ন্যাভিগেশন মেনু

পশ্চিমবঙ্গ মসনদ নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে মোদি-মমতা, ভোট শুরু, রেজাল্ট ২ মে


দরজায় কড়া নাড়ছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিধানসভার ভোট। ২৭ মার্চ  যতো ঘনিয়ে আসছে ভোট যুদ্ধের দামাম ততই বেজে উঠছে। কে গড়বেন সরকার, আর কে হবেন মুখ্যমন্ত্রী? 

তৃণমূলের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি নাম উঠে এসেছে বিজেপির দিলীপ ঘোষের। খাতায় ছিল প্রখ্যাত ক্রিকেটার সৌরভ গাঙ্গুলীর নামও। কিন্তু তিনি বিজেপিতে যোগ না দেওয়ায় আলোচনায় জল ঢেলে পড়েছে। 

তবে মসনদে কে বসবেন, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে ২ মে অবধি। এদিকে এক সমীক্ষায় সৌরভ গাঙ্গুলীর রাজনীতিতে যোগদান করা উচিত হবে কি না, সেই প্রশ্নের জবাবে ৭৭ শতাংশ ভোটার হ্যাঁ বলেছেন।  

যাইহোক, পশ্চিমবঙ্গ মসনদে যেতে এবার দলবদলের পালা ছিল চোখে পড়ার মতো। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতালাভের পর এমনটি আগে কখনো দেখা যায়নি। 

পশ্চিমবঙ্গে শাসনক্ষমতায় যেতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে নেমে পড়ে কেন্দ্রীয় সরকার বিজেপি এবং রাজ্য সরকার তৃণমূল কংগ্রেস। নরেন্দ্র মোদি এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যেকোন দলকে জিততে হলে ১৪৮টি আসন চাই। 

সেই ভাবনা থেকেই বিজেপির লক্ষ্য, পশ্চিমবঙ্গে তাদের জিততে হবে কম করে ১৮০টি আসনে। আর তৃণমূল সেভাবে এবার লোকসভার মতো কোনো ঘোষণা দেয়নি। তবে বলেছে, ২০২১ সালে ফের ক্ষমতায় আসবে তৃণমূল। 

এদিকে ভারতসহ পার্শ্ব দেশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ও সাধারণের মধ্যে এই প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়েছে যে, সত্যি কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফের ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন, নাকি বিজেপি ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে লোকসভার মতো নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে রাজ্যে ক্ষমতায় আসবে? 

কেননা এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, এরআগে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা নির্বাচনে অভূতপূর্ব ফলাফল করেছে। শুধু ১৮ আসনে জয়লাভ করেনি, জয় পেয়েছে এই রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ১২১টি আসনে। 

সম্প্রতি এক জরিপে তৃণমূল ফের আশার আলো দেখার সুযোগ পেয়েছে। ভোটারদের মনোভাব জানতে যৌথভাবে সমীক্ষা চালায় এবিপি আনন্দ ও সিএনএক্স । ৮ হাজার ৯৬০ জন পুরুষ ও নারী ভোটারের ওপর চালানো এই জনমত সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। 

যে ফলাফল উঠে এসেছে, তাতে মনে করা হচ্ছে, তৃণমূল পেতে পারে ১৪৬ থেকে ১৫৬ আসন। বিজেপি পেতে পারে ১১৩ থেকে ১২১ আসন। আর কংগ্রেস-বাম জোট পেতে পারে ২০ থেকে ২৮টি আসন। 

রাজ্যে সরকার গড়তে হলে প্রয়োজন ১৪৮টি আসন।সমীক্ষায় আরও বলা হয়, তৃণমূল ৪২ শতাংশ, বিজেপি ৩৭ শতাংশ এবং বাম-কংগ্রেস ১৭ শতাংশ ভোট পেতে পারে। তবে বিজেপিও আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। 

তাই অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতৃত্বকে জানিয়ে দিয়েছেন, এবার ১৮০ লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোতে হবে বিজেপিকে। তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন ছয় বিধায়ক। 

এ ছাড়া সম্প্রতি বিধানসভার শূন্য আসনে অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচনে বিজেপি জিতেছে চারটি আসনে। এ ছাড়া আরও বাকি রয়েছে চারটি বিধানসভার উপনির্বাচন। সেখানে লোকসভা ভোটের নিরিখে তিনটি আসনে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি আর তৃণমূল এগিয়ে একটিতে। 

