ন্যাভিগেশন মেনু

পর্যটন গ্রামের রূপরেখা ও একটি প্রস্তাবনা


মোখলেছুর রহমান

বাংলাদেশে কোন পর্যটন গ্রাম নেই।অথচ করোনাকালীন প্রভাবে পৃথিবীর মতো বাংলাদেশের পর্যটন তথা সার্বিক আর্থ-সামাজিক কাঠামো যেভাবে পাল্টে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে, তাতে করে অবিলম্বে পর্যটন গ্রাম স্থাপন করে কৃষি উৎপাদন, সংরক্ষণ, বন্টন, ঔষধি উদ্ভিদের উৎপাদনের মাধ্যমে দেশজ চিকিৎসাকে পুনঃস্থাপন ইত্যাদির মাধ্যমে পর্যটনকে নতুন রূপ দেওয়ার সময় এসেছে।

সার্কভূক্ত ৪টি দেশে অর্থাৎ ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে পর্যটন গ্রাম আছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অরুণাচল ও সিকিমে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অনেকগুলি পর্যটন গ্রাম গড়ে উঠেছে।

বাংলাদেশে প্রায় ৮৭ হাজার গ্রাম আছে।এদের মধ্য থেকে প্রথমে প্রতিটি বিভাগে পাইলট ভিত্তিতে ১টি করে গ্রামকে ২ বছরের মধ্যে পর্যটন গ্রামে রূপান্তর করা যায়। অতপর পরবর্তী ৩ বছরে ওই গ্রামের চারপাশের কতিপয় গ্রামকে যুক্ত করে পর্যটনগুচ্ছগ্রাম গড়ে তোলা যায়।২০২১-২০২৫ মেয়াদে সরকার গ্রামের মানুষদেরকে সঙ্গে নিয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেন। 

দ্বিতীয় ৫ বছর মেয়াদে প্রত্যেকটি জেলায় ১টি করে পর্যটন গুচ্ছগ্রাম গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশে পর্যটন অর্থনীতির টেকসই মডেল তৈরি হবে বলে আগাম নিশ্চিত করা যায়।

পর্যটন গ্রাম কী?

কোন গ্রামকে পর্যটনের মাধ্যমে রূপান্তরের (Transformation) উদ্দেশ্যে পর্যটন অনুগন্তব্য (Micro-destination) হিসেবে তৈরি করলেই তাকে পর্যটন গ্রাম বলবো।পর্যটন গ্রাম গড়ে তুলতে পারলে গ্রামে সার্বিক উৎপাদনশীলতা বাড়বে, পণ্যের বহুমুখীকরণ সম্ভব হবে এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। গ্রামের মানুষকে গ্রামে রেখে এই ধরণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই।পর্যটন গ্রাম পর্যটনসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক সেবাও বহুধরণের নিত্যপণ্য উৎপাদন ও বিপণনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

পর্যটন গ্রামের প্রয়োজনীয়তা:

আধুনিক পর্যটনের অর্থ হলো পর্যটনকে সাশ্রয়ী ও জীবনমুখী করা।পর্যটনের উপাদান সমূহের উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে জীবনের উৎকর্ষ সাধন করে মানুষের বিশ্রাম, বিনোদন ও শিক্ষার জায়গাকে নিশ্চিত করা যায়।এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হলে আমাদেরকে কৃত্রিম পর্যটন সেবা থেকে সরিয়ে এনে প্রাকৃতিক পর্যটন সেবার দিকে ধাবিত করতে হবে।

এই পদক্ষেপ পর্যটনের উলম্ব উন্নয়নের (Vertical Development) পরিবর্তে অনুভূমিক উন্নয়নকে (Horizontal Development) ত্বরান্বিত করবে, যা আমাদের মতো বহু মানুষের দেশে টেকসই উন্নয়নে নিশ্চিত করতে পারে।

উল্লেখ্য যে, অনুভূমিক পর্যটন কাঠামো অধিক সংখ্যক কর্মীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।

পর্যটন গ্রামের প্রয়োজনীয়তা পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই এখন অনুভূত হচ্ছে এবং করোনা প্রভাবের জন্য অদূর ভবিষ্যতে আরও তীব্রভাবে অনুভূত হবে। প্রত্যেকেই নিজেদের সম্পদ ও সংস্কৃতির উপর নির্ভর করে নানা আঙ্গিকে পর্যটন গ্রাম গড়ে তুলছে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নিচের কারণগুলির জন্য পর্যটন গ্রাম গড়ে তোলা দরকার-

ক) পর্যটন গ্রাম হবে পরিচ্ছন্ন ও অধিকতর স্বাস্থ্যসম্মত, যা বসবাসের জন্য অধিক উপযোগী।

