট্রাস্টের অধীনে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় চলে আসে এবং নাম পরিবর্তন করে দৈনিক বাংলা রাখা হয়। ট্রাস্টি বোর্ড তথা বঙ্গবন্ধুর সরকার এই পত্রিকায়ও নির্মল সেনকে সহকারি সম্পাদক পদে বহাল রাখেন এবং পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এখানেই কর্মরত ছিলেন। 

এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অতিথি শিক্ষক হিসেবেও দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাংবাদিক সমাজের অধিকার আদায়ের সংগ্রামেও সোচ্চার ছিলেন নির্মল সেন। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তবে সাংবাদিক সমাজের বিভক্তিকে মেনে নিতে পারেননি। 

১৯৯১ সালে রাজনৈতিক কারণে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) এবং বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) খণ্ডিত হলে নির্মল সেন ইউনিয়ন ত্যাগ করেন। দ্বিধাবিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়নের উভয় অংশের সদস্য তালিকার শীর্ষে তাঁর নাম থাকলেও তিনি কখনও ইউনিয়ন কার্যালয়ে যেতেন না এবং নির্বাচনে ভোটও দিতেন না।  

নির্মল সেনের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৪২ সালে নবম শ্রেণিতে অধ্যায়নকালে। ওই সময় মহাত্মা গান্ধীর ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে অংশ নিয়ে স্কুলগেটে টানা ১৬ দিন ছাত্র ধর্মঘট করার মধ্য দিয়ে নিজেকে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে ফেলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। 

১৯৪৪ সালে রেভ্যুলিউশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টিতে (আরএসপি) যোগ দেন তিনি। দেশ স্বাধীনের পর তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয় শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল। আমৃত্যু এই বাম দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। 

শৈশব থেকে সামাজিক বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার নির্মল সেন রাজনৈতিক ও কর্মজীবনেও সে ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে গেছেন। বামপন্থী রাজনীতিবিদ হিসেবে যেমন মাঠে-ময়দানে, সভা-সমাবেশে বুর্জোয়া শাসক শ্রেণির জুলুম-নির্যাতন, দুর্নীতি-লুটপাটের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছেন, তেমনি লেখনীর মাধ্যমে শোষিত-বঞ্চিত মানুষের পক্ষে তাদের অধিকারের কথা তুলে ধরেছেন। 

দৈনিক বাংলার প্রকাশনা বন্ধের পর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখতেন তিনি। কিন্তু প্রভাবশালীদের চক্তচক্ষুকে কখনও পরোয়া করেননি। শত প্রলোভন, ভয়ভীতি ও চাপের মুখেও কলমযুদ্ধ চালিয়ে গেছেন তিনি। সবসময়ই তিনি সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালোই বলতেন। যে কারণে সব রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন মহলের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল।  

ছোটবেলায়ই লেখালেখিতে হাতেখড়ি হয় নির্মল সেনের। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় হাতে লিখে প্রকাশিত ‘কমরেড’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন তিনি। নির্মল সেন মূলত: কলাম লেখক ছিলেন। এছাড়া তিনি বহু প্রবন্ধ এবং বেশ কয়েকটি ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন। 

তার উল্লেখযোগ্য কিছু বই: ১. মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্র ২. বার্লিন থেকে মস্কো ৩. পূর্ববঙ্গ পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ ৪. মা জন্মভূমি ৫. লেনিন থেকে গর্বাচেভ ৬. আমার জবানবন্দী ৭. স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই ৮. আমার জীবনে ’৭১-এর যুদ্ধ। 

নির্মল সেন ২০০৩ সালে রক্তক্ষরণজনিত রোগে আক্রান্ত হন। দেশে-বিদেশে কয়েক দফা চিকিৎসা শেষে কয়েক বছর ঢাকায় ভাড়াবাড়িতে ছিলেন। পরবর্তী সময় গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার দীঘিরপাড় গ্রামে নিজ বাড়িতে চলে যান তিনি। 

সেখানে ২০১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ২৪ ডিসেম্বর তাঁকে ঢাকায় এনে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর ফুঁসফুসে যে ইনফেকশন ছিল, তা রক্তের ভেতর দিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ায় (সেপটিসেমিয়া) ২৬ ডিসেম্বর থেকে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়। এ অবস্থায় ২০১৩ সালের ৮ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টায় মারা যান তিনি। 

জন্মদিনে প্রথিতযশা সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেনের কর্মবহুল অমর স্মৃতির প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা।  

লেখক: আশীষ কুমার দে: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক।

এস এস