২০১৬ সালে রাজ্য বিধানসভায় বিজেপির আসন ছিল তিনটি, এখন তা বেড়ে হয়েছে ১৩। ভোটও বেড়েছে বিজেপির। এবার লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছে ৪০ শতাংশ ভোট আর তৃণমূল পেয়েছে ৪৩ শতাংশ ভোট।  

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি দিল্লির বিজ্ঞান ভবন থেকে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের তফসিল ঘোষণা করেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুনীল অরোরা। এটাই তাঁর শেষ দায়িত্ব। 

এদিন তিনি ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, কেরালা, তামিলনাড়ু ও এক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল পুদুচেরি বিধানসভা ভোটের তফসিল ঘোষণা করেন। পশ্চিমবঙ্গে ২৯৪টি আসন, আসামে ১২৬টি, কেরালায় ১৪০টি, তামিলনাড়ুতে ২৩৪টি ও পুদুচেরিতে ৩০টি আসনে বিধানসভা ভোট হবে বলে জানিয়ে দেন। 

নিবার্চন কমিশনার সুনীল অরোরা জানান, পশ্চিমবঙ্গে ভোট হবে ৮ দফায়। প্রথম দফায় ভোট হবে ২৭ মার্চ (৩০টি আসনে), দ্বিতীয় দফায় ১ এপ্রিল (৩০টি আসনে), তৃতীয় দফায় ৬ এপ্রিল (৩১টি আসনে), চতুর্থ দফায় ১০ এপ্রিল (৪৪টি আসনে), পঞ্চম দফায় ১৭ এপ্রিল (৪৫টি আসনে), ষষ্ঠ দফায় ২২ এপ্রিল (৪৩ আসনে), সপ্তম দফায় ২৬ এপ্রিল (৩৬টি আসন) এবং অষ্টম দফার ভোট হবে ২৯ এপ্রিল (৩৫টি আসন)। ফলপ্রকাশ করা হবে ২ মে । 

 সমীক্ষায় এই রাজ্যের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ভোটাররা কাকে দেখতে চান, এই প্রশ্নের জবাবে ভোটারদের ৩৮ শতাংশ বলেছেন মমতার নাম। দিলীপ ঘোষের নাম বলেছেন ১৯ শতাংশ ভোটার। শুভেন্দু অধিকারীর নাম বলেছেন ১০ শতাংশ ভোটার। পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচনী প্রচারণায় আসলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি।  

গত রবিবার (২১ মার্চ) রাজ্যের বাঁকুড়ায় দলীয় জনসভায় যোগ দিয়েছেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে এটাই স্পষ্ট হয়, যে কোনোভাবেই হোক এবার বাংলার মসনদে বসতে চায় তারা। 

ওই সভায় পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়কে উদ্দেশ্য করে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘দিদিকে প্রশ্ন করলেই উনি আমার ওপর ক্ষুব্ধ হন। উনি আমার চেহারা পছন্দ করেন না। 

এখন আমার চেহারা দেখুন আর নাই বা দেখুন, বিজেপির নেতাদের চেহারা আপনার অনেকদিন মনে থাকবে। দুর্নীতিমুক্ত সরকার গড়তে বিজেপিকে ক্ষমতায় আনা প্রয়োজন দাবি করে তিনি বলেন, বাম, কংগ্রেস ও তৃণমূল দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থেকে বাংলার সোনালি সময় নষ্ট করেছে। 

তাই সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে প্রকৃত অর্থে বাস্তবায়ন করতে হলে বিজেপিকে দরকার। বিগত ১০ বছর ধরেই দিদি (মমতা) রাজ্যবাসীর সঙ্গে খেলছেন মন্তব্য করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, তবুও আপনার মন ভরেনি। 

বলছেন আবারও খেলা হবে। আমি বলি, এবার আপনার খেলা শেষ হবে। বিজেপির মাধ্যমে রাজ্যে বিকাশ শুরু হবে। মোদী বলেন,'দিদির লোকেরা দেওয়ালে ছবি আঁকছে। 

ছবিতে, আমার মাথায় পা রাখছেন দিদি। আমার মাথা দিয়ে ফুটবল খেলছেন। বাংলার মহান সংস্কৃতিকে কেন অপমান করছেন দিদি? এরপরই মোদীর হুঙ্কার,'বাঁকুড়া থেকে দিদিকে কয়েকটা সাফ কথা বলতে চাই, আমি নিজের শিরে বহন করি দেশের ১৩০কোটি নাগরিকের সেবা।  