খ) কৃষকদেরকে সংগঠিত করে গ্রামে জৈব কৃষির সূচনা হবে, যা গণস্বাস্থ্যের নতুন ভিত্তি রচনা করবে।

গ) মানুষ ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ও কটেজ আকারের পণ্য ও সেবা শিল্প উৎপাদনে এগিয়ে আসবে।

ঘ) স্বল্পশিক্ষিত মানুষকে প্রায়োগিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উৎপাদনশীল মানুষে পরিণত করা যাবে।

ঙ) পর্যটন সেবা পণ্য উৎপাদন ও মানসম্মত সাংস্কৃতিক পণ্যায়ন গ্রামের জিডিপিতে উৎকর্ষী অবদান রাখবে।

চ) মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও শিষ্টাচার বৃদ্ধি পাবে, যা সামাজিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে।

ছ) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সকলের মধ্য থেকে দারিদ্র্য দূর করবে।

জ) মানুষের মধ্যে শহরে গমন হ্রাস পাবে।

ঝ) গ্রামে প্রচুর পরিমাণে পরোক্ষ ও আবেশিত কর্ম সৃষ্টি হবে, যা মানবিক গ্রাম সৃজনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবে।

ঞ) পর্যটন গ্রামে বাইরে থেকে এবং ব্যাংকগুলি ঋণ প্রবাহ সৃষ্টি করতে চাইবে।

ট) গ্রামে আস্থা, ভালবাসা, সহযোগিতা, ত্যাগ ইত্যাদি জাতীয় সামাজিক পুঁজির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।

ঠ) পর্যটন গ্রামগুলি শান্তির গ্রামে (Peace Village) পরিণত হবে।

কী ধরণের পর্যটন পরিচালনা করা যায় পর্যটন গ্রামে?

পর্যটন গ্রামে অন্ততপক্ষে নিচের ১০ ধরণের পর্যটন কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব-

ক) কৃষি পর্যটন: এই ধরণের পর্যটনের মাধ্যমে পর্যটকরা কৃষি উৎপাদন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ইত্যাদিসহ ও কৃষিভিত্তিক বহুমাত্রিক জ্ঞান অর্জন করেন। অভিজ্ঞতা সঞ্চয়য়ের উদ্দেশ্যে পর্যটকরা কৃষি কার্যক্রমে অংশগ্রহণও করেন।

খ) খাদ্য পর্যটন: খাদ্যোপাদান ও রন্ধন কৌশল একেকটি এলাকার ঐহিত্য।তাই পর্যটকরা গ্রাম ভ্রমণকালে উক্ত গ্রামের স্থানীয় খাবারের স্বাদ গ্রহণ করেন বিশেষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য।

গ) আয়ুর্বেদিক পর্যটন: আয়ুর্বেদ পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রাকৃতিক চিকিৎসা, যা এই ভারতীয় উপমহাদেশে সৃষ্টি। উদ্ভিদ, প্রাণি ও খনিজ উপাদান থেকে হিতকর এই চিকিৎসা পদ্ধতি পর্যটন গ্রামে সূচনা করতে পারলে পর্যটকদেরকে তা সহজেই আকৃষ্ট করবে।অনেক মানুষ এই চিকিৎসা গ্রহণের জন্য পর্যটন গ্রামে যাবেন।

ঘ) সাংস্কৃতিক পর্যটন: লোকসঙ্গীত, লোকনৃত্যসহ নানা ধরণের লোকজ আচার ও উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হতে পারে পর্যটন গ্রামগুলি।ময়মনসিংহের ঘাটুগান, রংপুরের ভাওয়াইয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গম্ভীরা সংগতকারণেই পর্যটকদেরকে ওই অঞ্চলের গ্রামগুলিতে আকৃষ্ট করবে।

ঙ) জলাভূমি পর্যটন: দীঘি, বিল, ঝিল, নদী ইত্যাদি যে গ্রামে আছে সেখানে জলাভূমি পর্যটনের জন্য পর্যটকরা অবশ্যই যাবেন।এই ধরণের পর্যটনে জলক্রীড়া, নৌ ভ্রমণ, নৌযানে রাত্রিযাপন ইত্যাদি নানা ধরণের কর্মকাণ্ড গ্রামীণ পর্যটনে বিশেষ মাত্রা যোগ করতে পারে।

চ) ঐতিহ্য পর্যটন: প্রত্নসম্পদ, ঐতিহ্যবাহী খাবার কিংবা অন্যকোন ঐতিহ্য পর্যটন গ্রামে থাকলে তা ওই গ্রামের বাড়তি আকর্ষণের উপাদান হিসেবে কাজ করবে।প্রত্নসম্পদ আছে এমন গ্রামে প্রত্নপর্যটন পরিচালনা করা যাবে।