আমাকে ও আমার দলকে বাংলার সুপুত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এই সংস্কারই দিয়েছেন। দিদি আপনি আমার মাথায় পা রাখতে পারেন, লাথিও মারতে পারেন। কান খুলে শুনে রাখুন দিদি, বাংলার উন্নয়ন, মানুষের স্বপ্নে ও গরিব ভাইবোনেদের লাথি মারতে দেব না।

এদিকে দলবদল প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আক্ষেপ করে বলেছেন, “আমি গাধার মতো সব মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকে যাই। চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বললেন, তিনি নিয়মিত পূর্ব মেদিনীপুরে আসবেন, ক্ষমতা থাকলে কেউ আটকে দেখাক। শুভেন্দু অধিকারী দলত্যাগ করার পর একাধিকবার নাম না করে তাঁকে আক্রমণ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। 

 ‘বিশ্বাসঘাতক’ তকমাও দেওয়া হয় তাঁকে। মমতা বলেন, গদ্দাররা গিয়েছে, ভাল করেছে। নাহলে আমরাই বের করে দিতাম। এখন আর কারও অনুমতি নিয়ে পূর্ব মেদিনীপুরে আসতে হবে না। এদিকে বিজেপির প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পরই প্রায় প্রতিটি জেলায় ব্যাপক আকারে বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। 

রাস্তায় নেমে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছে বিজেপি নেতা-কর্মীদের। সম্প্রতি বিজেপি-তে যোগদানকারীদের টিকিট দেওয়ার জন্যই এই বিক্ষোভ। বিজেপির আদিনেতারা প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁরা এতদিন দল করে এলেন, আর প্রার্থী হচ্ছেন যাঁদের বিরুদ্ধে তাঁরা লড়াই করেছেন তাঁরা। 

দিলীপ ঘোষই কি তবে বঙ্গ বিজেপির মুখ? দিলীপ ঘোষের নাম করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দরাজ সার্টিফিকেট দেওয়ার পর তা নিয়ে জোর চর্চা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। সাধারণত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখে কারও নামে এমন ভূয়সী প্রশংসার কথা শোনা যায়নি, কিন্তু তাঁর মুখে দিলীপ ঘোষের প্রশংসা একুশের নির্বাচনের আগে জল্পনার বাতাবরণ তৈরি করেছে। 

বাংলার ভোট আর দু’দিন পরেই। এখনও পর্যন্ত কাউকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করেনি বিজেপি। মোদী-শাহরা শুধু বলেছেন বিজেপি ক্ষমতায় এলে কোনও ভূমিপুত্রই হবেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তিনি কে, তা নিয়ে জল্পনা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। 

দিলীপ ঘোষ ছাড়াও শুভেন্দু অধিকারী থেকে মিঠুন চক্রবর্তী, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, মঠের এক স্বামীজি, বাবুল সুপ্রিয়, তথাগত রায়, মুকুল রায়ের মতো বহু নেতার নামই আলোচনায় এসেছে। 

 আর নির্বাচনী ইশতেহারে সিএএ ও এনআরসি চালুর প্রতিশ্রুতি দিলেও আপনি কি আসন্ন নির্বাচনে বিজেপিকে ভোট দেবেন—এই প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ বলেছেন ৩৮ শতাংশ ভোটার। না বলেছেন ৫৪ শতাংশ ভোটার বাংলার ৪২টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে এই মুহূর্তে তৃণমূল কমে ২০ এবং বিজেপি বেড়ে ২০। বাকি দুজন কংগ্রেসের। এই অবস্থায় তৃণমূকে টেক্কা দিতেও পারে বিজেপি। 

অধিকারী পরিবারের আর একজন শুধু বাকি রয়েছেন। একুশের নির্বাচনের আগে তিনিও বিজেপিতে পাড়ি দেবেন। তাহলে তৃণমূল কংগ্রেসের আসনসংখ্যা কমে যাবে বিজেপির থেকে।   

২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ১৮টি আসনে জয়লাভ করেছিল। তৃণমূল পেয়েছিল ২২টি আসন। কিন্তু একুশের আগে দলবদলের হিড়িকে তৃণমূল সংসদ সুনীল মণ্ডল শুভেন্দু অধিকারীর হাত ধরে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। 

ফলস্বরূপ তৃণমূল কমে দাঁড়িয়েছিল ২১ আর বিজেপি ১৯। এবার কাঁথির তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দুর পিতৃদেব শিশির অধিকারী বিজেপিতে যোগদান করায় তৃণমূলের সমান হল তারা। 

লেখক: আজকের বাংলাদেশ পোস্ট-এর নির্বাহী সম্পাদক

[email protected]