ছ) মুক্তিযুদ্ধ পর্যটন: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্ন, বধ্যভূমি ইত্যাদি যেসকল গ্রামে রয়েছে সেখানে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যটনের মাধ্যমে নতুন আঙ্গিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা যায়।

জ) কমিউনিটি ভিত্তিক পর্যটন: একটি পর্যটন গ্রামে সকল কমিউনিটির মানুষকে নিয়ে সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা গেলে তা পর্যটকদের জন্য অনুপম শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করবে। সকল শ্রেণির মানুষের সমন্বিত ও সম্মিলিত কার্য পরিচালনা প্রত্যক্ষ করার জন্য অবশ্যই পর্যটকরা আকৃষ্ট হবেন।

ঝ) দারিদ্র্য বান্ধব পর্যটন: যে পর্যটন থেকে দরিদ্র মানুষেরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়, তাকে দারিদ্র্য বান্ধব পর্যটন বলে।পর্যটন গ্রামে দরিদ্র মানুষদেরকে সরবরাহকারী (Supplier) হিসেবে তৈরি করে তাদেরকে পর্যটন পণ্য উৎপাদনে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত করা যায়।কর্মসৃজন ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য এই পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর।

ঞ) জীবনযাত্রা পর্যটন: পর্যটন গ্রামের মানুষেরা কীভাবে জীবনযাত্রা নির্বাহ করেন অর্থাৎ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, কৃষি ও বাণিজ্যিক জীবনযাত্রা নির্বাহে তাদের দৃশ্যমান চিত্র কেমন, তা দেখার জন্য উৎসুক পর্যটকরা যাবেন।

পর্যটন গ্রামের সাংগঠনিক রূপরেখা:

ক) বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডকে পর্যটন গ্রামস্থাপনে প্রত্যক্ষভাবে এগিয়ে এসে নেতৃত্ব দিতে হবে।এই উদ্দেশ্যে তাদেরকে স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।প্রতিটি গ্রামে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করার জন্য ৫ বছর সময়ের জন্য পর্যটন উন্নয়ন কর্মী নিয়োগ দিতে হবে।প্রকল্প বাস্তবায়নের সকল কাজ পর্যটন গ্রাম উন্নয়ন কমিটির মাধ্যমে সম্পাদন করবে।

খ) সংগঠিত উপায়ে পর্যটন গ্রাম স্থাপনে কার্য পরিচালনার জন্য গ্রামের মানুষদেরকে ‘সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি’ গঠন করতে হবে।এই সমবায় সমিতির সদস্যবৃন্দ যৌথভাবে প্রয়োজনীয় কার্যাবলী সম্পাদন করবেন।

গ) ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যগণ তাঁদের নিজ নিজ ওয়ার্ডের মানুষদেরকে সংগঠিত করার কাজ করবেন। ইউপি চেয়ারম্যান তা তদারকি করবেন এবং বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও সমবায় সমিতির সাথে সমন্বয় রক্ষা করবেন।

ঘ) গ্রামের অন্যান্য বাসিন্দারা পর্যটন গ্রাম স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবেন।

পর্যটন গ্রামে রূপান্তরের ধাপ সমূহ:

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সাথে যৌথভাবে পর্যটন গ্রাম প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।এ ব্যাপারে দেশীয় শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং উন্নয়ন কর্মীদের সহযোগিতা গ্রহণ করা যেতে পারে। অতপর পর্যটন গ্রামে রূপান্তরের জন্য নিচের ৫টি ধাপ অনুসরণ করতে হবে-

ধাপ-১: 

গ্রামের আগ্রহী মানুষেরা একত্রিত হয়ে সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি একটি সমিতি গঠন করবে যা সমবায় অধিদপ্তরের স্থানীয় জেলা কার্যালয় থেকে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।এই সমবায় সমিতির সদস্যগণ শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পুঁজির যোগান দিবেন এবং নিজেদের গ্রামে উৎপাদন যোগ্য পণ্য ও পর্যটন সেবা উৎপাদনে বিনিয়োগ করবেন।সমবায়ী পদ্ধতিতে উৎপাদিত পণ্য ও সেবা প্রথমে গ্রামের মানুষের কাছে বিক্রয় করা হবে।অতপর আগত পর্যটক ও গ্রামের বাইরের ক্রেতাদের নিকট বিক্রয় উন্মুক্ত করা হবে। মুনাফা সমবায়ী পদ্ধতিতে শেয়ার হোল্ডারদের বন্টিত হবে।সমবায় সমিতি পর্যটন গ্রাম উন্নয়নে নিচের কাজগুলি করবে-

ক) গ্রাম পর্যায়ে পণ্য ও পর্যটন সেবা উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে।

খ) গ্রামের যুবাদেরকে নিয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করবে যাদের মধ্য থেকে ট্যুরিস্ট গাইড, পরিচর্যা সহযোগী ও উৎপাদন কর্মীর ভূমিকায় কাজ করবে।

গ) সকল পণ্য মার্কেটিং ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

ঘ) গ্রামীণ পর্যায়ে প্রক্রিয়া জাতকরণ ও প্যাকেজিং কটেজ শিল্প স্থাপন করবে।

ঙ) পর্যটন গ্রাম বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সকল কার্যক্রমের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করবে।

ধাপ-২: 

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি যৌথভাবে ‘পর্যটন গ্রাম উন্নয়ন কমিটি’ গঠন করবে এবং নিচের কাজগুলো সম্পাদন করবে-

ক) গ্রামের পর্যটন সম্পদগুলির শুমারী করবেন।

খ) স্বেচ্ছাসেবক দলকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামটি পরিস্কার করবেন এবং নিয়মিতভাবে পরিচ্ছন্নতার কর্মসূচি গ্রহণ করবেন।

গ) জৈব কৃষি ও নিরাপদ কৃষি উৎপাদনে আগ্রহী কৃষকদেরকে নিয়ে একটি দল গঠন করবেন।

ঘ) শস্য, সব্জি, ফল ও ঔষধি উদ্ভিদ উৎপাদনের কারিগরি সহযোগিতার জন্য স্থানীয় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে যুক্ত করতে হবে।

ঙ) জৈব সার যেমন পিট কম্পোস্ট ও ভার্মি কম্পোস্ট তৈরির জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন।

চ) গ্রামের মানুষকে পর্যটন, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং, মার্কেটিংসহ অন্যান্য প্রশিক্ষণের জন্য একটি গ্রামীণ প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট সস্থাপন করবেন।

ধাপ-৩:

ক) গ্রামে ফল, ফুল ও ঔষধি গাছের একটি নার্সারি স্থাপন করতে হবে, যেখান থেকে গ্রামবাসী ও আগত পর্যটকরা গাছের চারা / কলম ক্রয় করে গ্রামে রোপন করবেন এবং প্রয়োজনে নিয়ে যাবেন।

খ) একটি গ্রাম জাদুঘর তৈরি করতে হবে, যেখানে উক্ত গ্রামে অতীত ও বর্তমানে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি এবং ঐতিহ্যবাহী স্মৃতি ও প্রত্নসম্পদ সংরক্ষিত থাকবে।

গ) সমবায় সমিতি বা অন্য কোন ব্যক্তি গ্রামে পল্লী রেস্টুরেন্ট তৈরি করতে হবে।

ঘ) গ্রামে হোম স্টে, তাঁবু, গ্রামীণ বাংলো ইত্যাদি তৈরি করতে হবে।

ঙ) ট্যুরিস্ট গাইডদের প্রশিক্ষণ ও গ্রামীণ রাঁধুনিদেরকে কালিনারি প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

ধাপ-৪:

ক) ট্যুরিস্টদের জন্য প্রোডাক্ট লাইন তৈরি করতে হবে, যাতে করে তাদেরকে দুইরাত গ্রামে ধরে রাখা যায়।

খ) স্থানীয় অটোচালক ও অন্যান্য পল্লী পরিবহণের ড্রাইভারদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

গ) দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্যুরিজম মার্কেটিং শুরু করতে হবে।

ঘ) গ্রামে একটি সমবায়ী ডিপার্টমেন্টাল স্টোর স্থাপন করতে হবে, যেখান থেকে পর্যটকরা ব্যবহার্য পণ্য ও স্যুভেনির সংগ্রহ করতে পারেন।

ঙ) পর্যটকদের জন্য বিনোদন দল তৈরি করতে হবে, যারা স্থানীয় ঐতিহ্য ভিত্তিক সঙ্গীত, নৃত্য বা অন্য যে কোন পরিবেশনা উপস্থাপন করতে পারে।

ধাপ-৫:

ক) গ্রামের বয়স্ক মানুষদেরকে সংগঠিত করে তাদের জন্য কাজ নির্ধারণ ও সে মতো প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।

খ) সকল দরিদ্র মানুষদের মধ্যে আয়ধর্মী কর্ম সৃষ্টি করতে হবে।

গ) আয়ুর্বেদিক ওয়েলনেস সেন্টার তৈরি করে তাতে একজন চিকিৎসক নিয়োগ দিতে হবে।

ঘ) ইয়োগা সেন্টার তৈরি করে তাতে প্রশিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।

ঙ) ০-৫ বছরের শিশুদের জন্য গ্রামে একটি প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।

পর্যটন গ্রামের কর্ম পরিকল্পনা ও অর্থ সংস্থানের উৎস:

ক) সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি যৌথ বাণিজ্যিক উৎপাদন, প্রমোশন ও বিক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট নির্ধারণ করবে এবং সে মতো অর্থের সংস্থান করবে।

খ) বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড পর্যটন গ্রাম স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ, সমবায় সমিতির সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে গ্রামে প্রশিক্ষণ সেন্টার, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাথে যোগাযোগ করে ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র স্থাপন এবং প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনে অর্থের সংস্থান করবে।এইজন্য প্রতিটি পর্যটন গ্রাম স্থাপনের জন্য ৫০ লাখ টাকার একটি থোক বরাদ্দ অনুমোদন করা যেতে পারে।

গ) বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডকে যে কোন একটি বাণিজ্যিক/বিশেষায়িত ব্যাংককে পর্যটন গ্রামে ঋণ বিতরণে এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ জানাতে হবে।

পর্যটন গ্রাম স্থাপনের সুফল:

পর্যটন গ্রামগুলি নিচের ৩ মেয়াদে বর্ণিত সুফল প্রদান করবে-

স্বল্প মেয়াদি: 

- কমিউনিটি ভিত্তিক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী বাড়বে।

- গ্রামে কর্মসংস্থান বাড়বে, ফলে শহরমুখীতা কমবে।

- পরিমাণ ও মানের দিক থেকে পণ্য ও সেবা উৎপাদন বাড়বে।

- গ্রাম থেকে দারিদ্র্য দূর হবে।

- পর্যটকদের গ্রামে আগমন বাড়ার ফলে গ্রামে অর্থের আগমন বাড়বে।

- গ্রামের সাথে পর্যটকদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন বাড়বে।

- গ্রামের মানুষের নিজেদের মধ্যকার কলহ, বিবাদ ইত্যাদি কমবে।

মধ্য মেয়াদি: 

- গ্রামগুলিতে সকল দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সম্পদ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের উপায় উদ্ভাবিত হবে।

- মানুষ সম্পদের বহুমুখী ব্যবহার করতে শিখবে।

- আর্থিক স্বচ্ছলতা বাড়ার জন্য জীবনধারা পরিবর্তিত হবে।

- গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলি শক্তিশালী ও কার্যকর হবে।

দীর্ঘ মেয়াদি:

- জিডিপিতে কৃষির সাথে পর্যটনের সমন্বিত অবদান বাড়বে।

- গ্রামের মানুষের জীবন মান বাড়বে।

- স্থানীয় সরকারের পর্যটন ভিত্তিক কর্মপরিধি বাড়বে ও উন্নয়ন সূচকগুলি পাল্টাবে।

- গ্রামীণ অর্থনীতি টেকসই রূপ পরিগ্রহ করবে।

- গ্রামে শান্তি স্থাপিত হবে।

উপসংহার:

গ্রামগুলিকে বিনিয়োগ, উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও আয়ের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে একমাত্র উপায় হলো পর্যটন গ্রাম তৈরি করা।এতে গ্রামীণ পর্যায়ে মানসম্মত পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে মধ্যস্থতাকারীদের হস্তক্ষেপ ব্যাতিরেকে সরাসরি পর্যটকদের কাছে বিক্রয় করা সম্ভব হবে।তরুণ পর্যটকরা গ্রামের মানুষের জীবনধারা দেখে জীবন গঠনে নতুন শিক্ষা গ্রহণ করবে।নগর ও গ্রামের মধ্যে তৈরি হবে ভালবাসা ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক।গ্রামের মানুষের শহরমুখিতা কমবে এবং সর্বোপরি সামাজিক বৈষম্য দূর হবে।সবচেয়ে বড় কথা, করোনাকালে সারা পৃথিবীর যে পরিবর্তন আসছে তাতে করে প্রত্যক্ষ গ্রামোন্নয়নের মাধ্যমে পর্যটনকে ঢেলে সাজানোর কোন বিকল্প নাই মর্মে সারা পৃথিবীর পর্যটন বিশেষজ্ঞগণ একমত পোষণ করছেন।

লেখক: আহবায়ক, সম্মিলিত পর্যটন জোট ও 

সভাপতি, বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশন 

ইমেইল: [email protected]

এডিবি/